#নকল_প্রেম

আমার এক সাহিত্যিক বন্ধু ফেসবুকে তার বন্ধুদের বা বলতে পারো তার অনুগামীদের বার বার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন যে অনেকে নাকি তার লেখা নকল করছেন। কিংবা তার লেখার থিম চুরি করছেন। এই সব লেখা থেকে তাদেরকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছেন। কারন এতে ঊনার লেখার কদর কমছে এবং তিনি ভালো লিখেও লেখার পাবলিসিটি পাচ্ছেন না। এই অজুহাতে তিনি ফেসবুকে আর লেখা পোষ্ট করেন না। এতে আমাদের মতো গরীব পাঠকদের বিনে পয়সায় উনার লেখা সাহিত্য পাঠ থেকে বঞ্চিত হলাম।
কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়। তা হলো লেখার কাহিনী হয়তো চুরি করা যায়। “হয়তো” কথাটা কেন বললাম তা ক্রমশ প্রকাশ্য।কিন্তু থিম বা ভাব ইংরাজীতে যাকে বলে লেখার স্টাইল কি চুরি করা যায়!!! আমি অনেক চিন্তা করে দেখলাম যে কোন প্রকারে কারও লেখার স্টাইল কখনো চুরি করা সম্ভব নয়। কার বাপের হিম্মত আছে একবার মাইকেলের লেখার স্টাইল চুরি করে দেখাক। এতো নকল করিয়ে লেখককে তো দেখলাম, কই দ্বিতীয় শরৎচন্দ্রকে তো পেলাম না!! কার কত হিম্মত আছে একবার শিবরাম চক্রবর্তীকে চুরি করে দেখাক। এতো যদি চুরি হয়ে থাকে তাহলে দ্বিতীয় বঙ্কিমচন্দ্র কোথায়!? আমার তো মনে হয় যারা মাঝারী বা মাঝারী থেকে নীচু মানের লেখক তারাই কেবল চুরির কথা ভাবেন এবং নিজেরা মানসিক রুগীতে পরিনত হন।
প্রত্যেকের লেখার স্টাইল সম্পুর্ন আলাদা।একটা মানুষের ফ্রিঙ্গার প্রিন্ট যেমন অন্য মানুষের ফ্রিঙ্গার প্রিন্টের সঙ্গে যেমন মেলে না, তেমনি একটা মানুষের লেখার স্টাইল অন্য মানুষের লেখার স্টাইল থেকে আলাদা।লেখার নকল যে শুধু এ যুগে আছে, রবীন্দ্র যুগে ছিল না, তা কিন্তু নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত “তোতাকাহিনী” তে নকলের সুন্দর বর্ননা দিয়েছেন। কিংবা আমাদের সত্যজিৎ রায়ের লেখা “গল্প বলিয়ে তারিনী খুড়ো” সুন্দর করে তুলে ধরেছেন। দু'টো গল্প থেকে পরিস্কার হয়েছে যে কোন কাহিনী চুরি হতেই পারে। কিন্তু সেই চুরি করা কাহিনীকে যগোত্তীর্ন হতে হবে। যা ডারউইন সাহেবের ভাষায় “স্ট্রাগল ফর একজিস্টেন্ট এন্ড সারভাইভেল অফ দা ফিটেষ্ট”। যে যোগ্যতম নও সে পৃথিবী থেকে অর্থাৎ সাহিত্য জগৎ থেকে হারিয়ে যাও। আর এটা সবাই জানেন যে চুরি করা বা নকল করা লেখা কখনো যুগোত্তীর্ণ হয় না।
যারা ফুটবল খেলা ভালোবাসেন তারা দেখবেন যে কিছু অবিসংবাদী প্লেয়ার আছে যারা অনায়াসে অসম্ভবকে সম্ভব করে বল গোলে পাঠিয়েছেন। পরে সাংবাদিক সম্মেলন করতে গিয়ে তারা নিজেরাই ঠিকমতো বলতে পারেন নি কিভাবে তিনি গোলে বল পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমরা যারা দর্শক তারা বুঝতে পারি যে জাত খেলোয়াড়দের পক্ষে এই রকম খেলা সম্ভব। পরে অনেক চেষ্টা করেও ঐ খেলোয়াড় ঐরকম গোল করতে পারেন নি। খ্যাতনামারা ঐ জাতের হন। তাদের নিজেদের সৃষ্টিকেও নিজেরাই পুনঃসৃষ্টি করতে পারেন না। যেমন ধরুন “কাবুলীওয়ালা” “ মহেশ”,”পয়োমুখম্”,খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন,রামের সুমতি, অতিথী ইত্যাদি গল্পগুলোর কখনো নকল হয় নি। পণ প্রথা নিয়ে অনেক লেখক নিজস্ব স্টাইলে গল্প লিখেছেন। কিন্তু কখনো কি শুনেছেন যে রবীন্দ্রনাথের “দেনাপাওনা”র নকল হয়েছে। কখনো কি শুনেছেন “বিদ্রোহী”র নকল হয়েছে। আসলে প্রকৃত মেরিট কখনো চুরি হয় না।
আবার আসি আমার ঐ সাহিত্যিক বন্ধুটির কথায়। তিনি প্রায় কারুর লেখা পড়েন না বললেই চলে। না পড়ার কারন কি? ভালো লাগে না ,নাকি পড়ার সময় পান না!! পরে জানতে পারলাম যে উনি কারুর লেখা পড়েন না এই ভয়ে যে যদি তিনি উনার লেখায় প্রভাবিত হয়ে যান!!! ভাবি এ এক আজব চিন্তাভাবনা। আরে ভাই তুমি অপরের লেখা না পড়লে, তোমার লেখা পড়বে কে? তুমি শুধুই লিখে যাবে। আর অপরে শুধু মুখ গুঁজে পড়ে যাবে? তারা কি তোমার লেখা পড়ে তোমার উদ্ধারের জন্য পৃথিবীতে পদার্পন করেছেন??? আরে লেখকরা পড়লে তবেই তোমার লেখার কোয়ালিটি বোঝা যাবে।কেউ যদি ভেবে থাকেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র,শরৎচন্দ্র, নজরুল ইত্যাদি না পড়ে সাহিত্যিক হবেন, তাহলে তিনি মূর্খের রাজ্যে বাস করছেন। আপনার লেখায় হয়তো উনাদের প্রভাব পড়বে, কিন্তু আপনার স্টাইল কিন্তু পৃথকই হবে।
আপনি খ্যাতিমানদের লেখা না পড়লে উপমা, উপমান, শব্দের উৎকর্ষ, শব্দের অপকর্ষ, শব্দদ্বিত্ব, বর্ণলোপ, বর্ণবিপর্জয়, বাগধারা ইত্যাদি কি করে বুঝবেন আর সার্থক প্রয়োগ শিখবেন। আপনি যদি কবি হন তাহলে আপনাকে মাত্রাবৃত্ত,অক্ষরবৃত্ত,স্বরবৃত্ত, পয়ার, সনেট, ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে। আর সেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুকান্ত, সত্যেন্দ্রনাথ ইত্যাদি না পড়লে এই সব ছন্দ সম্পর্কে জানবেন কি করে এবং এদের সার্থক প্রয়োগ শিখবেন কিভাবে? আমার তো ভাই কিছুতেই মাথায় কিছু ঢুকছে না। তাই ভাবি ফেবুর লেখাগুলোতে “লাইক” বা “কমেন্ট”এতো কম কেন!!! অপরের লেখা পড়লে নাকি লেখক ঐ লেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং তার লেখাগুলোতে সেই প্রভাব সঞ্চালিত হয়। এ এক হাস্যকর অভিযোগ। আরে ছেলের ভিতর বাপের গুন বর্তাবে না!!! এই গুনের পরম্পরা বিকাশে গুনের উৎকর্ষ সাধিত হয়। ভাগ্যিস এই রকম মনোভাবাপন্ন লেখকরা কখনো বলে বসে নি যে তারা “বর্ণপরিচয়” পড়েন নি!!! আরে বাবা রবীন্দ্রনাথ যা লিখে গেছেন তার বাইরে নতুন ধারার সৃষ্টি প্রায় অসম্ভব। আমরা যা কিছু করছি সব চর্বিত চর্বন। এই চর্বিত চর্বন কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করতে পারলে সুনাম আসবেই।
এবার আসি কাহিনী চুরি প্রসঙ্গে। ধরুন কেউ একজন গল্প লিখেছেন ত্রিকোন প্রেম নিয়ে। এই ত্রিকোন প্রেমে একটি মাত্র মেয়ে আর দুটি ছেলে। এই রসায়নে অনেক লেখকের অনেক গল্প আছে। শুধু তাই নয় বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া, তামিল, গুজরাটি, ইংরাজী আরবী, ফারসী ইত্যাদি সাহিত্যে এই রসায়নের ভুরি ভুরি গল্প আপনি দেখতে পাবেন। এবার আপনি কিভাবে ঠিক করবেন কে কখন কার কাহিনী চুরি করেছেন? বাস্তবে এভাবে চুরি ধরা সম্ভব নয়। আমি কখনো উড়োজাহাজ দেখিনি। যেদিন প্রথম উড়োজাহাজ দেখলাম এবং বিমান বন্দর দেখলাম, সেদিন আমার অনুভুতি প্রকাশ করতে একটি ভ্রমন কাহিনী লিখতেই পারি। কিন্তু এর আগে যে বা যারা বিমান আর বিমান বন্দর দেখে ভ্রমন কাহিনী লিখেছেন তারা যদি বলে আমি চুরি করেছি তাহলে কি আমি মেনে নেব? বোধ হয় সকলেই আমার পক্ষে সায় দেবেন যে এটাকে কখনো চুরি করা বলে না। চুরি বা নকল করা সম্পর্কে কারও যদি অন্য কোন যুক্তি থাকে, তাহলে আমাকে জানাতে পারেন।
প্রবন্ধ শেষ করার আগে কিছু প্রবন্ধের নাম করন সম্পর্কে একটু সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন আছে। প্রবন্ধের নাম দিয়েছি “নকল প্রেম”। কিন্তু লেখাতে একবিন্দুও প্রেমের ফোঁটা নেই। যদি আপনারা একটু অন্যরকমভাবে দেখেন, তাহলে আমার লেখার অর্থ খুঁজে পাবেন। তাহলে এখন “নকল প্রেম” হতে বিদায় নিলাম।
কপিরাইট @তারাপদ মাঝি
১৫ই জুন, ২০১৯
দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.