# ঈশ্বর করুনাময়

# ঈশ্বর করুনাময়


কোথা থেকে যে জীবনের পঞ্চাশটা বসন্ত পেরিয়ে এলাম তা বুঝতেই পারি নি।য়ার পারবোই বা কি করে! জন্মের পর যখন জ্ঞান হলো তখন দেখি আমার প্রতিবেশীর তুলনায় আমাদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত করুন। এক ছটাক জমিনেই। ঘরের চালটা এতো দীর্ন জির্ন যে বৃষ্টি পড়লে প্রথম ফোঁটাটি মনে হয় আমার বাড়ির মেঝেতে পড়তো। কতদিন রাতে শুয়ে শুয়ে চালের ফাঁক দিয়ে আকাশের চাঁদ দেখেছি যে সে আর বলবার নয়। বাবা মা দিন্ মজুরী করতেন। যা রোজগার করতেন তাতে ছ'জনের পেট কিছুতেই চলতো না। পেটের জ্বালায় ভিক্ষে চেয়েও খেয়েছি। পরের বাড়ি থেকে ফেন আমানি চেয়ে খেয়ে জীবন ধারন করেছি।

এতো কিছুর পরেও আমার বাবা আমাকে স্কুলে পাঠাতেন। কিন্তু আমি চাইতাম দিন মজুরী করতে। তাতে দু'টো পয়সা আসতো। সংসারের স্বচ্ছলতা আসতো। কিন্তু বাবার ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশুনা করে চাকরি বাকরী করি। তাহলে সংসারের দারিদ্রতা চিরকালের মতো ঘুচবে। ফলে এমনও দিন গেছে ছিন্ন বস্ত্রে দু তিন দিন উপোস থেকেও স্কুলে গেছি। ঈশ্বরের কৃপায় হোক, কিংবা তাঁর বিচিত্র খেয়ালেই হোক, আমি ছেলে বেলা থেকে পড়াশুনায় ভালোই ছিলাম। মাধ্যমিক পর্যন্ত ক্লাসে প্রথম বা দ্বিতীয় ছাড়া বেশী রোল কোন দিন করি নি। ১৯৮৫ সালে যখন ৬১৯ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করলাম, তখন আমাকে পাশা পাশি গ্রামের মানুষ দেখতে এসেছিল। তখন স্কুলে ড্রপ আঊটের ছাত্র সংখ্যা অনেক বেশী ছিল। তাদের বিস্ময় ছিল একটি নাই খেতে পাওয়া পরিবারের ছেলে, যার না আছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, বই, খাতা, কলম, সেই ছেলে কিভাবে মাধ্যমিক পাশ করতে পারে ? 


মাধ্যমিক পাশ করার পর আমার উচ্চাশা বেড়ে গেল। আমার চোখে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন এসে ভীড় জমালো। ভর্তি হলাম সায়েন্স নিয়ে। আমার এক শিক্ষক আমাকে বললেন-" তারাপদ, তুমি আর্টস নিয়ে পড়তে পারতে। সায়েন্স নিয়ে পড়ার যোগ্যতা তোমার আছে। তুমি উচ্চমাধ্যমিকে সমুহ বই লাইব্রেরী থেকে বা স্পেসিমেন্ট কপি থেকে পেয়ে যেতে পারবে। কিন্তু ডিগ্রি কোর্স করতে গেলে তুমি সমস্যায় পড়বে। বই পাবে না। টিউশান নিতে পারবে না। অনেক টাকার ব্যাপার। কিন্তু আর্টস নিয়ে পড়লে তুমি অন্তত গ্র্যাজুয়েট হতে পারবে"। আমি ঊনার কথায় কর্নপাত করি নি। আমি সায়েন্স নিয়ে পড়তে থাকলাম।

ইতিমধ্যে বাড়িতে শুরু হলো নতুন উৎপাত। বাবাকে প্রতিবেশীরা বোঝালো যে ছেলেকে বেশী পড়ানো ভালো না। তোমার ছেলে কি পড়াশুনা করে চাকরী করবে? মিছি মিছি তুমি সময় নষ্ট করছো। তার চাইতে ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসার করে দাও। ছেলে বাড়িতে খাটুক। রোজগার করুক। বৃদ্ধ বয়সে একটু খাওয়া দাওয়া করুন। তাছড়া ছেলে তোমার যদি চাকরী করে সে কি আর এখানে থাকবে? সে বউ নিয়ে শহরে উঠবে। তখন তোমার কি লাভ হবে? বাবা বিভ্রান্ত হয়ে আমার বিয়ে দেওয়ার তোড় জোড় করতে শুরু করলেন। তাকে সামাল দিতে আমার কালঘাম ছুটে গেল। পড়াশুনায় মনসংযোগের অভাব হলো। উচ্চমাধ্যমিকে খারাপ রেজাল্ট হলো। মাত্র ৫১১ নম্বর পেয়ে সেকেন্ড ডিভিশানে ১৯৮৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম।

এবার শুরু হলো আর এক সংগ্রাম। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি ডায়মন্ডহারবারে পাকাপাকিভাবে ঘাঁটি নিলাম। ক্লাস এইটে একটি স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। আর মাধ্যমিকে ৬১৯ পাওয়ার জন্য কিছু টাকা পেয়েছিলাম। সব টাকাগুলো বাঁচিয়ে রেখেছিলাম পড়ার খরচ চালানোর জন্য। কিন্তু ডিগ্রি কোর্স পড়তে এসে দুনিয়াটিকে নতুন ভাবে চিনলাম। এ আর এক দুনিয়া। এখানে কেউ কাউকে সাহায্য করে না। প্রত্যেকে নিজেরটা নিয়েই ব্যাস্ত। এতো কিছু সত্বেও আমার ডাক্তারী বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার নেশা যায় নি। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর কম নম্বরের জন্য সায়েন্স বিভাগে আমি কোথাও অনার্স পেলাম না। যা পাচ্ছি আর্টস বিভাগে অনার্স। কিন্তু আর্টস বিভাগে অনার্স পড়ে আমার হবে কি! কিন্তু আমার একবারও মনে হয় নি যে আর্টসে পড়ে কি কেউ চাকরী পায় নি? ১৯৮৭ সালে কাঁথিতে ইংরেজী অনার্স, ডায়মন্ডহারবারে ইকনোমিকস অনার্স, দক্ষিন বারাসাতে অ্যাকাউন্টেন্সি অনার্স এ ভর্তি হলাম। সবার মন্তব্য নিয়ে যেখানে হোক একজায়গায় পড়লেই চলবে।

এইসব ছোটাছুটি করতে গিয়ে ততদিনে আমার জমানো টাকা শেষ । এবার পড়ে গেলাম মহা বিপদে।ইতি মধ্যে আমার জয়েন্ট এন্ট্রান্সের রেজাল্ট বের হলো। আমি মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেলাম। কিন্তু প্রাথমিকভাবে ভর্তি হওয়ার এবং পরবর্তীকালে পড়াশোনা করার টাকা পাবো কোথায়? ততদিনে দুনিয়ার বাস্তবটা আমার বোঝা হয়েগেছিল। ডাক্তারী পড়ার নেশা আমার ছুটে গিয়েছিল। পরে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার সুযোগ পেলেও সেই কল লেটারটি ছিঁড়ে পায়ের তলায় পিশে নষ্ট করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ডাক্তারী পড়ার কল লেটারটি সযত্নে গুছিয়ে রেখেছিলাম। আমার ডিগ্রি কোর্স পড়াও তথৈবচ। এই সময় আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন আমার একদাদা বিরাজ কোলে এবং আমার পরম সুহৃদ পলাশ মন্ডল। বিরাজ দা আমাকে মাসে মাসে কিছু টাকা দিতেন। সেই টাকা খুবই সামান্য। কিন্তু সেটা আমার কাছে তখন ছিল খুবই অসামান্য।আমার পরম মিত্র পলাশ আমাকে তার নিজের বিছানায় স্থান দিয়েছিল। আর আমি যতদিন না প্রাইভেট টিউশান পড়িয়ে মেসের খরচ যোগাড় করতে পারছি, ততদিন সে আমার মেসের খরচ যুগিয়েছিল। প্রায় ছয়মাস লেগেছিল আমার। ওদের এই অবদান আমি জীবনে কোন দিন ভুলতে পারবো না।

economics অনার্স নিইয়েই পড়ছিলাম। না ছিল  টিউশান , না ছিল বই। এদিকে বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর আবেদন। পড়াশুনা লাটে উঠলো। টিউশান করে যা পেতাম, তাতে মেসের খরচ বাঁচিয়ে কিছু টাকা জমতো। সেই টাকা বাড়ীতে পাঠাতে গিয়ে আমার দফা রফা। অবশেষে অনেক কষ্টে ১৯৯২ সালে গ্র্যাজুয়েট হলাম। তাও আবার পাস কোর্সে। অনার্সের সম্মান রাখতে পারিনি। ইতি মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের উপর রেল, ব্যঙ্ক, এস এস সি, পি এস সি, পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফ ইত্যাদিতে  পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হন নি। বিরানব্বই এর পর থেকে শুরু হলো লাগাতার চাকরীর পরীক্ষা দেওয়া। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত লাগাতার পরীক্ষা দিয়ে বেশ কিছু পরীক্ষায় সাফল্যলাভ করলেও আমার আর্থিক দুরাবস্তার জন্য আমার চাকুরী পাওয়া হয় নি। তবে কি কি পরীক্ষায় সাফল্যলাভ করেছিলাম সে সব উল্লেখ করে অবিশ্বাসীর পাত্র হতে চাই না। তবে কোন সাফল্যলাভ আসে নি এটাই বিশ্বাস করেছি।

১৯৯৬ সালের শেষের দিকে আমার বিবাহ হলো। বিবাবের পরে ডায়মন্ডহারবারে আর থাকা সম্ভব হয় নি। এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাড়িতে ফিরেই আবার অবস্থা সংকটাপন্ন হলো। ততদিনে আমার অনুজ বিয়েসাদি করে সংসারের গুছিয়ে বসেছে। সে দিন মজুরী করে রোজগার করে। সেই এখন সংসারের মুল উপার্জনকারী ব্যাক্তি। আমার কানাকড়ি রোজগার নেই। অথচ খেতে দুটো পেট। কি করি। অবশেষে সেই টিউশান পড়ানো শুরু করা। তখন পাড়া গাঁয়ে টিঊশান পড়ানোর চল ছিল না। সবে মাত্র শুরু হয়েছিল চল। যাইহোক পড়াতে পড়াতে একটা জায়গায় পৌছাবার চেষ্টা করলাম। ১৯৯৭ সালে আমার বড় মেয়ের জন্ম হলো। অনটনের মাত্রা ছাড়ালো। সেই সময় এক বর্ষনক্লান্ত দিনে রান্না করার জ্বালানী নাই। এমন কি মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য দুধ গরম করার মতো জ্বালানীটুকুও নেই। তখন ক্ষোভে দুঃখে চাকুরী পরীক্ষার যত বই, জয়েন্টের বই ও কললেটার, চাকুরীর যত কললেটার, Intigrel calculas, Differencial calculas, malthus theory, co-ordinet geometry, dynamics, lenear programming progress, set theory, indian economics, microeconomics, mathematical economics প্রভৃতি যত বই ছিল সব জ্বাল দিয়ে রান্না আর মেয়ের দুধ গরম করেছি এবং সেই সঙ্গে চাকরীর আশা চিরতরে ছেড়ে দিয়ে বুকের জ্বালা জুড়িয়েছি।

আমার রোজগার না থাকার জন্যই হোক, বা অন্য কোন কারনেই হোক আমার বাবা আমাকে যৌথ পরিবার থেকে আলাদা করে দিলেন ১৯৯৬ সালেই। আমার ভাই এতে অনিচ্ছা প্রাকাশ করলেও সেই আবেদন গ্রাহ্য হয় নি। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৪ সালের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত আমার জীবন ছিল বিভিষিকাময়। সুনিশ্চিত রোজগার নেই। অথচ ২০০১ সালে আরও এক কন্যা সন্তানের পিতা হয়ে আমার দিশাহারা অবস্থা। কিন্তু আমার সুদিনের জন্যই হোক, বা দ্বিতীয় কন্যার পয়মন্তেই হোক ২০০১ সাল থেকে আমার টিউশানির পসার জমে যায়। মাসে প্রায় সাত আট হাজার টাকা রোজগার হতে শুরু করলো। তখন ঐ টাকা মোটামুটি আমার পক্ষে কম ছিল না।

২০০৪ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারী আমার জীবনের স্মরনীয় দিন। ঐ দিন আমি কুল্পী ব্লকে সয়াকের চাকুরী নিয়ে বেলপুকুর গ্রাম পঞ্চায়েতে যোগদান করি।বেশ আনন্দেই দি কাটছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে আমার হাই-ব্লাড প্রেসার ধরা পড়লো। তার কিছুদিন ধরা পড়লো হাই কোলেস্টেরল। এই রোগ কতটা ভয়ংকর তা যার হয়েছে সে ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবেন না। ২০১৬ সালে ধরা পড়লো হার্টের রোগ। সে আরও বেশী যন্ত্রনাদায়ক। এখন বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয়  জিনিষ পত্রের সঙ্গে ওষুধও আমাকে কিনতে হয় এবং সামান্য বাজার করতে গেলেও সঙ্গে প্রেসারের ওষুধ রাখতে হয়। একটু শরীর বেতালিম হলেই প্রেসারের ওষুধ খেতে হয়। আর যা হয় হোক, কিন্তু প্রসারটা ঠিক থাকুক এটাই আমার উদ্দেশ্য থাকে।

বর্তমানে আবার একটি রোগের শিকার। অ্যাপেন্ড্রিসাইটিসের যন্ত্রনায় ভুগছি। এটা এমন সময় হলো যখন সপ্তম লোকসভা নির্বাচন চলছে। এই নির্বাচনগুলোতে আমাদের কিছু বিশেষ কাজ করতে হয়। এখন এই অসুবিধার জন্য আমি না পারছি কাজ করতে। আবার না পারছি ঘরে বিশ্রাম নিতে। এখন আমার এক চরম দুর্দশায় রয়েছি। জানি না আগামী দিনে আমার কি হবে। তবে ঈশ্বর করুনাময়। নিশ্চয়ই আমার জন্য কোন না কোন ভালো কিছু করবেন। আমি তার পথের দিকেই তাকিয়ে আছি।

আমার অসুখ বিসুখের কিছু নমুনা এখানে রাখলাম যাতে হার্ড কপি হারিয়ে গেলে পেতে পারি।











































কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.