অশিক্ষিতের স্বর্গারোহণ








একটি মানুষের মধ্যে যে সমস্ত গুনাবলি থাকে তার সবগুলি কিন্তু খারাপ হবে এটা কখনো সম্ভব নয়। একটি মানুষের মধ্যে একটি অন্তত ভালো গুন থাকতে বাধ্য। ভগবান মানুষকে কখনোই সব খারাপ গুন দিয়ে পাঠায় না। এই প্রসঙ্গে একটি গল্পে আসি। গল্পটা শোনার পর আপনারা আপনাদের মতো করে মন্তব্য করবেন।

হিমাংশুবাবুর অর্থাৎ হিমাংশু মন্ডলের তিন ছেলে এবং তিন মেয়ে। বড় ছেলের নাম গোপাল, মেজ ছেলের নাম গোবিন্দ এবং ছোট ছেলের নাম গদাধর। গোপাল এবং গোবন্দ বেশ ব্রিলিয়ান্ট। তারা পড়াশুনায় বেশ ভালো। ভালো পড়াশুনা করার জন্য তারা দুজনেই হাইস্কুলে চাকুরি পেয়ে গেল। ফলে হিমাংশুবাবুর পরিবার বেশ ধনী হয়ে উঠলো। 

কিন্তু গোল বাঁধলো গোপাল বিয়ে করার পর। গোপালের বউ কিছুতেই গোপালের মা আর বোনেদের মেনে নিতে পারে না। যদিও হিমাংশুবাবু বড়ছেলের চাকুরি পাওয়ার আগে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের পড়াতে গিয়ে তার জমি জমা বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে এখন ছেলেদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দিতে। এই ব্যবস্থা গোপালের বউ মেনে নিতে রাজি নয়। তার সাফ কথা দুই মেয়ের বিয়েতে তারা এক পয়সাও খরচ করতে পারবে না। যার মেয়ে তাকেই বিয়ের খরচ সামলাতে হবে।


ঠিক এমন সময় গোবিন্দও হাইস্কুলে চাকুরি পেয়ে গেল। বুদ্ধিমান হিমাংশুবাবু মেজমেয়ের বিয়ে দিতে আর দেরি করলেন না। তাড়াতাড়ি মেয়েকে পাত্রস্থ করলেন। বলা বাহুল্য বড় ছেলের থেকে কানাকড়িও পাওয়া যায় নি। সব খরচ মেজ ছেলে গোবিন্দ দিয়েছে। ছোট মেয়েও বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে। কিন্তু একটি বছর সময় না নিলে মেজ ছেলেকে বিয়ের খরচের কথা বলা যাবে না। কিন্ত ভগবানের যে ইচ্ছা অন্য রকম। ইতিমধ্যে গোবিন্দ তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তুললো। সে মেয়ে আবার বড় বউয়ের এক কাঠি উপরে। বাড়িতে এসেই শাশুড়ির সঙ্গে গন্ডগোল পাকিয়ে আলাদা হয়ে গেল। সেই দেখে বড় ছেলেও আলাদা হয়ে গেল। বাড়িতে হলো তিন হাঁড়ি। বড় ছেলে বউ মিলে এক হাঁড়ি, মেজ ছেলে বউ মিলে দ্বিতীয় হাঁড়ি এবং হিমাংশুবাবুর স্বামী-স্ত্রী,ছোট ছেলে গদাধর এবং ছোট মেয়ে কুন্তী মিলে তৃতীয় হাঁড়ি।


এই অবস্থায় হিমাংশুবাবু বেশ বিপদে পড়লেন। কি করবেন ভেবে পেলেন না। যে ছেলেদের তিনি মানুষ করার জন্য নিজের বিষয় সম্পত্তি জলাঞ্জলি দিয়েছেন, সেই ছেলেরা স্বাবলম্বী হয়ে বাপের সঙ্গ ত্যাগ করলো! কেবলমাত্র ছোট ছেলের পিছনে কিছু খরচ করতে হয় নি। গদাধর একটা আস্ত গবেট। পড়াশুনা একেবারে করতে চাইলো না। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে পড়াশুনার ইতি টেনে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয় আর বিড়ি টেনে বেড়ায়। আরও যে কি কি বদ অভ্যাস গদাধর রপ্ত করেছে কে জানে। কিন্তু সেও পর্যন্ত পারিবারিক ঝামেলায় কষ্ট পেয়েছে বোঝা যায়। যাইহোক হিমাংশুবাবু যখন বুঝলেন, যে দুই ছেলের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না, তাই তাদের আর বাড়িতে ঠাঁই দিলেন না। তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকার ব্যবস্থা করতে বললেন। ছেলেরা নাচতে নাচতে কাকদ্বীপে ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করলেন। পাথর প্রতিমার দুর্বাচটি নামক একটি গন্ডগ্রামে পড়ে রইল তাদের ভ্রাতা ভগ্নি আর জন্মদাতারা।


গদাধর কিন্তু পড়াশুনায় বোকা। কিন্তু এমনিতে বেশ চালাক চতুর। সে বুঝে গিয়েছিল যে দাদাদের মতো তার পড়াশুনা হবে না। তাই পড়াশুনায় সময় এবং অর্থ ব্যয় করে লাভ নেই। তাই সে গ্রামের বিভিন্ন কাজে নিজেকে নিয়োগ করে। বর্ষাকালে ধান রোয়ার কাজ করে, পান বোরজে মাটি দেওয়ার কাজ, পান গোছানোর কাজ,ধান ঝাড়াইয়ের কাজ ইত্যাদি করে। কখনো আবার নৌকায় করে কালনাগিনী নদী দিয়ে সাগরে ইলিশমাছ ধরতে যায়। এইসব করে তার হাতে বেশ কিছু টাকা জমেছে। সেই টাকা সে তার বাবার হাতে দিয়ে বললো- বাবা, দাদারা ছেড়ে গেলেও আমি তোমাদের ছাড়বো না। আমি লাখ তিনেকের কিছু বেশী টাকা জমিয়েছি। তুমি বোনের বিয়ের ব্যবস্থা কর। আরও কিছু লাগলে কারও কাছ থেকে ধার নাও। আমি ধার শোধ করে দেব। বলা বাহুল্য যে হিমাংশুবাবু ছোট ছেলের দেওয়া টাকায় মেয়ের বিয়ে দিলেন। কিন্তু সেই বিয়েতে বড় ও মেজ ছেলের কোন উপস্থিতির ব্যবস্থা করেন নি।


একদিন গদাধর প্রতিবেশীকে সাহায্য করার জন্য কাকদ্বীপের পান মার্কেটে পান নিয়ে গেল। পান বিক্রির পর হোটেলে খেতে গেল। তাদের খাওয়া যখন অর্ধেক হয়েছে এমন সময় হোটেলের মালিক সুনীলবাবু গদাধরের সঙ্গীকে বললেন- এই যে তুহীন, একট কাজের লোক ঠিক করে দাও না। আমার কাজের লোকটা হঠাৎ চলে গেছে। তাই খুব বিপদে পড়েছি। হোটেল চালানো দায় হয়ে উঠছে। দে না ভাই একটি ভালো ছেলে ঠিক করে।

-বেতন কি রকম দেবেন? পাশ থেকে গদাধর জিজ্ঞাসা করে।

-বেতন মাসে আট হাজার টাকা। বছরে দুটি লুঙ্গি, দুটি গেঞ্জি, একটি জামা আর একটি প্যান্ট পাবে। তবে এসব পেতে গেলে শর্ত একটাই রাতে হোটেলে থাকতে হবে।

- আমি আপনার হোটেলে কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার দুটো শর্ত আছে।

-কি শর্ত?

- কাজ আমি যখন খুশি ছেড়ে দেব। তবে কাজ ছাড়ার একমাস আগে আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।

-আমি মেনে নিলাম। সুনীলবাবু বললেন। কিন্তু দ্বিতীয় শর্ত কি?

-আপনার হোটেলের উচ্ছিষ্ট নিয়ে আপনি কি করেন? গদাধর জিজ্ঞাসা করে।

-সে আর বলো না ভাই। প্রতিদিন সকালে পঞ্চায়েতের লোকেরা এসে ডাষ্টবিনে ভরে নিয়ে যায়। আর এর জন্য আমার দিনে এক’শ টাকা গুনতে হয়।

-হোটেলের সব উচ্ছিষ্ট আমায় দিতে হবে এবং তা বিনা মুল্যে।

- সে তুমি নিলে আমার তো মাসে তিন হাজার টাকা খরচ কমে যাবে। আমি আনন্দে রাজি। সুনীলবাবু বললেন।

-তাহলে আমিও আপনার হোটেলে কাজ করতে রাজি। গদাধর বললো।

-কবে থেকে কাজে আসবে? আগে তোমার ফোন নম্বর দাও। সুনীলবাবুর আর তর সয় না।

-কিন্তু সুনীলবাবুকে অবাক করে দিয়ে গদাধর বললো-আপনি চাইলে আমি আজ এক্ষুনি কাজে যোগ দিতে রাজি আছি। হিসেব মতো আপনি আমাকে এখন অন্তত দুটি লুঙ্গি দেবেন। তবে আমার অনুরোধ লুঙ্গির পরিবর্তে সমমুল্যের দুখানা প্যান্ট দেবেন। 

- হঠাৎ কাজের লোক পেয়ে যাওয়ায়, সুনীলবাবু আনন্দে ডগমগ হয়ে গদাধরের আবদার মেনে নিলেন।


গদাধর অনেক ভেবে হোটেলে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গ্রামে কাজের ক্ষেত্র বেশ কমে আসছে। যে সমস্ত কাজ আছে সেগুলি খুবই প্ররিশ্রমের। তারপর ঠিকমতো পয়সা পাওয়া যায় না। কিন্তু হোটেলে থাকলে নিজের পেটের ভাত নিশ্চিতের সঙ্গে বাপ মায়ের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। তাই হোটেলে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহুর্ত দেরি করেন নি।


হোটেলে কাজের ঝক্কি অনেক। সকালে উঠে প্রথমে কল চালিয়ে জলের ট্রাঙ্কগুলো ভর্তি করে নিতে হয়। তারপর বাজারে গিয়ে মাছ মাংস সবজি বাজার করে নিতে হয়। সবজি কাটার লোক এলে তাদের দিয়ে সবজি এবং মাছ কাটিয়ে নিতে হয়। এরপর মসলার লোক আসে। মিক্সচার মেসিনে তাকে দিয়ে মসলা করিয়ে নিতে হয়। সমস্ত জোগাড় আধা আধি হলে রাঁধুনি রান্না শুরু করে। রান্না ছাড়া সব কাজ গদাধর নিজে হাতে দক্ষতার সঙ্গে সামলায়। যারা ওয়েটার আছে তাদেরকেও গদাধর পরিচালনা করে। সুনীলবাবু গদাধরের কাজে খুব খুশি। তাকে আর কাজের জন্য একে ওকে হাঁকাহাঁকি করতে হয় না।খুশি হয়ে তিনি গদাধরকে দুটি সুযোগ দিয়েছেন। তাকে থাকার জন্য একটি আলাদা ঘর দিয়েছেন এবং বেতন বাড়িয়ে দশহাজার টাকা করেছেন।


একসময় গদাধরের রান্নার প্রতি আগ্রহ জাগে। তার মনে রাঁধুনি হওয়ার সুপ্ত বাসনা জাগে। হোটেলে রান্না ভালো হলে রাঁধুনির গুনগান গায়। যে হোটেলের রান্না ভালো, অর্থাৎ রাঁধুনি ভালো সেই হোটেলের খদ্দের বেশী। এবার গদাধর কাজের ফাঁকে ফাঁকে রান্নার কাছে সময় দেয় কায়দা করে। রাঁধুনি যেন না বুঝতে পারে যে সে রান্না শিখছে। আস্তে আস্তে গদাধর শিখতে লাগলো কিভাবে মাংস কষতে হয়, কিভাবে মাছ ভাজতে হয়, কিভাবে ফ্রাইড রাইস বানাতে হয়, কিভাবে বিভিন্ন প্রকারের বিরিয়ানি বানাতে হয়, কিভাবে পোলাও বানাতে হয়। বলতে গেলে চুনো মাছের চচ্চড়ি থেকে শিক কাবাব পর্যন্ত প্রায় সকল রকম রান্না হোটেলে থেকে শিখে গেল। এখন রাঁধুনির সঙ্গে নিজেও দুচারটি পদ গদাধর রান্না করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেই পদগুলি খেয়ে লোকে তৃপ্তির প্রসংসা করে।


সেই বছর সুন্দরবনে আমফান ঝড় হয়ে গেল। মানুষের প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হলে। অনেক মানুষ গৃহ হারা হলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে এলাকায় ত্রান আসতে শুরু করলো।হোটেল প্রায় বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। মানুষের হাতে কাজ নেই, উপার্জন নেই, হোটেলে খেতে আসবে কে? কৃষিজমি লোনা জলে ভরা, বোরজ ভেঙ্গে মাটিতে মিশে গেছে, অনেক মাছের ট্রলার ডুবে গিয়ে অনেক মানুষ প্রান হারিয়েছে।যে হোটেলে চার পাঁচশো জনের রান্না হতো, এখন সেখানে মেরে কেটে তিরিশ জনের রান্না হয়।কতদিন এভাবে চলবে সে কথা বলা মুস্কিল।


ওই সময় একদিন জনা তিনেক লোক এলো গদাধরের “বনশ্রী” হোটেলে খেতে।তাদের বেশভূশা বেশ পশ্চিমী কায়দার। বনশ্রীর মতো হোটেলে খাওয়ার মতো লোক এরা নয়। কিন্তু বাধ্য হয়ে খেতে এসেছে। কিন্তু হোটেলে গদাধরের হাতের রান্না খেয়ে একজন এতই তৃপ্ত হলেন যে তিনি গদাধরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। গদাধর নিজেই পরিবেশন করছিল। সে তার পরিচয় দিল।


ভদ্রলোক বললেন- শোন ভাই, আমাদের কোম্পানীর হোটেল ব্যবসা আছে। হোটেলগুলিকে বলে ফাইভ স্টার হোটেল বা পাঁচতারা হোটেল। আমি ঐ কোম্পানীর একজন ম্যানেজার। আমাদের একজন বাঙালী রান্নার কুক দরকার যিনি বাংলার ঘরোয়া রান্নার স্বাদ দেওয়াতে পারবে। তোমার হাতের রান্না খেয়ে আমি সেই স্বাদ পেয়েছি। তুমি কি আমাদের হোটেলে কাজ করবে? তবে তোমাকে পোষ্টিং করা হবে কানাডায়। ওখানে বসবাসরত বাঙালীরা বাংলার ঘরোয়া রান্নার স্বাদ পেতে চায়। তাই তাদের জন্য একজন কুক আমাদের দরকার।

-গদাধর বললো -আমি কাজ করতে রাজি। কিন্তু বেতন কি রকম হবে সেটা যদি একটু বলেন?

- তুমি কত বেতন চাও? ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

- আজ্ঞে আমার এ বিষয়ে কোন ধারনা নেই। এখানে হলে কত টাকা বেতন হলে আমার পোষাত সেটা আন্দাজ করতে পারতাম। কিন্তু বিদেশে জিনিষ পত্রের কিরকম দাম, সেখানে জীবন ধারণের খরচ কি রকম হবে আমার তো কোন ধারনা নেই। তাই বেতনের চাহিদার কথা আমি বলতে পারবো না।

- ভদ্রলোক মুচকি হেঁসে বললেন- এখানে তোমায় কত টাকা বেতন দেয়?

-আজ্ঞে মাসে দশ হাজার টাকা।

-কানাডায় তুমি বেতন পাবে মাসে তিরিশ হাজার ডলার যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় চব্বিশ লক্ষ টাকা। কি রাজি তো?

- গদাধরের মাথা ঘুরছিল বেতনের কথা শুনে। সে কোন রকমে মাথা নেড়ে তার সম্মতি জানালো।


তারপর একদিন সাহেব সেজে সেফ হয়ে কানাডার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল গদাধর। গদাধর প্রমান করে দিল কোন কাজই ছোট নয়। সব কাজেরই চরম প্রাপ্তি আছে। কাজকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসলে সেই চরম প্রাপ্তিতে পৌছানো যায়। লোকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা পড়াশুনার জন্য বিদেশে যায়। কিন্তু সে যাচ্ছে মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করার জন্য। সত্যি কি অদ্ভুত তার ভাগ্য। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে প্রনাম করে গদাধর একাগ্র মনে প্লেনে বসে রইলো।


কপিরাইট @তারাপদ মাঝি

দেবনগর

২৮ শে জানুয়ারী,২০২৩






কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.