পরিবর্তন



Symbolic Picture 



রতনবাবুর প্রকৃত নাম অবিনাশ গোস্বামী। কিন্তু কি করে যে তিনি রতন গোস্বামী হলেন তা তিনি নিজেই জানেন না। যাইহোক এই রতনবাবুর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। কারণ তিনি একজন সুচিকিৎসক। পাড়াগাঁয়ে তিনিই একমাত্র পাশকরা এম বি বি এস ডাক্তার। উনার হাতযশ ভালো এবং চেম্বারে রুগির ভীড়ও বেশ থাকে। সুতরাং রতনবাবুর চিন্তার কিছু নেই। হাতে প্রতিদিন ভালো মোটা টাকা আসছে এবং গ্রামে থাকেন বলে কোন রকম মাছ বা শাকশব্জি কিনতে হয় না। সবই বাড়িতেই তৈরী করান। 


চিন্তা শুধু একটাই।নিজের ছেলে তপনকে নিয়ে। পড়াশুনা একেবারেই করে না। সারাদিন শুধু পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা দিয়ে বেড়ায়। পাড়ার মোড়ে যে কয়েকটা দোকান আছে, সেখানে সে আড্ডা দেয়। সারাদিন শুধু তাস পেটে। শুধু দুপুরে আর রাতে বাড়িতে আসে খাওয়ার জন্য। বাবার কোন কথা কানেই তোলে না। মাকে তো গ্রাহ্যই করে না। একমাত্র সন্তান বলে বাবা মা দুজনে কিছুই বলে না। এটা তপন বুঝতে পারে বলে, যা খুশি তাই করে বেড়ায়।


তবে একটি মানুষের মধ্যে সব যে খারাপ গুন থাকবে, এমনটা ঈশ্বর কখনো হতে দেন নি। তাই তপনের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। তপন অত্যন্ত সহানুভুতিশীল মানুষ এবং পরোপকারী। পরের দুঃখ দুর্দশায় সব সময় তাদের পাশে থেকে সাহায্য করার চেষ্টা করেন। আর একটি গুন খুব ভালো আছে তপনের। তা হলো তপন ভালো ছবি আঁকতে পারে। একবার কোন কিছু দেখলে তা এঁকে দেওয়ার ক্ষমতা অপরিসীম। এই অভ্যাসটা তপন ছাড়তে পারে নি। মনে আবেগ এলেই কাগজ আর রঙ নিয়ে গ্রামে বেরিয়ে পড়েন ছবি আঁকতে। কখনো নদীর পাড়ে, কখনো দিঘির পাড়ে বা নির্জন পুকুরের পাড়ে বসে প্রকৃতির সব অপুর্ব ছবি আঁকে। তখন ছবিগুলিকে দেখলে কে বলবে তপন একটি লোফার বাউন্ডুলে টাইপের ছেলে!


তপনের গ্রামের নাম গোচরণ গ্রাম। গ্রামের প্রকৃতি আধা গ্রাম এবং আধা শহর। গ্রামে একটি শিব মেলা বসে। চলে একমাস ধরে। মেলার আয়তন প্রায় তিরিশ চল্লিশ বিঘের মতো। হরেক রকম দোকান বসে, খেলা বসে, সার্কাস বসে। হঠাৎ তপনের মনে হলো সে মেলায় একটি শোরুম দেবে। সেই শোরুমে থাকবে নিজের আঁকা ছবি। আর কেউ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তার ছবি এঁকে দেওয়া হবে। তপন তার বন্ধুদের নিয়ে শোরুম খুলে বসে পড়লো। প্রথম দিনেই তপনের সব ছবিই বিক্রি হয়ে গেল। ছবি ছিল প্রায় শ’দেড়েক। ছবি বিক্রি করে পেল প্রায় দেড় দু লাখ টাকা!!! 


পরের দিন তপন শুরু করলো পোট্রেট আঁকার কাজ। প্রথমে এলো একটি মেয়ে। অষ্টাদশী মেয়েটি নিজের ছবি আঁকাতে চায়। তপন মাত্র একঘন্টায় তাকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুললো অপুর্বভাবে। মেয়েটি পোট্রেট দেখে একেবারে মুগ্ধ। সত্যি ছবিখানা দেখলে কিছুতেই চোখ ফেরানো যায় না। শুরু হয়ে গেল ছবি আঁকানোর লাইন। প্রায় প্রতিদিনই ছবি এঁকে দেড় দু হাজার টাকা রোজগার হয়ে যায়। মেলার ক’দিনে রোজগারের কথা, আঁকার খ্যাতির কথা তপনের বাবা রতনবাবুর কানে যায়। তিনি খুশি হন কিন্তু পরক্ষনেই বলেন, যতদিন মেলা চলবে,  ততদিন ওর কারিগুরি চলবে। তারপরে সেই আগের জীবনে ফিরে যাবে। এতে আর লাভ কি। ছবি এঁকে কি সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচা যাবে?


মেলার শেষ দিনে শহর থেকে এলেন একজন শুটেড বুটেড ভদ্রলোক। তিনি তপনকে বললেন- আমার পুরো শরীরের ছবি এঁকে দিতে হবে। আমি যে পোষাক পরে আছি, সেই পোষাক হুবহু দেখাতে হবে। তপন বললো- হয়ে যাবে স্যার। আপনি নিশ্চল হয়ে দাঁড়ান। দাঁড়ানো অবস্থায় তপন ভদ্রলোকের ছবি এঁকে দিলেন। ছবি দেখে ভদ্রলোক মুগ্ধ হলেন। তিনি তপনকে বললেন- তুমি আমার কোম্পানীতে কাজ করবে?

-কিসের কাজ স্যার?

- ছবি আঁকার কাজ?

- উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে নিশ্চয় করবো।

- ভেবে দেখ, আমি তোমায় মাসে ষাট হাজার টাকা বেতন দেব। তোমার কাজ হবে দেশে বিদেশে ঘুরে বিভিন্ন নারী পুরুষের ছবি আঁকা। ছবির বিষয় বস্তু হবে পোষাকের ডিজাইন, ক্যালেন্ডারের জন্য পোট্রেট ছবি, মন্দির মজজিদ গীর্জার ছবি এবং নিজের দৃষ্টিকোন থেকে যা সুন্দর মনে হবে তাই আঁকতে হবে। প্রতি মাসে অফিসে ছবি জমা দিতে হবে। প্রায় প্রতিটি দেশে আমাদের কোম্পানী আছে। তুমি সেখানেই সবকিছু জমা দিতে পারবে। তোমার যাতায়াত খরচ, থাকা খাওয়া সবকিছু খরচ অফিস বহন করবে।


এইসব শুনে তপন আর না বলতে পারলো না। তার বাবা মা আর বন্ধুদের কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু এ সুযোগ ছাড়লে, জীবনে আর সোনালী সময় আসবে না। তপন ভদ্রলোকের সঙ্গে সব রকম কথা বার্তা সেরে নিলেন। তারপর এক পড়ন্ত সুর্যালোকের রক্তাভায় আরব সাগরের বুকের উপর দিয়ে উড়ে চললো নতুন জীবনে সুখের সন্ধানে।


কপিরাইট @তারাপদ মাঝি

দেবনগর

১৪/০২/২০২৩


কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.