এক বর্ষার দিনে

এক বর্ষার দিনে
*********
#তারাপদ মাঝি
**********
আমার কলিগ বা বলতে পারেন আমার ভাতৃতুল্য শিবু বেশ জমিয়ে গল্প বলতে পারে। আমার অফিসে তার মতো গল্প বলার লোকের জুড়ি মেলা ভার।যখনই সময় পাই, কাজের ফাঁকে ওকে নিয়ে আড্ডায় বসে যাই। ও বেশ জমিয়ে গল্প শোনায়। কত যে গল্প ওর ভান্ডারে আছে, সে আমি পরিমাপ করতে পারি না।কলেজের গল্প, ইউনিভারসিটির গল্প, বেড়াতে যাওয়ার গল্প, অফিসের গল্প, ভোটের গল্প, পাড়ার গল্প, মায়ের গল্প ইত্যাদি নানা জাতের ও ভিন্ন জাতের গল্প ওর কাছে শুনেছি।
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি হবে। সেদিন আকাশটা মেঘে ঢাকা ছিল সকাল থেকে।হঠাৎ বারোটা নাগাদ ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। বর্ষার সময় এমনিতেই কাজের একটু চাপ কম। তাই শিবুকে নিয়ে আড্ডায় বসে গেলাম।আমরা অফিসের সাত আটজন মিলে শিবুকে চেপে ধরলাম।এই বর্ষার দিনে জমিয়ে একখানা গল্প শোনাতে হবে। শিবু বললো-“গল্প শোনাতে পারি, কিন্তু এর জন্য আমাকে ঘুগনি-মুড়ি খাওয়াতে হবে”।তখন আমাদের পঞ্চায়েত সেক্রেটারী পরাণ চক্রবর্তী বললেন-“আরে তোর মনটা এতো ছোট কেন? ঘুগনি-মুড়ির চিন্তা করছিস! তোকে তড়কা রুটি খাওয়ানো হবে। তুই চিন্তা করিস না। জমিয়ে এখন একখানা গল্প শোনা দেখি”।
আমরা সবাই শিবুকে ঘিরে বসলাম। ও আমাদের বললো-“আজ একখানা ভূতের গল্প শোনাব। সে অদ্ভুত ভূতের গল্প”। বললাম-“ভুতের গল্প! ওটা কি এই আবহাওয়াতে জমবে? অন্য কিছু হয়না?”
শিবু বললো-“আরে শোনো না গল্পখানা। আমি মনে করি, তোমরা শুনলে তোমাদেরও ভালো লাগবে”।আমরা সম্মতি দিতে , শিবু গল্প আরম্ভ করলো।
শিবু বললো-“তোমরা তো জানো আমার গ্রামের নাম পাকুড়তলা।কুল্পী-বারুইপুর রোড থেকে কিছুটা ভিতরে। তবে গ্রামখানা ভারী সুন্দর।গ্রামে প্রচুর আম-জাম-কাঁঠাল গাছ রয়েছে। ছায়াঘন বলতে যা বোঝায়, আমাদের গ্রাম ঠিক তাই। গ্রামের শেষ প্রান্তে প্রায় বিঘা দশেক জমির উপর একটি শ্মশান আছে। ওখানে একদিকে প্রাপ্ত বয়স্কদের পোড়ানো হয়,আর অন্যদিকে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের পোঁতা হয়।এটা হতো অনেক বছর আগে। এখনও ওখানে মোড়া পোড়ানো হয়। তবে খুব কম। বিষ্ণুপুর শ্মশানে মোড়া পোড়ানোর ভালো ব্যবস্থা হওয়ায় ওই শ্মশানে আর তেমন মোড়া পোড়ানো হয় না। যারা গরীব মানুষ, সাধারনত তারাই এখন ওই শ্মশানে মোড়া পোড়ায়। কিন্তু শিশুদের এখনো ওখানে পোঁতা হয় নিয়মিত। কিন্তু  ঘটনা হলো সেই জমি পুর্বে ফাকা ছিল। সকলে তখন বলতো ‘গোরস্থান’।জায়গাটি ছিল একেবারে গাছপালা শুন্য। আগাছা বা গাছপালা হলে, গ্রামের লোকেরা মিলে বছরে একবার বর্ষার পরে কেটে খালি করে আসতো।এখন লোকজন খুব ব্যস্ত। আর নিয়ম করে কেউ শ্মশান পরিষ্কার করতে যায় না।ফলে জায়গাটি আম-জাম-কাঠাল আর নানারকম আগাছাতে জঙ্গলাকীর্ন হয়েছে। আর জায়গাটি হয়ে উঠেছে শেয়াল, কটাশ, নেউল, সাপ আর ভূতেদের আড্ডা।রাতে শেয়ালেরা ডেকে ডেকে উঠে আর চলে জোনাকির আলোর লুকোচুরী খেলা।রাতের বেলা তো দূরের কথা, দিনের বেলাও সেখানে কেউ যেতে সাহস পায় না”।
আমি বললাম-“শিবু, সব মিলছে। কিন্তু হিসাবের মনে হয় একটি জায়গায় গরমিল হচ্ছে। সেটা হলো-গ্রামের মধ্যে এখনকার দিনে দশবিঘা জমি পতিত পড়ে থাকাটা মানাচ্ছে না। বামফ্রন্টের ৩৪ বছর আর দিদির ৮ বছর মোট বিয়াল্লিশ বছরে ঐ জমিতে কোন পার্টির ফ্লাগ পোঁতা হয় নি! এটা কি বিশ্বাস করা যায়?”
পরানদা বললো-“তোমার বিশ্বাস না হয়, একদিন গিয়ে জায়গাটা এনকোয়ারী করে আসবে এবং আমাকে রিপোর্ট করবে। রিপোর্ট দেখে তখন শিবুর ব্যবস্থা নেওয়া হবে”। আমি আর কি করবো! হতোদ্দম হয়ে চেপে গেলাম।
শিবু আবার বলতে শুরু করলো। বললো-“আমরা সাত বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমার অপর ছয় বন্ধুর নাম হলো- রনদেব, সৌম্যদেব, তপন, সুভাষ, দেবাশীষ ও কুন্তল। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী হলো রনদেব বিশ্বাস। ওর বাপ একটা টাকার কুমীর। রনদেব বাপের একমাত্র ছেলে।ফলে ও দুহাতে টাকা ওড়ায়। আমরা সকলে ওর পয়সায় ষ্ফূর্তি করি। সুভাষ ধনীর ছেলে হিসাবে দ্বিতীয়। সেও বাপের একমাত্র ছেলে। কিন্তু বড্ড হিসেবী।অপ্রয়োজনে ও পয়সা খরচ করে না। ও বলে-অপ্রয়োজনে পয়সা খরচ করা ঠিক না”।
“একদিন বসন্তকালে আমরা সাত বন্ধু মিলে আমাদের মথুরাপুরের মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম।হাতে সিগারেট। সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে টান দিচ্ছি। তখন সবেমাত্র সূর্যিমামা পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে। দক্ষিন দিক থেকে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে।আমাদের মনটা পাগল হয়ে উঠেছে। এমন সময় একটি মেয়ে আমাদের সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়।আমরা  পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকাই। আমাদের কাছে সাইকেল ছিল।সুভাষ ছাড়ার পাত্র নয়। তারই উৎসাহে আমারা সাতজন সাইকেল নিয়ে মেয়েটাকে অনুসরণ করলাম। দেখলাম মেয়েটা আমাদের গ্রামের দিকে যাচ্ছে। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। এ মেয়ে তো আমাদের গ্রামের মেয়ে নয়!তাহলে গ্রামের কাদের বাড়িতে এলো!আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু আমরা তখনও তাকে অনুসরণ করে চলেছি।ওমা দেখি আমার বাড়ির দিকে যাচ্ছে! এবং সত্যি সত্যি আমার বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো। আমার বন্ধুরা বললো- সালা তোর বাড়িতে পাখি ঢুকছে! আর তুই চিনিস না?”আমি বললাম- না রে আমি সত্যি চিনি না। আমাদের বাড়িতে আগে এলে, আমি তাও আগে জানতাম। আচ্ছা আমার বাড়িতে তোরাও চল। কেসটা কি তোরাও জানবি”।
আমারা বাড়ি যেতেই দেখি মেয়েটা মায়ের সঙ্গে দিব্যি কথা বলছে রসিকতা করে। আমাকে দেখেই মা আমাকে ডেকে বললেন-“আয় শিবু, এই হচ্ছে নয়নতারা।তোর বিকাশ জ্যেঠু মেয়ে।কাল এসেছে। আজ আমাদের বাড়ি এলো”।
ও আমাকে দেখে হাসলো এবং তারপরে হাত জোড় করে নমস্কার করলো। আমিও প্রতি নমস্কার করলাম”। 
আমি বললাম-“ এই শিবু,তুই বললি ভূতের গল্প। এ তো দেখছি প্রেমের গল্প হয়ে যাচ্ছে রে। গল্পটা ঠিক ঠিক বানাতে পারছিসতো?”
আবার সেক্রেটারী পরাণদা বললো-“ তোর তাতে কি? গল্প শুনতে হয় শোনো, না হলে কেটে পড়ো। প্রত্যেকটা কাজে খুঁত ধরার তোর একটা স্বভাব হয়েছে”। অগত্যা আমি আবার চুপ হয়ে গেলাম। শিবু আবার তার গল্প বলতে শুরু করলো।
শিবু বললো-“আমাদের গ্রামের পশ্চিম পাড়ার বিকাশ জ্যেঠু ইঞ্জিনিয়ার মানুষ। আগে আমেরিকায় চাকুরী করতেন। সেখানে নাকি তাঁর মোটেই ভালো লাগে নি। তাই একমাত্র মেয়েকে নিয়ে স্বামি-স্ত্রী দেশে ফিরে বাঙ্গালোরে বসবাস করছেন।পাকুড়তলার পশ্চিম পাড়ায় তাদের বাড়ি।আমাদের বাড়ি পূর্ব পাড়ায়। আমার বাবা বিকাশ জ্যেঠুর বন্ধু।আমি যখন কলেজে গিয়েছিলাম, তখন নয়ন আর বিকাশ জ্যেঠু বাড়িতে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা হয় নি। তাই আমার সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছেন।এই শুনে আমার বুক ধক পক করতে শুরু করলো।সালা আমেরিকা ফেরতা মেয়ে বলে কথা। তাকে সামলানো চারটিখানি কথা নয়”।
শিবু বললো- “যাক, মেয়েটাকে আমি যতটা ভয় পেয়েছিলাম, মেয়েটা তত ভয়ের নয়। সে আমার সঙ্গে ও আমার বন্ধুদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেললো”।
আমি তখন বললাম-“কিন্তু শিবু, একটা হিসেব মিলছে না। তুই পাকুড়তলার পূর্ব পাড়ার লোক।তোর বিকাশ জ্যেঠু পাকুড়তলার পশ্চিম পাড়ার লোক। আর তোর বন্ধুরা কোন পাড়ার লোক? এত খ্যাতিমান তোর বিকাশ জ্যেঠুকে কি তারা আদৌ চেনে না!”
আমার ফোড়ন কাটা দেখে পরাণদা আবার বললো-“তোর ফোড়ন কাটার স্বভাব যাবে না দেখছি। তুই এমন ভাবছিস কেন? শিবুর ছয় বন্ধুর বাড়ি হয়তো পাকুড়তলার পূর্ব পাড়ায়। তারা হয়তো শিবুর বিকাশ জ্যেঠুকে চেনে। কিন্তু তাদের বাবার সঙ্গে বিকাশ জ্যেঠুর সখ্যতা ছিল না।সুতরাং নয়নতারার প্রয়োজন পড়ে নি শিবুর অন্যান্য বন্ধুদের চিনতে। তুই গল্প শুনছিস, না গোয়েন্দাগিরি করছিস”।
আমি আবারও চেপে গেলাম।পরানদার সাপোর্ট পেয়ে শিবু আবার গল্প শুরু করলো-“আমাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর মা বললেন-“শোন শিবু, নয়ন আসবে বলে তোর বিকাশ জ্যেঠুদের আজ রাতে এখানে খাওয়ার নিমন্ত্রন করা হয়েছে। তোর জ্যেঠু আর জ্যঠিটমা একটু পরে আসবে।তোর বাবা বাজারে গেছে। হাটবাজার আর খাসীর মাংস আনতে। তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললেন-তোমরা কেউ বাড়ি যাবে না এখন। সবাই এখানে খেয়ে তবে বাড়ি যেও”।
আমার বন্ধুরা সবাই খুশি। সবাই আহ্লাদে আটখানা। আমরা সবাই ঠিক করলাম- পাকুড়তলার ওই শ্মশানটার দিকে একটি ফাঁকা রাস্তা আছে। ওখানে আকাশের মিষ্টি চাঁদের আলোয় বেশ খানিকটা আড্ডা দেওয়া যায়।সৌম্যই প্রথম এই প্রস্তাব দেয়। সাইকেলে গেলে মিনিট চারেক লাগবে। যেখানে আড্ডা দেবো, সেই জায়গাটা থেকে শ্মশান প্রায় পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। সুতরাং দূর থেকে শ্মশানটার সৌন্দর্য দেখা যাবে। যেই না ভাবা, এমনি আমরা সাত বন্ধু মিলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খানিকটা যাওয়ার পর দেখি-নয়নতারা আমাদের পিছু নিয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। ও কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করলাম-কোথায় যাবে এদিকে? এটা শ্মশানে যাওয়ার পথ”।
নয়নতারা বললো-“তোমাদের সঙ্গে যাবো বলে এসেছি।কয়েকদিন পর তো আবার বাঙ্গালোর চলে যেতে হবে।তাই আমার গ্রামটাকে ঘুরে দেখে নিতে ইচ্ছে করছে। চলো তোমাদের সঙ্গে যাই”।শিবু বললো-“চলো তবে আমাদের সঙ্গে। তবে আমরা একটু আধটু সিগারেট খাবো। মাকে বলবে না কিন্তু”।
নয়নতারা বললো- “আমাকে শেয়ার করলে বলবো না”। আমরা হাসাহাসি করে সাইকেলে এগোতে লাগলাম।
আমি তখন শিবুকে বললাম-“সিনেমায় ‘একফুল দো মালি’র গল্প শুনেছি, কিন্তু ‘এক ফুল সাত মালি’র গল্প শুনিনি”।
পরাণদা আবার বললো-“তাহলে সে সাধ তোর আজ পূরণ হয়ে যাক। গল্পটা মন দিয়ে শুনে যা”।
এবার শিবু বললো- “আমরা শ্মশানটা থেকে বেশ খানিকটা দূরে বেশ চওড়া রাস্তার উপর আটজনে বসলাম। আমরা একেবারে খোলা মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি। সারা মাঠ রুপোলী আলোর বন্যায় প্লাবিত। দক্ষিন দিক থেকে ফুরফুরে হাওয়া বইছে। আকাশে সাদা সাদা মেঘ যেন পালতুলে ভেসে চলেছে। আমরা আটজনে চারখানা সিগারেট ধরালাম। সিগারেটে টান দিতে দিতে গল্প করতে লাগলাম”।
এমন সময় নয়নতারা বললো-“ওই জঙ্গলে ভরা জায়গাটি নাকি শ্মশান। খুব নাকি ভয়ঙ্কর!রাতের বেলা তো দুরের কথা,দিনের বেলা নাকি ওখানে লোক যেতে ভয় পায়। ওখানে নাকি শুধু ভুতের আড্ডা”।
আমাদের মধ্যে সকলে এই কথাটি স্বীকার করলেও তপন স্বীকার করলো না। সে বললো- “শ্মশান কখনো ভয়ঙ্কর হয় না।ভূত আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।আমার মনে হয় ঐ জায়গাটার নামে অনেকে নিশ্চয়ই বদনাম রটিয়েছে। যার ফলে ঐ জায়গাটার বদনাম হয়েছে”।
তখন নয়নতারা বললো-“শ্মশান ভয়ঙ্কর নয়, তার প্রমান দাও তপনদা। শুধু মুখে বললে তো হবে না”। নয়নতারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেশ আপন করে নিয়েছে। ফলে আপনি থেকে ‘দাদা’ আর ‘তুমিতে’ নেমেছে।
তখন তপন বললো- “কিভাবে আমি এর প্রমান দেবো বলো। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি শ্মশান কখনো ভয়ঙ্কর হয় না। আমি শ্মশানকে ভয়ও পাই না”।
নয়নতারা বললো- “তাহলে তোমাকে একখানা কাজ দিচ্ছি। সেটা করে দিলেই প্রমান হয়ে যাবে যে শ্মশান ভয়ঙ্কর নয়। এবং তুমিও শ্মশানকে ভয় পাও না”।
-“কি সেই কাজ?” তপন জিজ্ঞাসা করে।
-“তুমি শ্মশানে ঢুকে একজায়গায় একটি খোঁটা পুঁতে আসবে।কাল সকালবেলা আমরা সবাই একসঙ্গে দেখে আসবো সেই খোঁটা পোঁতা আছে কিনা। তাহলে তোমার কথা প্রমান হয়ে যাবে”।নয়নতারা কথাগুলো বললো।
-“যদি একাজ করতে পারি, তাহলে আমার কি ইনাম মিলবে?” তপন জিজ্ঞাসা করে।
“ইনামের প্রশ্ন আসছে কেন? তুমি তোমার কথার প্রমান দেওয়ার জন্য যাবে”। সৌম্য কথাগুলো বলে।
-“এই কাজ করতে পারলে নিশ্চয়ই ইনাম মিলবে। ইনাম ঘোষনা করা হবে কাজ শেষ করার পর”। নয়নতারা কথাগুলো বললো।
“মোটামুটি ঠিক হলো, তপন শ্মশানে খোঁটা পুঁততে যাবে।তপনের কথামতো প্যান্টশার্ট পরে শ্মশানে যাবে না বলে, তার জন্য একখানা লুঙ্গী, একখানা খোঁটা, একখানা মুগর আর একখানা টর্চলাইট আনা হলো।অবশ্য টর্চলাইট আনা হলো আমাদের জন্য। যদি তপন শ্মশানে গিয়ে কোন কারনে না ফেরে, তাহলে তাকে খুঁজতে যাওয়ার জন্য আমাদের কাছে একখানা টর্চলাইট থাকা দরকার”।
শিবু বলেই চললো- “তারপর এলো সেই মহেন্দ্রক্ষন। তপন লুঙ্গী আর গেঞ্জি  পরেছে।তার একহাতে খোঁটা আর অন্য হাতে মুগর। আমরা সবাই দেখছি তপনকে। ও সবেমাত্র মিলিটারীতে যোগ দিয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমরা সবাই কলেজে পড়লেও ও মিলিটারীতে চেষ্টা করেছিল। চাকুরিটা পেয়েও গেল। আমাদের মধ্যে ওই একমাত্র চাকুরীজীবী। একেবারে পেটাই চেহারা। তরতাজা ঘোড়ার মতো ও শ্মশানের দিকে এগিয়ে চললো এবং ক্রমশ শ্মশানের ছায়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমাদের মধ্যে সৌম্যর বয়স সবচেয়ে বেশী এবং বেশী বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ। সে বললো- চলো আমরা শ্মশানের দিকে এগিয়ে যাই। ও যদি খোঁটা পুঁতে ফিরে আসে , তো আসবে। কিন্তু কোন অঘটন যদি ঘটে যায়, তাহলে দায় এসে পড়বে আমাদের ঘাড়ে। সুতরাং একদম দেরী করা যাবে না। চলো এগিয়ে যাই।
“আমরা সবাই দলবেঁধে এগিয়ে গেলাম দ্রুত। শ্মশানের প্রায় কাছাকাছি গেছি, এমন সময় তপনের ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার শুনতে পেলাম।তারপর শুনতে পেলাম এক বিকট গোঁগানির শব্দ। ভয়ে আমাদের এমন হৃদকম্পন শুরু হয়েছে যেন হৃদপিন্ডটা ছিড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। এমন সময় হাওয়ার বেগ বেড়ে গিয়ে গাছের মাথাগুলো ভয়ঙ্করভাবে দুলছে। সৌম্য আর নয়নতারা ছাড়া আমরা কিছুতেই যেতে চাইছিলাম না শ্মশানের ভিতরে। সৌম্যই ধমক দিয়ে বললো- পাগল হয়েছিস, তপনকে বিপদে ফেলে পালানো যায়! ও মরলে আমরাও মরবো।আমরা এতজন একসঙ্গে গেলে ভূত বেচারা ভয়ে পালাবে। আমরা সৌম্যর পিছনে পিছনে শ্মশানের ভিতরে ঢুকলাম। টর্চলাইটের আলোয় তপনকে খুঁজতে লাগলাম। দেখলাম একদিকে তপন মাটিতে শুয়ে এক বিচ্ছিরি শব্দ করে গোঁগাচ্ছে। আমরা তাকে ধরাধরি করে তুলে আনতে যেতেই তপনের লুঙ্গী গেল খুলে।দেখলাম তপনের লুঙ্গীর একটা প্রান্ত খোঁটার সঙ্গে মাটিতে পোঁতা হয়ে গেছে। ভয়ে আমাদেরও আক্কেল গুড়ুম। কোনক্রমে খোঁটা তুলে লুঙ্গী খোঁটা থেকে খুলে তপনকে নিয়ে পালিয়ে এলাম।
“যেখানটায় আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম, সেখানে তপনকে আনা হলো। ততক্ষনে তপন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। আর আমাদেরও বোঝা হয়ে গেছে যে তপনের এই অবস্থা হওয়ার কারন। কারন হলো-তপন শ্মশানে ঢুকে তাড়াতাড়ি করে খোঁটা পূঁততে গিয়ে নিজের লুঙ্গীর উপর খোঁটা রেখে তা পুঁতে ফেলায়, খোঁটার সঙ্গে লুঙ্গীও মাটিতে পোঁতা হয়ে গেছে। তারপর যখন উঠতে গেছে খোঁটা তার লুঙ্গী ধরে টেনেছে।তপন ভেবেছে-লুঙ্গীখানা বোধহয় ভূতই ধরে টেনেছে।ফলে দশাসই মিলিটারী বডি ভূমিতে লোপাট। আমরা সবাই হেসে কুটোপাটি। এমন সময় সৌম্যই বললো-যাই বলো, তপনের কিন্তু নয়নের ঘোষনা করা ইনামটি প্রাপ্য”।
নয়নতারা তখন বললো- “নিশ্চয়ই তপনদা ঐ ইনামটি পাবেন। কিন্তু ঐ ইনামটি পেতে গেলে আর একটি শর্ত পূরন করতে হবে”।
-“কি শর্ত?” সৌম্য জিজ্ঞাসা করে।
-“তপনদা কি বিবাহিত?” এবার নয়নতারা জিজ্ঞাসা করে।
-“না। কিন্তু কেন!” তপন উত্তর দেয়।
-“তাহলে এই ইনাম তোমার প্রাপ্য”। এই বলে নয়ন আমাদের সকলের সামনে তপনের অবাক হওয়া চিবুকে একখানা মিষ্টি ‘কিস’ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ধরে। আমরা সবাই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।সেই প্রথম নয়নতারাকে ভালো করে অনুভব করলাম। ফর্সা, দীর্ঘদেহ, উন্নত কুচযুগল, নিতম্বিনী, মেঘকজ্জ্বল চিকুর, লাস্যময়ী নয়নতারা সত্যিই সুন্দরী।যেন ডানাকাটা একজন পরী।
শিবু গল্প শেষ করতেই, পরাণদা বললো- এটা ভূতের গল্প হলো না ছাই। এ তো পচে যাওয়া প্রেমের গল্প। তোর ফাইন হলো শিবু। আজ তড়কা রুটি হবে না। হবে ঘুগনি মুড়ি। তাও তোমার খরচে। একটা ফাউ গল্প বলার ফাইন।  অবশ্য একটা সুযোগ তোমাকে দিচ্ছি। খরচটা আজ আমি দিচ্ছি। পরে যদি আরও একখানা গল্প শুনিয়ে খুশি করতে পারো, তাহলে এই ফাইন মাপ।
এই হলো আমাদের পরাণদার স্বাভাব। সব সময় সবাইকে চাপে রাখে।
দেবনগর
০৮/০২/২০১৮






কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.