#বটুর_ভাগ্য

#গল্প

#বটুর_ভাগ্য

#তারাপদ_মাঝি




দীননাথ বাড়ি থেকে বেরতেই ছেলেটিকে দেখতে পায়। সে এক হাতে পলিতে করে খান তিনেক ইলিশ, আর অন্য হাতে একটি জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দীননাথ তাকে দেখে থমকে যায়। বটুকে সে মাপতে শুরু করে। প্রথমে তার জ্ঞান চক্ষু দিয়ে পরখ করে যে ছেলেটি কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত। সবকিছু পরখ করে দীননাথ অনুমান করে যে ছেলেটি দরিদ্র বাড়ির সন্তান। বিয়ে সাদি করেছে মনে হয়। ট্রলারে মাছ ধরতে যায় গভীর সমুদ্রে। এখন মনে হয় মাছ ধরে বাড়ি ফিরছে। তাই বাড়ির জন্য তিনখানা ইলিশ নিয়েছে। তবে ছেলেটি সুরাসক্ত নয়। সুরা পানে অভ্যস্ত হলে হাতে ইলিশমাছ থাকতো না। ওগুলো বেচে সুরা পসারে ঢুকতো।


দীননাথ পেশায় এল আই সি এর এজেন্ট। অত্যন্ত বুদ্ধিমান আর বিচক্ষন ব্যাক্তি। তিনি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দারিদ্রকে জয় করেছেন এবং এজেন্ডদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে সি এম ক্লাব মেম্বার হয়েছেন। কিন্তু এজেন্ডদের কখনো থেমে থাকতে নেই। থামলেই মৃত্যু নিশ্চিত। তাই দীননাথের অনিসন্ধিৎসু চোখ সর্বদা পলিসি হোল্ডার খোঁজার জন্য ব্যাকুল। সেই ব্যাকুলতায় ভর করে ভাবতে থাকে যে ছেলেটিকে দিয়ে একটি এল আই সি পলিসি করা যেতে পারে কি না।


ভাবনার সুত্রপাত হতেই দীননাথ একটুও দেরি না করে ছেলেটিকে ডাকে। বলে ও ভাই একটু শোন?

-কি বলছেন? ছেলেটি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে।

-তুমি এই ইলিশ কি দামে কিনলে?

-এই মাছ কেনা নয় দাদা। আমি ট্রলারে গিয়ে ছিলাম। পনের দিন পর আজ বাড়ি ফিরলাম। তাই ভাগের মাছ বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

- তাই? আমি ভাবলাম তুমি মাছ কিনে এনেছো। বাড়িতে কে কে আছে?

-আমার একটি বোন, বাবা- মা আর আমার স্ত্রী আছে।

-তোমার কোন ভাই নেই?

-আজ্ঞে না। আমি বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান।

-তাই? কিন্তু তুমি তো গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাও। গ্রহ বৈগুন্যে যদি তোমার নৌকাডুবি হয়, তাহলে তোমার বেঁচে ফেরা প্রায় অসম্ভব। তখন তোমার বাবা মা, বোন আর বউকে কে লালন পালন করবে সে কথা ভেবেছো কোনদিন?

-ছেলেটি বিশ্ময়ে অবাক হয়ে বললো- আজ্ঞে এরকম তো কোন দিন ভাবি নি।

-এবার ভাবো। আমি তো ভাবতে শিখিয়ে দিলাম।

-আজ্ঞে কি করতে পারি বলুন তো?

-করতে তো অনেক কিছু পারা যায়। কিন্তু করে ক'জনা!

-আমি করবো। কিন্তু কি করবো সেটা আমায় বলে দিন।

-আগে তুমি আমার বাড়তে এসো। 

ছেলেটি বাড়িতে এলে তাকে খুব যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে চা বিস্কুট দেওয়া হয়। তারপর দীননাথ জিজ্ঞাসা করে-তোমার নাম কি?

-আজ্ঞে বটুকেশ্বর বাগ।

-জমি জায়গা কত আছে? 

-আজ্ঞে খুবই সামান্য। বিঘা দু'য়েক চাষ জমি।

-তোমার এই সমস্যা থেকে মুক্তির একটাই পথ।

-কি সেই পথ?

-তুমি যদি বড় মতো এল আই সি পলিসি করো, তাহলে তুমি না থাকলেও তোমার পরিবারের ভরণ পোষনের কোন অভাব থাকবে না।

- বড় বলতে আপনি কত বড় বোঝাতে চাইছেন?

-তোমার বয়স কত?

-এখন পঁচিশ বছর।

-বাৎসরিক আয় কত?

-আজ্ঞে তা প্রায় ৪-৫ লাখ টাকার মতো।

-দীননাথ আঁতকে উঠে বলে-কি করে আয় করো এত টাকা!

-আজ্ঞে ট্রলারের সিজিনে কম বেশি দুই লাখ। আর সবজি সিজনে ঝিঙা, পটল আর উচ্ছে চাষ করে পাই ৩-৪ লাখ টাকা। সুতরাং ৪-৫ লাখ আয় করা এমন কোন ব্যাপার নয়।

-তুমি বছরে কত টাকা জমাতে পারবে?

-ধরুন এক লাখ টাকা।

-তুমি যদি বছরে এক লাখ টাকার প্রিমিয়ামে তিরিশ বছরের জন্য একটি পলিসি করো, তাহলে তোমার আর কোন চিন্তা থাকবে না। 

-কিন্তু এক সঙ্গে এক লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। 

-এক কালিন এক লাখ টাকা দিতে হবে না। তিন মাস অন্তর পঁচিশ হাজার টাকা করে দিলে হবে।

-এটা সম্ভব। কিন্তু এই পলিসিতে আমার লাভ কি?

-প্রচুর লাভ। এই পলিসি তুমি তিরিশ বছর চালালে ম্যাচুরিটিতে প্রায় ষাট লাখ টাকা পাবে। আবার এই পলিসির একটি প্রমিয়াম দিয়েও যদি পটল তোল, তাহলে তোমার নমিনি পাবে তিরিশ লক্ষ টাকা। তবে এর একটি খারাপ দিক আছে। তা হলো তোমাকে অন্তত পক্ষে তিন বছর ধরে এই পলিসি চালাতে হবে। অর্থাৎ যদি তুমি একবছর পলিসি চালানোর পর আর পলিসি চালাতে পারলে না এবং মরলে না, তাহলে তোমার জমানো টাকা তুমি ফেরত পাবে না। 


সব কিছু বুঝে বটু বললো- তাহলে আমি একটি তিরিশ লক্ষ টাকার পলিসি করবো।

-তুমি ঠিক ভেবে বলছো তো?

-আজ্ঞে আমি বেশ ভালো করে ভেবেই বলছি।

-তাহলে বাড়ি থেকে তোমার ভোটের কার্ড আর আধার কার্ড আনো।

-আজ্ঞে আমার কাছে সবই আছে। আপনি এখুনি পলিসি করতে পারেন।

দীননাথ আর দেরি না করে মাছকে তাড়াতাড়ি ছিপে গাঁথার চেষ্টা করলো। তাড়াতাড়ি করে পলিসির ফর্ম ভরে নিল এবং পলিসির প্রথম প্রিমিয়াম পঁচিশ হাজার টাকা নিল। সঙ্গে সঙ্গে বটুকে দিল প্রথম প্রিমিয়ামের রসিদ, একটি বেষ্ট কোয়ালিটির ফাইল, একটি ডায়ারী এবং একটি সুন্দর কলম। বটুকে আর একবার আদর করে চা খাওয়ালো এবং বটুর আনা ইলিশ মাছ যাতে পচে না যায়, তার জন্য ফ্রিজ থেকে বরফ এনে মাছে ছড়িয়ে দিল।


বটু বাড়ি যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর বটুর স্ত্রী এলো দীননাথের বাড়ি। দীননাথকে সামনে পেয়ে বটুর বউ জিজ্ঞাসা করলো -আমার কর্তাকে দিয়ে আপনি এল আই সি পলিসি করিয়েছেন?

-আপনার কর্তা কে মা?

-ঐ যে সকালে এসেছিল।

-কে, বটু?

-আজ্ঞে হ্যাঁ।

-ও পলিসি করতে চাইলে আমি করে দিয়েছি। তাতে অসুবিধা কি হয়েছে! সে তো তোমাদের কথা ভেবেই এই পলিসি করেছে।

-অত ভাবতে হবে না। উনি পলিসি করবে না। আপনি টাকা ফেরত দিন।

-টাকা তো আর ফেরত হবে না মা। টাকা এল আই সি তে জমা পড়ে গেছে। রসিদও আমি তোমার স্বামীকে দিয়ে দিয়েছি।সুতরাং টাকা ফেরত দেওয়া অসম্ভব।

এবার বটুর বউ রনমূর্তি ধারণ করলো। বিভিন্ন রকম গালি গালাজ দিয়ে লোক জড়ো করতে লাগলো। সে জড়ো হওয়া সবাইকে বোঝাতে চাইলো যে তার স্বামী ট্রলারে গিয়ে ষাট সত্তর হাজার টাকা রোজগার করেছিল। এই টাকা দিয়ে সে কিছু গহনা গড়াত। কিন্তু দীননাথবাবু তাকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে এল আই সি পলিসি করিয়েছে! ঐ টাকা আর ঘরে ফিরবে না বলে তার ধারণা।  এই রকম দজ্জাল বউকে নিয়ে যে কিভাব ঘর করে বটু তাই ভেবে পান না।


এমন সময় বটু পৌছে যায়। সে তার বউকে শাসন করে বাড়ি নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় বউয়ের পাগলামীর জন্য দীননাথের কাছে ক্ষমা চাইল।


এই ঘটনার বছর উত্তীর্ণ হওয়ার পর আবার এলো ইলিশের সিজিন। বটুও গেল ট্রলারে মাছ ধরতে।  নামখানার ট্রলার। ট্রলারের নাম -"মা করুণাময়ী"।


হঠাৎ একদিন ঝড় এলো। ঝড়ের পুর্বাভাস পেয়ে সব ট্রলার ফিরে এলেও মা করুণাময়ী ফিরে এলো না। তারা এতটাই দূরে চলে গিয়েছিল যে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না ফলে ঝড়ের মুখে পড়ে নৌকা গেল উলটে। ঝড়ের তান্ডবে কে যে কোথায় গেল, তার কোন হদিস পাওয়া গেল না। 


ঝড় বন্ধ হতে কোষ্টাল গার্ডের লোকেরা মা করুনাময়ীকে খুঁজে পেল। উলটানো নোকা সোজা করতেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো সাত জনের লাস। তার মধ্যে বটুর লাসও আছে। বাকী আটজনের কোন হদিস পাওয়া গেল না।


লাস বাড়িতে আসতেই বটুর পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়লো। তার পরিবারের একমাত্র অন্ধের যষ্টি আর নেই। বটুর বউ সবেমাত্র পোয়াতি। সে ক্ষনে ক্ষনে মুর্ছা যাচ্ছে। এজেন্ট দীননাথবাবুর কানেও বটুর মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর গেছে। বটুর কাজকর্ম শেষ হলে দীননাথবাবু একদিন গেলেন বটুর বাড়ি।


দীননাথবাবুকে দেখেই বটুর বউ হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করে। দীননাথবাবু তাকে শান্তনা দিয়ে বলে -কেঁদে নিজেকে দুর্বল করো না মা। কি হবে আর তার জন্য কেঁদে! সে তো আর ফিরে আসবে না! বরং ঠাকুরের কাছে কামনা করো তার আত্মার যেন মুক্তি ঘটে। আর তোমাদের কোন আর্থিক চিন্তার কারণ নেই। বটু তোমাদের জন্য যে ব্যবস্থা করে গেছে, তাতে তোমাদের হেঁসে খেলে দিন কেটে যাবে।


-সে তো মাত্র এক লাখ টাকা! এই টাকাই তো জমেছে!এই টাকাতে আর ক'দিন চলবে বাবা!বটুর বাবা বললে কথাটা।

-না বাবু, আপনি জানেন না। ও তিরিশ লক্ষ টাকার পলিসি করেছিল। পলিসটি এমন যে টাকা যাই জমুক না কেন, স্বাভাবিক ভাবে মরলে পাবে তিরিশ লক্ষ টাকা। কিন্তু অপঘাতে মরলে পাবে ষাট লক্ষ টাকা। বটু অপঘাতে মরেছে। তাই ওর নমিনি অর্থাৎ আপনি পাবেন ষাট লক্ষ টাকা। আপনাকে এর জন্য কিছু কাগজপত্র দিতে হবে। এই কাগজপত্র জমা দিলেই আপনি এক মাসের ভিতর পেয়ে যাবেন ষাট লক্ষ টাকা। তারপর দীননাথবাবু কি কি কাগজ লাগবে তা বটুর বাবাকে বুঝিয়ে বললো।


দীননাথবাবু বটুর বাড়ি থেকে বের হবেন, এমন সময় বটুর বউ দীননাথবাবুর পা জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। বলে- সেদিন আপনাকে গালাগাল দিয়ে অন্যায় করেছি। আমায় ক্ষমা করুন।

-দীননাথবাবু তাকে নিরস্ত করে বললেন-মা তুমি ছেলে মানুষ। বোধ বুদ্ধি হয় নি। কোন মানুষের পলিসি দরকার, আর কার দরকার নেই সেটা আমি ছাড়া আর কেউ ভালো বুঝবে না। বটুর একটি পলিসি দরকার ছিল। তাই তাকে দিয়ে একটি পলিসি করিয়েছিলাম। এখন সেটা কাজে লেগেছে দেখলে তো! আর যাই ভাবো, আমাকে অন্তত চিটিংবাজ ভাববে না।


বটুর মৃত্যুর দুঃখ খুব তাড়াতাড়ি তার পরিবার থেকে গায়েব হয়ে গেল। আর এর জন্য দায়ী প্রচুর অর্থ প্রাপ্তি। বটুর পরিবার এল আই সি থেকে পেয়েছিল ষাট লক্ষ টাকা এবং সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছিল কুড়ি লক্ষ টাকা। বটুর পরিবার এখন আশি লক্ষ টাকা পেয়ে গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবার।

( এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোন অস্তীত্ব নেই। কারুর সঙ্গে এই গল্পের কাহিনী মিলে গেলে তা নেহাতই কাকতালীয় বলে জানবেন)


কপিরাইট @ তারাপদ মাঝি

২৫/১১/২০২১

দেবনগর।










কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.