#স্বীকারোক্তি

রতনলাল চৌধুরী অত্যন্ত ধনী ব্যাক্তি।তার সরকারী চাকরী ছাড়াও দু'টো কাপড়ের দোকান আর একটি ওষুধের দোকান রয়েছে। এছাড়া রেল স্টেশনের কাছে প্রায় বিঘা পাঁচেক জমি রয়েছে যার বর্তমান বাজার মুল্য আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা। তাই রতনলালকে সবাই শ্রদ্ধা ভক্তি করে। নিশ্চিন্তপুর গ্রামে রতনলালের মতো ধনী ব্যক্তি একেবারে অদ্বিতীয়। কিন্তু এই লোকের একটি বদ অভ্যাস বা খারাপ গুন হলো তার কৃপণতা। এমন কৃপণ ব্যক্তি নিশ্চিন্তপুরে অদ্বিতীয়। ভিক্ষা, ক্লাবের চাঁদা, পিতৃ-মাতৃ দায়ের জন্য ভিক্ষা, বিভিন্ন পুজোর চাঁদা বা অন্য যে কোন কাজের চাঁদাই হোক না কেন, কিছুতেই রতনলালের নিকট থেকে দশ টাকার বেশী আদায় যায়নি। এক্ষেত্রে আপনাকে না। এসব ব্যাপারে রতনলালবাবুর সাফ কথা-“ আমার যা চাঁদা দেওয়ার ক্ষমতা, আমি তাই দেব। তার বেশী চাইলে আমি দেবো কোত্থেকে! এতে বাপু তোমাদের পোষায় নাও, না হলে চাঁদা নিও না”।
পাড়ার লোকেরা বিশেষ করে দূর্গা পূজা কমিটির লোকেরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল। তারা রতনলালবাবুর বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারেন না। কারণ তিনি যেমন বিশেষ ধনী ব্যক্তি আবার পার্টির লোকাল কমিটির সেক্রেটারি। কিছু বলতে গেলে পার্টির ছেলেদের লেলিয়ে দিয়ে ব্যক্তিগত জীবন আর পূজা কমিটিকে বেকায়দায় ফেলে দিতে পারেন। তাই সকলে চুপ থাকেন।কিন্তু পূজা কমিটির অনিশরঞ্জনবাবু একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিলেন। তিনি রতনলালবাবুর তিন পুত্রকে টার্গেট করলেন। তার তিন ছেলে অমল, বিমল ও কমলকে পূজা কমিটির ক্লাবে সদস্য করে নিলেন। উদ্দেশ্য সদস্য হিসাবে কিছু চাঁদা তিন ছেলের থেকে বাগানো যেতে পারে বিশেষত তাদের যখন নিজস্ব ব্যবসা পাতি আছে। অনিশরঞ্জনবাবুর এই প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়েছিল।
রতনলালবাবু অত্যন্ত চরিত্রবান ব্যক্তি অন্তত এখনো পর্যন্ত সকলে তাই জানে।তিনি কখনো কারও সঙ্গে কোনদিন খারাপ আচরন করেন নি। শুধুমাত্র অহেতুক তার কাছ থেকে টাকার দাবি করলে তিনি তখনই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন এবং তখনই কেবলমাত্র তার মুখ হতে রুঢ়শব্দ নিঃশ্বারিত হয়। বাকি সময় তিনি নিপাট ভদ্রলোক। পার্টির লোকাল কমিটির সেক্রেটারি বলে সকলে তাকে ভয় করে চলতো। কিন্তু তাকে কোন দিন কারও বিরুদ্ধে খারাপ পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় নি। তিনি শুধু বলতেন-“আমি ভালো মানুষ। আমি কারও বিরুদ্ধে কোন রকম খারাপ ব্যবহার করবো না। কিন্তু কেউ যদি আমার ক্ষতি করে তাহলে তাকে কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না”। এই কথা টুকুতেই কাজ হতো।
পার্টি রতনলালবাবুকে বেশ ভালো বাসতেন। কারন রতনলালবাবু সৎ এবং চরিত্রবান ব্যক্তি।সেই ইমেজ ভাঙিয়ে ভোটের ফায়দা তোলা যায়। আবার টাকার কুমির হওয়ায় পার্টির কাজে টাকার যোগান পাওয়া যায়। পরে অবশ্য পার্টির চাঁদা থেকে সে টাকার পাই পয়সাও তিনি উসুল করে নেন। এছাড়া এখনো পর্যন্ত উনার বিরুদ্ধে স্বজন পোষন, পরের ধনে পোদ্দারি বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তাই এরকম লোক অবশ্যই পার্টির কাজে আসে।তবে এটাও স্বীকার্য যে রতনলালবাবু পার্টিকে অত্যন্ত ভালবাসেন।
যখন অমলের আট, বিমলের পাঁচ এবং কমলের দু ‘বছর বয়স, তখন রতনলালবাবুর স্ত্রী মারা যান। রতনলালবাবু চরিত্রবান মানুষ হওয়ায় তিনি আর বিয়ে করেন নি। তবুও তিনি তার তিন ছেলেকে সু শিক্ষিত করে তুললেন। প্রত্যেকটি ছেলেকে গ্র‍্যাজুয়েশন করিয়েছেন। গ্র‍্যাজুয়েশন করানোর পর বড় ছেলে অমলকে ও মেজছেলে বিমলকে কাপড়ের বড় দোকান করে দিয়েছেন। তারা যথারীতি বড় ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। ছোট ছেলে কমল সায়েন্স নিয়ে গ্র‍্যাজুয়েশন করায়, তাকে ওষুধের দোকান করে দিয়েছেন। তার দোকানও নিশ্চিন্তপুর মার্কেটে একমাত্র বড় ওষুধের দোকান। লোকে বলে যে –“যে ওষুধ কমলের ওষুধ দোকানে পাওয়া যাবে না, তা কলকাতাতেও পাওয়া যাবে না”। ফলে রতনলালবাবুর আর কোন চিন্তাই নাই। তিনি প্রাইমারি টিচারের চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর একেবারে সংসারটা ছেলেদের হাতে ছেড়ে দিয়ে পার্টির কাজে মন দিলেন। অবশ্য ইতিমধ্যে সব ছেলেদের বিয়ে করিয়েছেন।
প্রায় সত্তর বছর বয়সে রতনলালবাবু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেলেরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনেক ডাক্তার বদ্যি দেখালেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। শেষে ভেল্লোর থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনলেন। তবুও রতনলালবাবুর কোন উন্নতি হলো না। এবার রতনলালবাবু একেবারে চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেললেন। বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে যন্ত্রনায় তার জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। ছেলেরা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন টাকা থেকে যদি বাবার চিকিৎসা করাতে না পারি, তাহলে সে টাকার কি প্রয়োজন। তিন ছেলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলো যে তারা বাবার চিকিৎসার জন্য তাকে আমেরিকা নিয়ে যাবেন। কিন্তু এই কথা রতনলালবাবুর কানে উঠতেই তিনি তিন ছেলেকে কাছে ডাকলেন। বললেন-“মানুষ জীবন নশ্বর। জন্মালে একদিন মরতে হবে। আমার পুর্ব পুরুষরা মরেছে। তাই আমাকেও মরতে হবে। তোমরা আমাকে যথেষ্ট চিকিৎসা করিয়েছো।তোমাদের প্রতি আমি অত্যন্ত খুশি। কিন্তু তোমরা যে আমাকে চিকিৎসার জন্য আমেরিকা নিয়ে যাবে, এটা আমি মানছি না বা যাচ্ছি না। আমার শরীর দুর্বল। কিন্তু মস্তিস্ক এখনো সাবলীল ও স্বতষ্ফুর্ত। সুতরাং আমি রোগের প্রকোপে তোমাদের ভুলভাল বলছি না। যথেষ্ট চিন্তা করেই বলছি।তাছাড়া আমি আমেরিকায় গিয়ে যদি মারা যাই, তাহলে তোমরা আমাকে না এনে যদি ওখানেই রেখে আসো তাহলে আমার আত্মা অনেক কষ্ট পাবে। তাই আমি মৃত্যুকালে আমার দেশেই থাকতে চাই।বলা বাহুল্য যে রতনলালবাবুর বিরুদ্ধে কথা বলার মতো দৃঢ় মেরুদন্ড ছেলেদের ছিল না। তাই তারা তাদের বাবার যুক্তি মেনে আমেরিকা গমনের আশা থেকে বিরত থাকলো।
অশোক মুখোপাধ্যায় নিশ্চিন্তপুরের একজন খ্যাতনামা নিষ্ঠাবান ব্রাম্ভন। গ্রামের সবাই তাঁকে মেনে চলেন। সবাই বিশ্বাস করেন যে অশোকবাবুর মতো নিষ্ঠাবান ব্রাম্ভন এযুগে পাওয়া খুবই মুসকিল। বয়সে তিনি রতনলালবাবুর চেয়ে বড়। কিন্তু এখনো শরীরখানা একেবারে ঋজু। হাঁটাতে তিনি এখনো যে কোন যুবককেও টেক্কা দিতে পারেন। সেই অশোকবাবু বৃহষ্পতিবার এলেন রতনলালবাবুর বাড়িতে পূজো করতে। তিনি রতনলালবাবুকে দেখে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন। তারপর রতনলালবাবুর বড় ছেলেকে বললেন-“বাবা অমল, তোমায় একটি কথা বলি শোন। তোমার বাবা যেভাবে অসুস্থ, তাতে তিনি আর সেরে উঠবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু এরকম কষ্ট তো আর সহ্য করা যায় না! তোমার মা বেঁচে থাকলে না হয় রতনলালের সেবা শুশ্রূষা করতেন। কিন্তু তিনি তো নেই। তোমারা কাজের লোক দিয়ে বাবার সেবা যত্ন করছো। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। কিন্তু মানুষটা তো বেশ কষ্ট পাচ্ছে? সে সম্বন্ধে কিছু ভেবেছো?
-কি ভাবার আছে জ্যাঠামশাই? আমরা তো সব রকম চেষ্টা করেছি! কিছুতেই কিছু হলো না যে? অমল কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে।
-আরে চিকিৎসার কথা বলছি না! চিকিৎসা করিয়েও আর লাভ নেই। আমি অন্য কথা বলছি।
-কি কথা জ্যাঠামশাই?
-বলছি রতনলাল এ জন্মে হয়তো কোন পাপ করে নি। কিন্তু গত জন্মের পাপেও এ জন্মের শাস্তি হতে পারে। তাই হয়তো রতনলাল এমন ভুগছে!
-তাহলে কি করার আছে জ্যাঠামশাই?
-শাস্ত্রে আছে যদি কেউ মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকে, যদি কোন চিকিৎসাই কার্যকর না হয়, তাহলে তাকে রোগ প্রায়শ্চিত্ত বা শান্তি স্বস্তয়ন করাতে হয়। রোগ প্রায়শ্চিত্য করালে রোগভোগ থেকে মুক্তি পাবে এবং শান্তি স্বস্তয়ন করালে অচিরেই স্বর্গের পথে গমন করবেন। তোমার বাবার অবস্থা বিবেচনা করে আমার মনে হয় ওকে শান্তি স্বস্তয়ন করে দেওয়া উচিত।
রতনলালের ছেলেরা ঠাকুর মহাশয়ের পরামর্শের কি উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছিল না। প্রথমত ছেলেরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তারা ঠাকুরের এই বিধানকে মেনে নিতে পারছে না।আবার ঠাকুর মহাশয়ের বিরুদ্ধাচরণও করতে পারছে না। আবার রতনলালের শরীর অবশ হলে কি হবে মগজ এখনো সতেজ এবং ক্ষুরধার। এখনো তিনি পার্টির পরামর্শ দাতা। তিনি ঠাকুর মহাশয়ের এই বিধান মানবেন কি না সেটাও এক সমস্যা!
কিন্তু এই সমস্যার সমাধান করে দিলেন রতনলালবাবু। তিনি ছেলেদের জানিয়ে দিলেন যে তিনি শান্তি স্বস্তয়নে রাজি আছেন। সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঠাকুরমশাই আগামী ফাল্গুন মাসের পঞ্চম দিবসে কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে মহেন্দ্র ক্ষনে এই শুভ কাজটি সমাপন করবেন বলে জানালেন এবং প্রায়শ্চিত্যের ফর্দ করে দিলেন।
ঠাকুর মশায়ের ফর্দ অনুযায়ী অমল সমস্ত আয়োজন করেছেন।সেই সঙ্গে সমস্ত আত্মীয় স্বজনদের ডাকা হয়েছে। প্রথমে নাপিত এসে রতনলালের মস্তক মুন্ডন ও অন্যান্য ক্ষৌরকর্ম করালেন। তারপর রতনলালকে স্নান করিয়ে নতুন বস্ত্র পরালেন। এবার শুরু হলো মুল কাজের আয়োজন।অমল বাবাকে কোলে নিয়ে বসলো।রতনলাল ষ্পষ্টভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করতে লাগলেন। হোমের আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়া হচ্ছে আর তার লেলিহান শিখা গৃহের পরিবেশকে গুমোট করে তুলছে।একের পর এক প্রায়শ্চিত্যের সকল কর্ম শেষ হলো।
শেষ কর্ম হলো গো-ঘাস করানো। কোন কোন অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে প্রায়শ্চিত্যের এই রীতিটি আজও প্রচলিত।খ্রীষ্টানরা ভগবান যিশুর কাছে গিয়ে জীবনের সমূহ পাপকর্ম স্বীকার করেন এবং যিশুর কাছে কৃত কর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তখন তার সব অপরাধ মার্জনা করা হয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। হিন্দুদের গো-ঘাস সেই রকমই একটি পদ্ধতি।ফারাক একটাই- তা হলো খ্রীষ্টানরা স্বতঃষ্ফুর্তভাবে পাপ স্বীকার করে।কিন্তু হিন্দুরা বাধ্য হয়ে পাপ স্বীকার করে।তাই প্রায়শ্চিত্যের এই পর্বের নাম গো-ঘাস পর্ব বা স্বীকারোক্তি পর্ব।
গো-ঘাসের জন্য অন্য একটি পরিবারের থেকে বেশ সুন্দর একটি গাভি আনা হয়েছে। আর আনা হয়েছে কিছু সবুজ সতেজ একেবারে তাজা দূর্বা ঘাস।ঠাকুর মশাই উঠানে এসে দাঁড়ালেন। উঠানে রতনলালকে অমল কোলে করে আনলেন এবং সুন্দর গাভিটির পদমুলের কাছে বসলেন। ঠাকুরমশাই অনেক কষ্টে রতনলালকে দিয়ে হলুদ জলে গাভিটির পা ধুইয়ে দিলেন। তারপর তার মাথায় সেই তাজা ঘাস ভর্তি কাঁসার থালাটি বসিয়ে দিলেন। রতনলাল যদি নিষ্পাপ হন তাহলে গাভীটি রতনলালের মাথায় রাখা কাঁসার থালার সবুজ তাজা ঘাসগুলো খেতে থাকবে। কিন্তু যদি কিছু গড়বড় থাকে তাহলে গাভি কিছুতেই ঘাস খাবে না। তখন প্রায়শ্চিত্যকারীকে তার সমূহ পাপ স্বীকার করতে হয় সকলের সম্মুখে শ্রবনযোগ্য শব্দে।রতনলালের ক্ষেত্রে ঘাসের থালাটি গরুটির সম্মুখে দেওয়া সত্বেও গরুটি ঘাস থেকে মুখ সরিয়ে নিলেন। সকলে প্রমাদ গুনলেন। সুস্থ মস্তিষ্কের রতনলালও হতচকিত হয়ে খানিকটা অশ্রুসিক্ত নেত্রে গরুটির দিকে তাকালেন। তারপর তিনি ঠাকুর মশাইকে বললেন-“আমি আমার দ্বারা কৃত পাপকর্মের কথা স্বীকার করতে চাই।তোমরা সবাই আমার কাছে এসো। আমার জোরে বলার ক্ষমতা নেই। তাই আমার কাছাকাছি সবাই এসো”।
সবাই অর্থাৎ আত্মীয় স্বজন এবং কিছু পাড়া প্রতিবেশী আর কিছু শুভানুধ্যায়ী ব্যাক্তিরা রতললাল আর গরুটিকে পরিবেষ্টন করে দাঁড়ালো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে এত লোকের মাঝে গরুটি কিছুতেই ভয় ভীত হলো না। এবার রতনলাল তার পাপকর্মের হিসাব দিতে লাগলেন। তিনি বললেন- “আমি জীবনে অনেক মিথ্যা কথা বলেছি। মিথ্যা কথা বলে অনেক সুবিধা নিয়েছি। চুরি করে পরীক্ষায় পাশ করেছি। শিক্ষকতা করার সময় স্কুল ফান্ডের অনেক টাকা চুরি করেছি। ছাত্রদের খাতা কাটার সময় গরীব বাড়ির ছেলেদের ইচ্ছা করে ফেল করিয়ে দিয়েছি। পার্টির কাজে যুক্ত হওয়ার পর আমার প্রতিদ্বন্দ্বিকে লোক লাগিয়ে গুপ্ত হত্যা করিয়েছি এবং আমার প্রভাব খাটিয়ে হত্যার তদন্তে বাধা দিয়েছি। নিজেকে আর হত্যাকারীদের রক্ষা করেছি।পার্টির সংগ্রহকৃত কিছু টাকা আত্মসাৎ করেছি। এছাড়া আরও কিছু খারাপ কাজ করেছি যা এখন আমার মনে নেই।
কিন্তু এতেও গরু ঘাস খেলো না। ঠাকুরমশাইও খুব বিপদে পড়লেন। এই কাজ সমাপ্ত না হলে কিছুতেই তিনি এখান থেকে পরিত্রান পাবেন না। তিনিও বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি রতনলালকে বললেন-“রতন, আর কি কি খারাপ কাজ করেছো স্বীকার করে নাও। না হলে তুমি খুব যন্ত্রনা পাবে। এমন সময় উপস্থিত হিতাকাঙখীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। কেউ বললো –“এটা মধ্যযুগীয় প্রথা এবং বর্বরতা। এসবের কোন বিশ্বাস যোগ্য ভিত্তি নাই। অমলদের এসব করা ঠিক হয় নি”। আবার এর উত্তরে অন্যজন বললো-“এটা মধ্যযুগীয় বর্বরতা কেন হবে! আমরা তো সবাই জানতাম যে রতনবাবু নিপাট ভদ্রলোক। এখন দেখছি নিপাট অসৎ লোক। এতো দেখছি কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়েছে!” এই নিয়ে জমায়েত মানুষের মধ্যে হই হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। এমন সময় রতনলালের ছোট ছেলে কমল বললেন-“নিকুচি করেছে প্রায়শ্চিত্য। এসব আর করার দরকার নেই। বাবা অসুস্থ অবস্থায় ভুল ভাল বলে যাচ্ছেন। এসব কি সত্যি বলে মনে হয়”। কমলের সার্পোট পেয়ে অমল তারা বাবাকে তুলে নিয়ে বাড়ির ভিতর যেতে উদ্যত হ’তেই ঠাকুর মশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন-“ প্রায়শ্চিত্যের সব বিধানগুলো যদি না মানবে, তাহলে তোমরা আগেই বলতে পারতে! এই অসমাপ্ত কাজ ফেলে আমি চলে গেলে আমাকে নরক গামী হতে হবে। আর আমাকে যদি অকারনে নরকগামী হতে হয়, তাহলে আমিও তোমাদের অভিশাপ দিয়ে যাবো। ব্রাম্ভনের অভিশাপের ভয়ে ভীত রতনলাল বললেন-“অভিশাপ দিও না ঠাকুর মশাই। আমি আমার বাকি পাপের কথা স্বীকার করছি। এদিকে তিন ছেলে অত্যন্ত বিচলিত হলেন।যে কাজগুলো বাবা স্বীকার করেছেন, তা কম নয়।না জানি আরও কত পাপ লুকিয়ে রেখেছেন!
রতনলাল আবার বলতে শুরু করলেন-“আমার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমার একমাত্র শালীর জোর জুরিতেই তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হই। বছর দুই এভাবে চলার পর আমার স্ত্রী ব্যাপারটা জেনে ফেলে এবং আমার শ্বশুর মশাইকে বা ভাইরা ভাইকে জানালে আমার মান সম্মানের ভয়ে স্ত্রীকে খুন করি এবং নিজের প্রভাব খাটিয়ে এই খুন থেকেও রেহাই পাই।এর পরে আমার শালী আমার সঙ্গে ব্ল্যাক মেল করতে শুরু করলে তাকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেই এবং একইভাবে রেহাই পেয়ে যাই। এছাড়া আমি আর কোন পাপ কাজ করিনি।
এবার গরুটি সামনের একটি পা রতনলালের বুকে ঘসতে লাগলো। পুরুতমশাই বললেন-আর সামান্য কিছু খুচরো পাপ বাকি রয়েছে রতন। ঐগুলি স্বীকার করে নাও রতন।আর আমাদের কষ্ট দিও না।
-“আমি আর কোন পাপ করিনি ঠাকুর। যা করেছি তা তো সকলের সামনে স্বীকার করলাম।আর আমার কিছুই মনে পড়ছে না”
-“আছে রতন, আরও কিছু খুচরো পাপ রয়ে গেছে। তাই গরু তোমার হৃদয় আঘাত করছে। তুমি মনে করার চেষ্টা কর”।
রতনলাল বেশ কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন। বললেন-“ আমি স্ত্রী আর শালীকে হারিয়ে একেবারে একা হয়ে যাই। আমি পুনরায় বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে বড় ছেলে অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। লোক লজ্জার ভয়ে আমি আর বিয়ে করতে পারি না। কিন্তু কামনার আগুন আমার শরীর থেকে যায় নি। এর জন্য আমার শালী সবচেয়ে বেশী দায়ী। কিন্তু সে যাই হোক, এই ব্যার্থ কামনা যদি পাপ হয় তাহলে আমি আরও অনেক পাপ করেছি। কারন পাড়ার অনেক যৌবনবতীকে দেখে তাকে মনে মনে কামনা করেছি। তাকে মনে মনে বিছানায় পেতে চেয়েছি। এটা যদি পাপ হয়, তাহলে আমি মহাপাপী”।
রতনলালের একথা বলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গরু তার মাথার কাঁসার থালায় রাখা ঘাস খেতে লাগলো। সবাই বুঝলেন নিরীহ শান্ত অথচ শয়তান রতনলাল যে পাপের ষোলো কলা পূর্ন করে ফেলেছেন তা আর কারও বুঝতে বাকী রইলো না।দীঘির জল যতই শান্ত হোক, তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করা উচিত নয়। কারণ তার গর্ভে কতই যে ভয়ংকর প্রাণী বাস করে কে জানে।তাই সকলে অবাক বিশ্ময়ে শান্ত অথচ এক ভয়ংকর দানবকে দেখতে লাগলেন।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
২৯/০৪/২০১৯
দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.