#ভাদ্র_মাসের_ ব্রতকথা

[লেখকের গৌরচদ্রিকাঃ-বাংলার সামাজিক পট পরিবর্তন হয়েছে। সাবেক বাংলা আর বর্তমান বাংলার সঙ্গে আকাশ পাতাল ফারাক। স্বাভাবিকভাবে তার সামাজিক পরিবর্তনের আধুনিকীকরণ হয়েছে।কিন্তু যতই পরিবর্তন হোক, প্রাচীন প্রথা, আচার, নিয়ম-নীতি এবং কিছু বিশেষ আচার অনুষ্ঠান এখনো বাংলার ঘরে ঘরে বিরাজমান। সেই আচার অনুষ্ঠানগুলো এখনো বাঙালী ভুলে যায় নি বা ভুলতে চায় নি। যেমন বাংলার লক্ষ্মীপূজো এবং তার ব্রতকথা। এখনো বাঙালীর ঘরে ঘরে খুঁজলে কোন না কোন বাড়িতে লক্ষ্মী চরিত্র বইখানি খুঁজে পাওয়া যাবে।
আমি আজ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ। ফলে একেবারে বিছানা বন্দী। বই বাড়িতে যা ছিল, সব শেষ করে ফেললাম। কিন্তু রোগ নিরাময়ের বালাই নেই। বাধ্য হয়ে আলমারিতে আর পড়ার কিছু বাকি আছে কিনা খুঁজতে গিয়ে হাতে এলো বৃহৎ লক্ষ্মী চরিত্র বইখানি। মনে পড়ে গেল যে বছর সাতেক আগে গিন্নি কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন আমাকে একখানা লক্ষ্মী চরিত্র বই আনতে বলেছিল। তখন ওটা এনেছিলাম। সেবার গিন্নি নিজে বেশ ধুমধাম করে মায়ের পূজো করেছিল। তখন বইটা কাজে এসেছিল। তারপর পরের বছর লক্ষ্মীপূজাতে বইটার হদিশ না পাওয়াতে গিন্নি বিনা মন্ত্রোচ্চারণে মায়ের পূজা করে এবং এযাবৎ এভাবে চলছে। তা হঠাৎ বইটা আমার হাতে আসায় বইটাতে কি আছে তা পড়ে দেখার ইচ্ছা হলো। ওতে যা আছে তা সমাজের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজন। জানি না আজ গ্রামের মায়েরা লক্ষ্মীচরিত্র বইখানা পড়েন কিনা। যারা পড়েননি, তাদের আজ লক্ষ্মীচরিত্রের “ভাদ্র মাসের ব্রতকথা” শোনাচ্ছি।ভালো লাগলে পড়বেন। না ভালো লাগলে এড়িয়ে যাবেন।আর একটি অনুরোধ ভালো লাগলে একটি শব্দের হলেও মন্তব্য দেবেন। কিন্তু লাইক দেবেন না।]
মহেন্দ্র সেন নামে এক রাজার রাজ্যের এক গ্রামে সেমন্তী নামে এক বিধবা ব্রাম্ভনী বাস করতো। অজয় নামে তার একটি পাঁচ বছরের পুত্র সন্তান ছিল। ব্রাম্ভনী একেবারে গ্রামের শেষপ্রান্তে পাড়ার শেষে মায়ে পোয়ে বাস করতো। তারা ছিল অত্যন্ত গরীব। ব্রাম্ভনী অনেক কষ্টে নিজেদের দু'জনের ভরণ পোষণ করেন। কিন্তু কিছুতেই আর তিনি দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠছেন না। তিনি মা লক্ষ্মী প্রতিমার কাছে তার দারিদ্রের কথা জানিয়ে কান্নাকাটি করে বললেন-“ মা গো আমি জমি বাড়ি ধানের গোলা কিচ্ছু চাই না। আমাকে শুধু দু'বেলা দু'মুঠো অন্ন আর দু'খানা লজ্জার বস্ত্র দাও। আমি ঐ টুকু পেলে আমার দিন চলে যাবে মা”।
সেমন্তীর ছেলে গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যায়। অন্যান্য গ্রামের ছেলেদের মতো অজয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো নয় বলে সে অন্যান্য ছেলেদের সাথে মিশতে চাইতো না। তাছাড়া সে তাদের সাথে মিশবেই বা কি করে! তার সহপাঠিরা যে তাকে এড়িয়ে চলে! অজয় তাই তার সহপাঠিদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
পাঠশালায় যেতে তিন রাস্তার মোড়ে বেশ বড় একটি বটগাছ আছে। মাথায় অনেক ডালপালা নিয়ে পর্বতের মতো বটগাছটা দাঁড়িয়ে থাকে। তার শরীর থেকে অনেক ঝুরি এসে মাটিতে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। সেই বটগাছে অনেক পাখি বাস করে। অনান্য পাখিদের সঙ্গে সেখানে বাস করে একটি পেঁচা-পেঁচি আর তার দু'টি ছানা। পেঁচা পেঁচি সারাদিন খাবারের অন্বেষণে বেরিয়ে যায়। সায়াহ্নে বাসায় ফেরে। তখন ছানারা খেতে পায়। যতক্ষন না পেঁচা-পেঁচি ফিরে আসছে, ততক্ষন তারা অনাহারে দিন কাটায়। এই রকম করে তাদের দিন কাটে।
একদিন সেই বটগাছের তলায় এক ক্ষীর ওয়ালি ক্ষীরের হাঁড়ি নিয়ে বসলো। উদ্দেশ্য তিন রাস্তার মোড়ে বটগাছের তলায় অনেক লোকের যাতায়াত হবে। আবার অনেকে বটগাছের তলায় বসে বিশ্রাম নেবে। তখন তাদের ক্ষিদে লাগলে ক্ষীর কিনে খেতে পারে। এই আশায় ক্ষীর ওয়ালি বটগাছের তলায় এসে বসেছে।
এমন সময় পাঠশালা ছুটি হওয়াতে সকল বাচ্চারা ক্ষীর ওয়ালির কাছ থেকে ক্ষীর কিনে খেতে লাগলো।কিন্তু অজয়ের কাছে পয়সা না থাকায় সে ক্ষীর কিনে খেতে পারলো না। সে তখন তার মায়ের কাছে গিয়ে ক্ষীর কিনে খাওয়ার জন্য পয়সা চাইলো। সেমন্তী খুব অসহায় বোধ করলেন। কিন্তু তিনি তো মা। সন্তানের ইচ্ছা পূরণ না করতে পারলে যে বেশ কষ্ট হয় তার।তিনি তার ছেলেকে বললেন যে কাল পাঠশালায় যাওয়ার সময় ক্ষীর কিনে খাওয়ার জন্য পয়সা দেবে। রাতে অজয় ঘুমিয়ে পড়লে সেমন্তী পৈতে কাটতে বসলেন। সারা রাতে যা পৈতে কাটলেন, তা বেচে পেলেন মাত্র দু'পয়সা। তাই তিনি ছেলের হাতে দিয়ে পাঠশালায় পাঠালেন।
বিকেলে পাঠশালা ছুটির পর অজয় ক্ষীর ওয়ালির কাছে গিয়ে দু'পয়সার ক্ষীর কিনলেন। কিন্তু অজয়কে দেখতে এত সুন্দর যে, তার আচার ব্যবহার এত মধুর যে,সে এত শান্ত স্বভাবের যে ক্ষীর ওয়ালির খুব পছন্দ হওয়াতে তিনি অজয়কে চার পয়সার ক্ষীর দিলেন। আর যেই না সে ক্ষীর নিয়েছে, অমনি পেঁচার বাসার ছানা দু'টো খিদের জ্বালায় কেঁদে উঠলো।অজয় গাছে উঠে দেখে যে দুটি পেঁচার ছানা খিদের জ্বালায় কাঁদছে। অজয় তখন কেনা ক্ষীরের কিছুটা ছানা দু'টিকে খাওয়ালে। বাকি যা ক্ষীর থাকলো, তা নিয়ে সে মায়ের কাছে গিয়ে মাকে তার অর্ধেক দিলো। বাকিটা সে নিজে খেল।
এদিকে পেঁচা-পেঁচি সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফিরতে দেখা গেল তার বাছারাক ক্ষিদের জ্বালায় কাঁদছে না। তাই দেখে তারা তাদের বাচ্চাদের জিজ্ঞাসা করলো এবং সব কথা জানলো।এর পর থেকে অজয় নিজের খাবারের কিছুটা এনে পেঁচা-পেঁচির বাচ্চাদের খাইয়ে যায় এবং তাদের সাথে গল্প করে। ছানারা অজয়ের দুঃখের কথা শুনে অত্যন্ত দুঃখ বোধ করলো। সেদিন সন্ধ্যায় তাদের বাব মা ফিরলে তাদের বাচ্চারা বললে-“ বাবা আমাদের জন্য অজয় এত কিছু করছে। আর তোমরা ওর জন্য কিছু করবে না! তোমরা তো মা লক্ষ্মীকে বহে নিয়ে বেড়াও। তা মাকে অজয়ের দুঃখের কথা তো বলতে পারো। তাহলে মায়ের দয়ায় অজয়ের দুঃখের দিন শেষ হতে পারে”।তখন পেঁচা তার ছেলেকে বললো-“ বাছা আমি আগেই মা ঠাকুরুনকে অজয়ের কথা বলেছি।তিনি অজয়কে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন। তোমরা কাল অজয়কে বলবে যে সে যেন আমরা না আসা পর্যন্ত এখানে অপেক্ষা করে।
পরের দিন অজয় পেঁচা-পেঁচি না আসা পর্যন্ত বটগাছের তলায় অপেক্ষা করলো। পেঁচা পেঁচি এলে তাদের সঙ্গে অজয় দেখা করলো। তখন পেঁচা বললো- “ বাছা অজয়, তুমি খুব দয়াবান আর ভালো ছেলে। তোমার ব্যবহারে আমরা খুব খুশি হয়েছি। তাই তোমাকে কিছু উপহার দিতে চাই। কিন্তু আমরা তো পক্ষী জাতি। আমাদের দেওয়া জিনিষ তোমার কাজে আসবে না। তাই তোমাকে আজ মা মহামায়া, মা লক্ষ্মীর কাছে নিয়ে যাব। রাত্রি মধ্যাহ্নে আমরা যাত্রা শুরু করবো। তুমি জেগে থাকবে। আর মায়ের কাছ থেকে যা চাইবে তাই পাবে। তোমাদের দুঃখ চিরতরে ঘুঁচে যাবে।আর তোমাদের দুঃখের দিন শেষ হলে সেটাই হবে আমার উপহার।
মধ্যাহ্ন রাতে পেঁজা এসে অজয়কে ডাকলো। অজয় এসে পেঁচার পিঠে বসলো। তার পর তাকে নিয়ে বৈকুন্ঠ ধামের দিকে যাত্রা শুরু করলো। যেতে যেতে পেঁচা বললো-বাছা, মায়ের কাছে বেশী লোভ করতে যেও না। মা লোভীদের একদম সহ্য করতে পারে না। কেউ অত্যধিক লোভ করলে তার বাড়িতে যান। কিন্তু কেউ তাকে রাখতে পারে না। শুধু দেখাই সার। যে করেই হোক মা লক্ষ্মী ঠিক সে খান থেকে চলে যান। কিন্তু কেউ যদি তাঁকে খুব ভক্তি করে, তার সেবা করে,কিন্তু সম্পদের প্রতি অনাসক্ত হন, কিংবা যদি তার চাহিদা সামান্যতম হয়, অথবা কেউ যদি অপরের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে, তাহলে মা জননী তাঁর কাছে চিরদিন বাঁধা হয়ে থাকেন। অসৎ ব্যক্তিরা শঠতার দ্বারা শুধু তার সময় কালের জন্য মাকে পেয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি গত হলে, তার উত্তর পুরুষদের ভিক্ষে করেই দিন কাটাতে হয়। তাই মায়ের কাছে লোভ করে বেশী কিছু চাইবে না। শুধু চাইবে 'তিল ধুবড়ি'। 'তিল ধুবড়ি' হলো মায়ের ভান্ডার। তাতে কিছুই থাকে না। কিন্তু গুরুবারে লক্ষ্মী সিংহাসনে রেখে মায়ের পূজা করলে বাড়িতে সোনার মোহর উৎপন্ন হয়। তিল ধুবড়ি থাকলে সংসারে আর অভাব থাকবে না।
গল্প করতে করতে অজয়কে নিয়ে বৈকুন্ঠ পুরে লক্ষ্মী মাতার কাছে পৌছলো। মাকে দেখে অজয় অশ্রু পুর্ন চোখে মায়ের স্তব করতে লাগলো। অজয়ের ভক্তিতে মা প্রীত হলেন। তিনি অজয়ের বৈকুন্ঠপুরে আসার কারন জিজ্ঞাসা করলেন। তখন অজয় কান্না কাটি করে বললে-“ মা করুনাময়, তুমি তো আমার সব কথা জানো মা। আমার মায়ের দুঃখ আমি আর সইতে পারছি না। আমাদের দুঃখ ঘুঁচাও মা”।মা তখন অতুল ঐশ্বর্য্য দিতে চাইলেন। কিন্তু অজয় বললো-“মা আমাকে যদি দিতেই হয়, তাহলে “তিল ধুবড়ি”দিন। প্রতি গুরুবারে আপনার সেবা করে যা পাবো, তাতেই আমাদের চলে যাবে”। অজয়ের কথায় মা লক্ষ্মী খুব প্রীত হলেন এবং অতুল ঐশ্বর্যের পরিবর্তে “তিল ধুবড়ি” দিলেন।তার পর মা লক্ষ্মী অজয়কে বললেন-“বাছা, এই ভাদ্র মাসে শুক্ল পক্ষের গুরুবারে তোমার যথাসাধ্য আয়োজনে আমার সিংহাসনে “তিল ধুবড়ি” রেখে পূজা করবে। তাহলে তোমার মনস্কামনা পূর্ন হবে।শুধু মাত্র সম্পদ পাওয়ার লোভে “তিল ধুবড়ি” পূজা করলে হবে না। নিজেকে শ্রম করতে হবে, পরোপকারে নিজের সম্পদকে উৎসর্গ করতে হবে, সবার মঙ্গল চিন্তা করতে হবে। তবে তুমি আমাকে পাবে। নচেৎ “তিল ধুবড়ি” নেওয়া তোমার বৃথা”।
বিধবা সাধ্বী সেমন্তী ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের গুরুবারে নিজের সাধ্য মত আয়োজন করে মা লক্ষ্মীর পূজো করলেন। সে “তিল ধুবড়ি” থেকে যা পেল তাতে মায়ে পোয়ে বছর পাঁচেক হেসে খেলে কেটে যাবে। বাকি গুরুবারের উপার্জনে গরীবদের সেবায় খরচ করবেন বলে চিন্তা করলেন। এমনি করে অজয় গ্রামে ধনী হয়ে উঠলো। কিন্তু গ্রামের হিংসুটে লোকের তো অভাব নেই। তারা অজয়ের ধনী হওয়ার কারন জানতে পেরে তা রাজা মহেন্দ্র সেনকে তারা জানালো। রাজা অজয়ের বাড়ি তল্লাসি করে সমুহ সম্পদ আর “ তিল ধুবড়ি” নিয়ে গেল। অজয় মনের দুঃখে কাঁদতে লাগলো। সেদিন গভীর রাতে মা লক্ষ্মী অজয়কে এসে দেখা দিয়ে বললেন-বাছা অজয়,তোমার ভক্তিতে আর আদর্শে আমি খুব খুশি হয়েছি। রাজা তোমার কিছু ক্ষতি করতে পারবে না।তুমিই হবে এ রাজ্যের পরবর্তী রাজা।প্রজাদের তুমি সন্তানের মতো লালন পালন করবে বাবা। এই বলে আবার তাকে”তিল ধুবড়ি” দিয়ে বিদায় হলেন।
কিন্তু পাড়ার হিংসুটে লোকেদের গাত্রদাহ হচ্ছিল। তারা কিছুতেই অজয়ের ধনী হওয়া মানতে পারছিল না। তাই তারা আবার রাজার কাছে গেল এবং অজয়ের বৃত্যান্ত জানালো। রাজা অজয়ের বাড়ি এসে দেখলেন যে তার বাড়িতে সেই একই “ তিল ধুবড়ী” আছে। তিনি অবাক হলেন। যে জিনিষ তার রাজভান্ডারে দিবারাত্র প্রহরীর দ্বারা রাখা হয়, সেখান থেকে অজয়ের চুরি করে আনা অসম্ভব। তাহলে এ জিনিষ এখানে এলো কি করে! এ নিশ্চয় মা লক্ষ্মীর মায়া। থাক বাবা, অজয়ের সঙ্গে শত্রুতা করে লাভ নেই। ওর সঙ্গে শত্রুতা করলে মা লক্ষ্মী যদি রেগে যান, তাহলে আমার রাজত্ব আর থাকবে না। তার চাইতে অজয়ের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে ওর সঙ্গে আত্মীয়তা করে নেই।
এরপর রাজা মহেন্দ্র সেন নিজের মেয়ের সঙ্গে অজয়ের বিয়ে দিলেন এবং তাকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য শাসনের ভার দিয়ে বানপ্রস্থে গমন করলেন।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ-কালীকৃষ্ণ শীল রচিত বৃহৎ লক্ষ্মী চরিত্র বই থেকে কাহিনী আহরিত]
কপিরাইট @ তারাপদ মাঝি
দেবনগর
১৭/০৫/২০১৯

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.