প্রবঞ্চক



তাকে আমরা শংকর বলেই জানতাম। কিন্তু তার প্রকৃত নাম ছিল শংকর নারায়ন পাল। বাবার একমাত্র সন্তান। ছেলেবেলা থেকেই সে ছিল বড়ই দুরন্ত। তার দূরন্তপনায় বাড়ির সবাই তো বটেই, এমনকি পাড়ার কেউই শান্তিতে থাকতে পারতো না।ছেলেবেলায় পাড়ার লোকেদের বাগানের কলার কাঁদি, গাছের ডাব নারিকেল, ক্ষেতের আখ,মাঠের তরমুজ ইত্যাদি তার জ্বালায় রাখা যেত না। এমন দুরন্ত ছেলে পাড়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই।
এই ছেলে একদিন বড় হলো। তার দস্যিপনা অন্যদিকে মোড় নিল। সে পরিনত হলো এক বড় প্রবঞ্চকে, প্রতারকে। তাকে দেখলে সবাই তার ছায়া এড়িয়ে যায়। কিন্তু কেউই তাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। তার কথা বলার ধরণটি অসাধারণ। কথায় এমন যাদু থাকে, এমন মোহ থাকে, এমন মাধুর্য্য থাকে, এমন একটা আকর্ষণ থাকে যে সবাই অভিভুত হয়ে যায়। আর তখনই তার প্রতারণার খেলা শুরু হয়ে যায়।
আমি তাকে চিনতে পারি অনেক পরে। সে ছিল আমার বাল্য বন্ধু। বড়রা যাই বলুক, আমার কাছে শঙ্কর ছিল অত্যন্ত প্রিয়। অবশ্য তার কারণ ছিল। আমার পয়সা ছিল না বই কেনার। কিন্তু শঙ্করের বাবার অঢেল পয়সা। সে বই কিনতো। আর আমি তার বইগুলো নিয়ে পড়তাম। সে পাড়া থেকে যা লুট পাট করে আনতো আমাকে সবকিছু দিত। ওগুলো যে অন্যায় সেই ছোট্ট বয়সে আমার সে বোধ আসে নি। কিন্তু সে যাই হোক সে ছিল আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। কিন্তু ছেদ পড়লো মাধ্যমিকের পর। আমি মাধ্যমিকে পাশ করলেও আমার বন্ধুটি অকৃতকার্য হলো। কিন্তু তার বাবার দাপটে সে কিছুতেই পড়া বন্ধ করতে পারলো না।পরে অনেক কষ্টে গ্র‍্যাজুয়েশান করলো।
দুজনেই একই কলেজ সুন্দরবন মহাবিদ্যালয় থেকে পাশ করেছিলাম। আমি ওর প্রায় বছর তিনেক আগে গ্র‍্যাজুয়েশান করে জীবীকা অন্বেষণে দিল্লী চলে যাই। সেখানে বছর পনের কাটানোর পর, কিছু পুঁজি জোগাড়ের পর আবার গ্রামে ফিরলাম।ঠাকুরের কৃপায় বেশ কিছু অর্থ সংগ্রহের পরে গ্রামে ফিরে ঠিকাদারের কাজে হাত দিলাম। সেই সময় শঙ্কর আমার কাছে এসে বললে যে সে আমার কাছে লেবারের কাজ করবে। একে বাল্য বন্ধু, তার উপর বাল্যকালে আমার পড়াশুনায় খুব হেল্প করেছে। বাবা মায়ের বারণ সত্বেও তাকে না করতে পারলাম না। তাছারা ইতিমধ্যে ওর বাবা মারা যাওয়ায় সংসারের ভার নিজের হাতে পড়েছে। বাবার বিষয় আশয় যা ছিল তা বন্ধু বান্ধবদের সাথে ষ্ফুর্তি করে শেষ করেছে। যখন সর্বশান্ত হলো, সুখের বন্ধুরা সব কেটে পড়লো। এখন শঙ্করের খুব কষ্টে সংসার চলে।তবে শঙ্কর কিন্তু নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছে। নিজেকে নতুনভাবে তৈরী করছে।
শঙ্করের মনে একটি প্রতিহিংসার জন্ম হয়েছে। সে ভাবছে যে সে এতদিন তার ঐশ্বর্য্যকে অপরের সেবায় লাগিয়েছে। কিন্তু নিজের দুর্দিনের সময় কেউ তার পাশে দাঁড়ায় নি। তাই সুযোগ পেলে সকলকে লুটে নেওয়াই হবে তার লক্ষ্য। এখন তার সব সময়ের লক্ষ্য হলো মানুষকে প্রতারণা করা। এই সব কথা আমাকে আমার দাদা আর বাবা বোঝালেন এবং পরামর্শ দিলেন যে আমি যেন ওকে কিছুতেই আমার ঠিকাদারির কাজে না নেই।
কিন্তু আমি তাদের কথা কানে তুললাম না। আমি স্থির করলাম যে আমার সাথে অন্তত শঙ্কর বেইমানি করবে না। আর যখনই বেইমানি করবে, তখন তাকে তাড়িয়ে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে। এতে অন্তত আমি শঙ্করের কাছে ছোট হবো না। তাই শঙ্করকে কাজে নিলাম। তবে লেবারের কাজ দিলাম না। তাকে লেবারের ঠিকাদারির কাজ দিলাম। এবং কিভাবে লেবারের ঠিকাদারির কাজ করতে হয়, তা তাকে কয়েকদিন ট্রেনিং দিয়ে শিখিয়ে দিলাম। সে তাড়াতাড়ি শিখেও গেলো। সে লেবার সংগ্রহ করে এবং তাদের পরিচালনা করে। আমি হিসাব করে টাকা দেই। সে লেবার ম্যানেজারির মজুরি পায় আর প্রতি লেবারের থেকে দু'টাকা করে কমিশন পায়। এতে তার মাসে পাঁচ সাত হাজার টাকা করে আসতে থাকে। তার সংসারও ভালো চলতে থাকে। আমাকেও বিভিন্নকাজে সাহায়্য করায় আমারও বেশ খানিকটা উপকার হয়।
একদিন সে এসে বললো- অমল, তোর মেটিরিয়াল সাপ্লাইয়ের কাজ করতে চাই। তোর ইট, বালি, সিমেন্ট,স্টোনচিপ,রড ইত্যাদিতে আমি ভাগ বসাবো না।তুই শুধু বাঁশ, টালী, পেরেক, ইউসি,বীজ,সার ইত্যাদি গুলো আমাকে দে। আমি ঐগুলো সরবরাহ করবো।
-আমি দেখলাম,ওর কন্ট্রাকটারী লাইসেন্স নাই। আমাকে বিল দিতে হবে। তা বিল যখন আমার নামে ঊঠবে, তখন ও মাল সরবরাহ করলে আমার আপত্তি নাই। তাতে ও যেমন দু'পয়সা পাবে, আমারও তেমনি দু,পয়সা কামাই হবে।আমি রাজি হয়ে গেলাম
আমি আর শঙ্কর বছর পাঁচেক কাজ করার পর ওর বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ আসতে লাগলো। প্রথমে এলো খুচরো ব্যবসায়ীরা। যেমন টিভি দোকানী, চা দোকানী, মোবাইল দোকানী,মাছ দোকানী,আর অজস্র লেবার। এবার এদের অভিযোগ গুলি শুনলে যে কোন মানুষের মেজাজ বিগড়ে যাবে। যেমন-
টিভি দোকানীর অভিযোগ-শঙ্কর তার কাছ থেকে দশখানা টিভি নিয়েছে। সবই এল ই ডি। প্রতিটির দাম কমবেশী পনেরহাজার টাকা। সবগুলি মাসিক কিস্তিতে নেওয়া। এক মাস কিস্তির টাকা দেওয়ার পর আর টাকা দিচ্ছে না। চা দোকানীর অভিযোগ-তার দোকানে লেবার নিয়ে এসে চা খায়। সব বাকিতে। বলে প্রতিদিন পয়সা দিতে ভালো লাগে না। তার চাইতে মাস শেষে এককালিন করর সব টাকা দেবে। তাতে শঙ্করদের সুবিধা হবে এবং এককালিন টাকা পেলে চা ওয়ালার কাজে আসবে। কিন্তু প্রথম দু'মাস ঠিক ঠাক দিচ্ছিল। তারপর আর টাকা দেওয়ার নাম নেই। তিন মাসে প্রায় ছয় হাজার টাকা বাকি। অনুরূপভাবে বাকি দোকান গুলোতে বাকি করেছে। আমি সব বাকি হিসাব করে দেখলাম যে শঙ্কর বাজারে লাখ তিনেক টাকা বাকি করেছে। পাওনাদারদের দাবি আমাকে নাকি ঐ টাকা পরিশোধ করতে হবে। কারন শঙ্কর আমার নাম করে, আমার ইমেজ ভাঙিয়ে দোকান বাকি করেছে। তাই সেই টাকা আমাকে পরিশোধ করতে হবে। এই নিয়ে পাওনাদারদের সঙ্গে আমার প্রচুর ঝগড়া হলো। শেষে তাদের আমি প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলাম।
আমি শঙ্করকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলাম। কারন ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কাউকে দেখতে পাইনি। পরে ওর প্রতিবেশীর কাজ থেকে জেনেছিলাম যে ওরা শ্বশুরবাড়ি গেছে। আজ দশবারো দিন ওর সাথে দেখা নেই। ফোন করলেও পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে ওর শ্বশুর বাড়িতে গেলাম। ওখানে গিয়ে জানলাম যে শঙ্কর বাঙ্গালোর গেছে। সে আর এখানে আসবে না। সেখানে তার এক শালী থাকে। শঙ্করের জন্য সে একখানা চাকুরি জোগাড় করেছে। তাই সে ওখানে পরিবারসহ চলে গেছে।
আমার মাথায় বজ্রাঘাত হলো। ওর উপর অনেক মহাজনের পরিচয় ছিল। ও তাদের কাছ থেকে আমার নাম করে টাকা তুলে নেয় নি তো? আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। সব খোঁজ নিয়ে জানলাম যে শঙ্কর অনেক লোককে ঠকিয়ে এখান থেকে অন্তত লাখ দশেক টাকা নিয়ে ভেগেছে।তবে সে আমার কোন ক্ষতি করে নি। শুধু আমার সম্মান আর পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে এসব করেছে। শঙ্কর ব্যাঙ্ক, বাঁশদোকানী, ইট ভাটার মালিক, মাছের ব্যবিসায়ী, টিভি দোকানী,সার দোকানী, ধনী মহাজন, ট্রান্সষ্পোর্ট কোম্পানী প্রভৃতিদের নিকট থেকে এই দশ লাখ টাকা তুলেছে।
মানুষের চরিত্র মনে হয় প্রবহমান নদীর মতো। নদীকে যেমন চেনা যায় না,যেমন প্রতিদিন তার গতিপথ পালটায়, ঠিক তেমনি সময়ের প্রতি পলে মানুষের চরিত্র পালটায়। যে শঙ্করকে আমি বাল্যকালে চিনতাম, সে শঙ্কর আর যৌবনের শঙ্করের মধ্যে আসমান জমিন ফারাক। সেই ফারাক আমি বুঝতে পারি নি।তবে গ্রামের একটি সাধারণ ছেলে যে এত বড় প্রতারক হতে পারে, এবং প্রতারণা করে যে এত টাকা উপার্জন করা যেতে পারে সেই ধারণা আমার ছিলনা। ওর পথ অবলম্বন করলে আমি কত টাকা উপার্জন করতে পারবো চিন্তা করতেই মাথা ঘুরে মুর্ছিত হয়ে ভূপতিত হলাম।
কপিরাইট @তারাপদ মাঝি
দেবনগর
২২/০৫/২০১৯

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.