#রমাপদবাবুর_ট্রান্সফার


সুন্দর গল্প ও কবিতা

ডিসেম্বর ২০১১৪ সালে রমাপদবাবুর ট্রান্সফার হল। ট্রান্সফার হত না। কিন্তু শাসক দলের কথা না শোনার জন্য অনেক তদ্বির করে শাসক দল রমাপদবাবুকে এক পান্ডব বর্জিত গণ্ড গ্রামের গ্রামপঞ্চায়েতে ট্রান্সফার করে দিল। রমাপদবাবু বিশেষ মেরুদন্ডী প্রানী। তিনি অন্যায় না করলে কিছুতেই কারুর কাছে মাথা নত করেন না। আর করবেনই বা কেন? তিনি সর্বদা সৎ পথে থাকেন। তাই তার কোন কিছুতেই যায় আসে না। শুধু ভয় ট্রান্সফারের। কিন্তু সৎ পথে থাকার সংগ্রামে সেই ভয়কেও রমাপদবাবু জয় করেছেন।যেন ট্যাঁকে ট্রান্সফারের পত্র নিয়ে তিনি এখন চলাফেরা করেন।কেউ কোন প্রকারে ট্রান্সফারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে অন্যায় কাজ করিয়ে নিতে পারে না।
এবার রমাপদবাবু সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। উনি গ্রাম পঞ্চায়েতের কর্মচারী এবং সেক্রেটারী পদে আসীন।বেশ লম্বা গড়ন।গায়ের রঙ খানিকটা তামাটে হলেও দেখতে ভারি সুশ্রী। বয়স চল্লিশ।বছর দশেক হলো বিয়ে করেছেন এবং এক কন্যা সন্তানের পিতা। বাড়ির অবস্তা বেশ ভালো। উনার বাবা ফুড ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। ফলে আর্থিক অনটন একেবারেই নেই। সত্যি কথা বলতে রমাপদবাবুর পরিবারে আর্থিক স্বছন্দ এতটাই বেশী যে তার তিনপুরুষ যদি চাকুরি না করেন তা হলেও কিছু যায় আসে না। বলতে গেলে রমাপদবাবু সময় কাটানোর জন্য চাকুরি করেন। কিন্তু চাকুরি করতে গিয়ে কিছুতেই তিনি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে চান না। তাই অনেক দূরে গণ্ডগ্রামে ট্রান্সফার হলেও তিনি ওখানে চাকুরি করতে যাবেন।
রমাপদবাবুকে ট্রান্সফার করা হল দেউড়ি নামক এক গ্রাম পঞ্চায়েতে। পঞ্চায়েতটি সুন্দরবনের একটি দ্বীপে অবস্থিত এবং ঐ দ্বীপের মোট পনেরটি বুথ নিয়ে গঠিত। জনবসতির ঘনত্ব খুবই কম। পঞ্চায়েতটি দ্বীপের একেবারে মাঝ বরাবর জায়গায় অবস্থিত।রামগঙ্গা ব্লকের সবচেয়ে দূরের পঞ্চায়েত এটি এবং রামগঙ্গা ব্লক হতে নৌকা করে এই পঞ্চায়েতে যেতে হয়। সময় লাগে পৌনে এক ঘন্টা। এই পঞ্চায়েতের চারিদিক বঙ্গোপ সাগর দ্বারা বেষ্টিত।
রমাপদবাবু এই সব নিয়ে ভাবেন না। তিনি বলেন যে যেখানে মানুষ বাস করে সেখানে তার থাকতে অসুবিধা হবে কেন? সেখানকার মানুষের যদি থাকতে অসুবিধা না হয়, তাহলে তারই বা কেন অসুবিধা হবে? শুধু এইটুকু অসুবিধা যে তাকে বাড়ি ছেড়ে পঞ্চায়েতের কাছাকাছি কোথাও বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হবে। এটা রমাপদবাবু মেনে নিয়েছেন এবং এর জন্য মানসিক প্রস্ততিও নিয়ে ফেলেছেন।
১২ই ডিসেম্বর শুক্রবার রমাপদ বাবু খুব সকালে উঠে নতুন পঞ্চায়েতে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য যাত্রা করলেন। উনার বাড়ি বারুইপুরে। তাই তার নতুন জায়গায় পৌছাতে অসুবিধা হবে ভেবেই তিনি তাড়াতাড়ি সকাল ৭টায় বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। তিনি প্রথমে ট্রেনে লক্ষ্মীকান্তপুরে এলেন সকাল ৮টা নাগাদ। এখানে এসে তিনি রামগঙ্গা গামী বাস ধরলেন। রামগঙ্গায় পৌছালেন সকাল ১০টায়। সেখান থেকে নৌকায় চাপলেন পঞ্চায়েতে যাবার জন্য।
রমাপদবাবু ভেবেছিলেন যে তিনি পঞ্চায়েতে আজ গিয়ে জয়েন করে বাড়ি ফিরে যাবেন। সেই সঙ্গে পঞ্চায়েতের প্রধানকে বলে আসবেন যে তারা যেন রমাপদবাবুর জন্য একখানা বাড়ি ভাড়ায় ঠিক করে দেন। কিন্তু নৌকায় উঠে পাবলিকের কথা শুনে বুঝতে পারলেন যে তিনি আজ ইচ্ছা করলেও বাড়ি ফিরতে পারবেন না। কারণ পারা পারের নৌকা সারাদিনে মাত্র একবার চলে। ফলে আজ তাকে এই পঞ্চায়েতের কোথাও কাটাতে হবে। এই নিয়ে রমাপদবাবু আর কিছু ভাবতে চাইলেন না। কারণ তিনি জানেন যে ভাবলে কিছু লাভ হবে না। যা হবার হবে।
তার নৌকাতে নারী পুরুষ মিলিয়ে অন্তত শ’দেড়েক লোক আছে।কোন কারণে যদি নৌকার সলিল সমাধি ঘটে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। মূহুর্তে তার মনে হলো যে তার এরকম ভাবার কোন কারণ নেই। তিনি খোঁজ নিয়ে জানলেন যে আজ পর্যন্ত নৌকা ডোবার কোন ঘটনা ঘটে নি।রমাপদবাবুর খুব খারাপ লাগল। তাকে দেখে এই গ্রাম্য মেয়েরা মুখ টিপে হাসছে। রমাপদবাবু যে নদী দেখে খুব ভয় পেয়েছেন তা তারা খুব বুঝতে পেরেছেন। এখন রমাপদবাবুর খুব অসস্তি হচ্ছে। তাই তিনি নৌকার ছাদে উঠে গেলেন। ছাদের মাঝখানে বসে নদীর দুদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে লাগলেন। ঘন সবুজ বন একেবারে নদীর জল থেকে ডাঙ্গার দিকে উঠে গেছে। নদীর জলে হাঁস জাতীয় সাদা পাখী ভেসে বেড়াচ্ছে।ঘন জঙ্গলে নাম না জানা কত পাখী যে ডাকছে তার ইয়ত্তা নেই। প্রবল বেগে জোয়ার হচ্ছে।সেই জোয়ারের জলে নদী পাড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কি সব জাল ফেলে মাছ ধরছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট নৌকা তীর বেগে কোথায় যে যাচ্ছে কে জানে।
দ্বীপটার নাম দেউড়ি। তাই পঞ্চায়েতের নাম দেউড়ি গ্রাম পঞ্চায়েত। যখন রমাপদবাবু দেউড়িতে নামলেন, তখন বেলা এগারটা। নেমে আধা ঘন্টা হাঁটার পর তিনি দেউড়ি পঞ্চায়েতে পৌছালেন। গ্রামের পঞ্চায়েত হলেও পঞ্চায়েতের আবাসন গৃহের আয়তন বেশ বড়।পঞ্চায়েতটি তিন তলার। পঞ্চায়েতের সঙ্গে একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রও যুক্ত। তাই বোধ হয় পঞ্চায়েতের কলেবর এতটা বড়।
রমাপদবাবু পঞ্চায়েতে পৌছে খোঁজ নিয়ে প্রধানের ঘরে গেলেন এবং তাকে নমস্কার করে আত্মপরিচয় দিলেন।রমানাথবাবুর পরিচয় পেয়ে অফিসে হইচই পড়ে গেল। সবাই প্রধানের গৃহে ছুটে এলেন নতুন সেক্রেটারীকে দেখতে। প্রধান সাহেব বাজখাই গলায় হাঁক দিলেন - অ্যাই জয়ন্ত? সেক্রেটারীর জন্য চা নিয়ে এসো?
-আজ্ঞে, করছি বাবু। আমাকে স্টোভ জ্বালাতে সময় দিতে হবে তো?
রমাপদবাবু বুঝলেন জয়ন্ত হলো পঞ্চায়েতের গ্রুপ ডি কর্মচারী। তাই তাকে খুব ভালো করে দেখতে লাগলেন রমাপদবাবু। খানিকটা দেখে রমাপদবাবু বললেন-খুব ব্যস্ত হবার কিছু নেই জয়ন্তবাবু। আমি তো আজ আর পালিয়ে যাচ্ছি না।ধীরে ধীরে চা করলেও চলবে।
রমাপদবাবু প্রধানের সঙ্গে কথা বলে বুঝলেন - প্রধানের নাম সুশান্ত মাইতি।বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ।ফর্সা, বেশ লম্বা এবং দেখতে বেশ সুন্দর। উনাকে বেশ নিপাট ভদ্রলোক বলে মনে হল রমাপদবাবুর। তিনি খুব আলাপী এবং আমুদে। কথা কথায় রসিকতা করতে ছাড়েন না।সব চেয়ে প্রধানের যে গুনটি ভালো তা হলো মূহুর্তে কাউকে সহজেই আপন করে নেওয়া। যেমন রমাপদবাবুকে একেবারে আপন করে নিয়েছেন। এবার রমাপদবাবুর সঙ্গে প্রধানের বাক্যালাপের ধরণটি হলো এইরকম-
-রমাপদবাবু, আপনি মাসে বাড়ি যাবেন,না সপ্তাহে বাড়ি যাবেন?
- মানে? আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
-বলছি এখানে যখন চাকুরি করবেন, তখন বাড়ি থেকে তো আর প্রতিদিন আপনি যাতায়াত করতে পারবেন না। তাহলে এখানে আপনাকে থাকতে হচ্ছে।এখানে থাকলে আপনি সপ্তাহে একবার বাড়ি যেতে পারেন বা মাসে একবার বাড়ি যেতে পারেন।
-না, প্রধান সাহেব আমি ঐ সপ্তাহে একবার করে বাড়ি যাবো। শুক্রবার যাবো এবং সোমবার ফিরবো।তাড়াতাড়ি রমাপদবাবু জানালেন।
-সুশান্তবাবু বললেন-আমাদের এখানে মেয়ের সংখ্যা বেশী মশাই। আপনি চাইলে এখানে একখানা বিয়ে করতে পারেন।আপনাদের তো ট্রান্সফারের চাকরি। যেখানে যাবেন এই বউকে বগলদাবা করে নিয়ে যাবেন। এতে অনায়াসে এখানে একমাস কেটে যাবে। তারপর মাসের শেষে যখন বাড়িতে যাবেন তখন সেখানে পারমানেন্ট বউ তো থাকলো। কি ভালো হবে না বলুন। বলে হাসতে লাগলেন। সঙ্গে রমাপদবাবুও হাসতে লাগলেন।
-চা খাওয়ার পর এবার প্রধান সাহেব বললেন - সেক্রেটারীবাবু আপনি তো আজ বাড়ি ফিরতে পারবেন না। এখানে থাকতে হচ্ছে। তাহলে আজ আমাদের বাড়িতেই থাকুন। সোমবার থেকে অফিসের স্টাফেদের রুমে থাকবেন।
-রমাপদবাবু বিস্ময়ে বললেন- স্টাফেদের রুম মানে?
- অফিসের প্রায় কর্মচারী এই এলাকার বাইরের লোক। তারা এখানে চাকরি করতে এলে থাকবে কোথায়। এটা তো আর শহরাঞ্চল নয় যে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে! তাছাড়া বাড়ি থাকলেও কেউ আপনাকে বাড়ি ভাড়া দেবেই না। কারণ এখানকার মানুষ অত্যন্ত সংরক্ষনশীল। বাড়ির মেয়েদের নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে কেউ বাড়ি ভাড়া দেবে না।স্টাফেদের এই সমস্যা দূর করার জন্য অফিস স্টাফেদের থাকার জন্য অফিসে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখানে খাট গদি, রান্না খাওয়ার সব ব্যবস্থা আছে। তবে খাওয়ার জন্য সামান্য কিছু পয়সা স্টাফেদের দিতে হয়।
-আজ রাতে অফিসের স্টাফেদের রুমে থাকলে তো হয়। রমাপদবাবু বললেন।
-না, আপনি একা স্টাফেদের রুমে থাকতে পারবেন না।অফিসটা তো দেখছেন একটু ফাঁকা জায়গায় অবস্থিত। রাতে আপনার একা থাকা একেবারেই ঠিক নয়।
-না না। আমার কোন অসুবিধা হবে না।একটা রাত থাকতে কিছুতেই অসুবিধা হবে না।আপনি শুধু আমার খাবার ব্যবস্থা করুন।তাতেই আমার চলবে।রমাপদবাবু বললেন।
-এবার প্রধান সাহেব বললেন- না সেক্রেটারীবাবু আপনাকে একা এখানে থাকতে দেওয়া যায় না।রাতে যদি আপনার অসুখ বিসুখ কিছু হয়, তাহলে আপনি কারুর সাহায্য পাবেন না।আমি আপনাকে কিভাবে এখানে একা থাকতে দেব! আরে আমরা তো মানুষ না কি! লোকে বলবেই বা কি!
-এর পরে আর কিছু বলার থাকে না।রমাপদবাবু বিকাল ছয়টার সময় সুশান্তবাবুর সঙ্গে পঞ্চায়েত থেকে বের হলেন। পঞ্চায়েত থেকে বেরিয়ে প্রধান সাহেব প্রথমে গেলেন সেখানকার স্থানীয় বাজারে। সেখানে একটি চায়ের দোকানে বসিয়ে দিয়ে চা এর অর্ডার দিলেন। তারপর রমাপদবাবুর সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। চা পানের শেষে এবার রমাপদবাবুকে নিয়ে বাজারের ভিতরর ঢুকলেন।
বাজারটি বেশ মন্দ নয়। বেশ লোকজনের ভীড়। প্রায় সব রকম জিনিষের দোকান আছে। বস্ত্র, চাল,মুদি,তেলেভাজা, ইমিটেশন, সবজি,মাছ, মাংস ইত্যাদির দোকান। প্রধান সাহেব রমাপদবাবুকে নিয়ে প্রথমে মুরগী বাজারে গেলেন। দেখা গেল সেখানে গ্রামের চাষীরা তাদের বাড়ীর পোষা মুরগী বিক্রির জন্য এনেছেন। প্রধান সাহেব একটা বড় রকম এঁড়ে মোরগ পছন্দ করে কিনলেন। তারপরে মাছের বাজারে গেলেন। সেখানে কিলো খানিক ভেটকি মাছ নিলেন আর নিলেন কিছু সমুদ্র কাঁকড়া। রমাপদবাবু ভাবলেন যে আজ তার রাত্তিরের খাওয়া মন্দ হবে না। শুধু তাই নয় কাল বাড়ি যাওয়ার খাওয়াও বেশ জমাটি হবে। বাজার থেকে মিনিট দশেক হাঁটার পর প্রধান সাহেবের বাড়িতে পৌঁছলেন।
প্রধান সাহেবের বাড়িটি পাকা এবং দু’তলা। বেশ বড় বাড়ি এবং খুব পুরানো। বাড়ির ইটগুলো এতো চওড়া যে সেরকম ইট এখিন আর তৈরী হয় না।বাড়ির যা লোক সংখ্যা তাতে মনে হয় উপরে নীচে মিলিয়ে বার তেরটি ঘর। প্রধান সাহেব উনাকে নিয়ে গিয়ে বাড়ির দু’তলায় একদিকের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন- সেক্রেটারীবাবু, আজ আপনি এই ঘরে থাকবেন। আমি একখানা ধুতি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি পোষাকটা চেঞ্জ করে নিন।আমিও জামা কাপড় ছেড়ে আসি। তারপর জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।
প্রায় সন্ধ্যে আটটার দিকে একজন মহিলা কাঁসার বড় বাটিতে মুড়ি আর নারকোল কোরা নিয়ে হাজির। প্রধান সাহেব বললেন- আমার মিসেস। একটু মুড়ি আর নারকোল কোরা খেয়ে নিন। খেতে একটু দেরি হতে পারে।রমাপদবাবু মুড়ি আর নারকোল কোরা খেতে খুব ভালোবাসেন। তাই আর দেরি না করে হাত লাগালেন। প্রধান আর রমাপদবাবু মুড়ি খেতে অনেক গল্প করলেন। রমাপদবাবুর এখানের সব ভালো লাগছে। কিন্তু ভালো লাগছে না আলোর ব্যবস্থা। এখানে এখনো কারেন্ট আসেনি। সবে পোল পোঁতা হয়েছে। তবে কখন তার টানবে কে জানে। তবে সোলার লাইটের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু মেন্টেনেন্স খরচ খুব বেশী বলে সেই সোলার লাইটগুলো আর সারানো হয় নি। ফলে এখন কেরোসিনের হারকিন আর কুপিই ভরসা। এই কেরোসিনের আলো রমাপদবাবুর একেবারে সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু উপায়ায় কি। অগত্যা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নাই।
রাতে ভেটিকি মাছের ঝাল আর দেশী মরগের মাংস দিয়ে খাওয়াটা বেশ ভালো হয়েছে। রাতে ঘুমটা বেশ দেওয়া যাবে।অনেকের রাতের বাসা পরিবর্তন হলে নাকি রাতে ঘুম হয় না। কিন্তু রমাপদবাবুর এই বদ অভ্যাস নেই। যেখানে সে শোবে সেখানে তার অঘোরে ঘুম আসে। ফলে খাওয়ার পর গভীর ঘুমের আশায় মনটা ছটপট করতে লাগলো।শুতে গিয়ে দেখা গেল বেশ নরম বিছানা। সুতরাং শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে রমাপদবাবু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন।
রাতে ঘুমের ঘোরে রমাপদবাবু হঠাৎ যেন বেশ একটা সুগন্ধ পেলেন। তার পর আস্তে আস্তে নূপুরের ধ্বনি শুনতে পেলেন।সেই নূপুরের ধ্বনি যেন একটি সুর। কি মিষ্টি সেই ধ্বনি। সেই ধ্বনি শুনলে মন অস্থির হয়ে ওঠে। মন পাগল হয়ে যায়। হারকিনের চিমনিটা কালো হয়ে যাওয়ায় আর হারকিনের পলতে খুব ছোট করে তুলে রাখায় তার থেকে খুব ক্ষীন আলো বেরুচ্ছিল। সেই আনকো আলোয় রমাপদবাবু চোখ মেলে তাকালেন। দেখলেন এক অপরুপা সুন্দরী রমনীকে।মনে হয় সেই মহিলা যেন অষ্টাদশী।পরণে সুন্দর একখানা বেনারশি শাড়ি।একেবারে টানা টানা হরিণের মতো চোখ। সুঠাম দেহ। তার মুখে কি সুন্দর হাসি।তার সেই মোহময়ী রুপ নিয়ে রমাপদবাবুর খাটের একপাশে বসল।রমাপদবাবু উঠতে চেয়েও উঠতে পারলেন না।মহিলাটি তাকে তার বাম হাত দিয়ে উঠতে বারণ করল।তার পর আস্তে আস্তে রমাপদবাবুর কপালে হাত বুলাতে লাগলেন আর এক মোহময় হাসি হাসতে লাগলেন।সেই হাসিতে রমাপদবাবু একেবারে মোহিত হয়ে গেলেন।আস্তে আস্তে মহিলাটি তার ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ালো। রমাপদবাবু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই বাধা দিতে পারলেন না। কেউ যেন তার হাত দুটিকে আড়ষ্ট করে দিয়েছে।আস্তে আস্তে সুন্দরী তাকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুললেন।রমাপদবাবু যেন পাগল হয়ে গেলেন সুখের আনন্দে।এবার সুন্দরী আস্তে আস্তে নিজের শরীর থেকে বস্ত্র উন্মোচন করতে লাগলেন।তিনি একেবারে বিবস্ত্র হয়ে রমাপদবাবুর বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন।রমাপদবাবুর উপর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগলো। এবার রমাপদবাবুর শরীরের আড়ষ্টতা কেটে গেছে। তিনি মত্ত হয়ে সুন্দরীকে জড়িয়ে ধরে গভীরভাবে আদর করতে গেলেন। ঠিক তখনই যেন সুন্দরী তার নাগালের বাইরে চলে গিয়ে দুষ্টুমী ভরা ছোখে তাকাতে লাগল। তারপর সেই রুপসী মোহময়ী উলঙ্গ নারী তাকে হাতের ইসারায় ডাকতে লাগল।সেই ইসারা এড়িয়ে যাবার নয়। সেই ইসারা কোন প্রকৃত পুরুষ মানুষ এড়িয়ে যেতে পারে না।
রমাপদবাবু আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠলেন।তিনিও এখন একেবারে উলঙ্গ। তিনি মোহাবিষ্টের মতো সুন্দরীর পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি পর পর তিনটি দরজা পার করে সুন্দরীর পিছু নিলেন।একসময় মেয়েটি একটি বড় বটগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালো। রমাপদবাবুও গিয়ে পৌছালেন। সুন্দরী রমাপদবাবুকে জড়িয়ে ধরল।আস্তে আস্তে রমাপদবাবুর ঠোঁটে তার ঠোঁট ছোঁয়াল। ধীরে ধীরে সুন্দরীর হাতের নখগুলো ছুঁচের মতো হয়ে যেতে লাগল,সুন্দর চোখ দুটি বিভৎস আকার ধারণ করল। মাথার চুলগুলি যেন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে এদিক ওদিক উড়তে লাগল।তার পর তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে থাকল কতকগুলি বিভৎস দাঁত। ভয়ে রমাপদবাবু শিউরে উঠলেন। এবার রমাপদবাবুর হুঁস ফিরে এলো। তিনি এবার বাস্তব জগতে ফিরলেন। আর বাস্তবে ফিরেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন। এ তিনি কোথায় এসেছেন।! তার বিছানা কোথায়! বাড়ি কোথায়! এ তো মনে হয় একটা জঙ্গল। এখানে তিনি এলেন কিভাবে! তার পর তিনি শুনলেন হাড় হিম করা এক বিচিত্র চিৎকার। তার সঙ্গে বইছে ঠান্ডা বাতাস।তিনি আর থাকতে পারলেন না। তিনি খুব জোরে চিৎকার করে বললেন- বাঁচাও, আমাকে কেউ বাঁচাও। তিনি আর চিৎকার করতে পারলেন না।জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলেন।
যখন রমাপদবাবুর জ্ঞান ফিরল, তখন তিনি দেখলেন যে তিনি প্রধান সাহেবের বাড়ির উঠোনে পাতা খাটে শুয়ে আছেন। তখন দিনের আলো ফুটে উঠেছে। মাথার কাছে প্রধান সাহেব বসে আছেন। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য।রমাপদবাবুর গায়ে প্রচন্ড ব্যথা আর জ্বর। এক জন জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি এখন কেমন বোধ করছেন। কিন্তু রমাপদবাবু কিছুই বললতে পারলেন না। তিনি আবার অজ্ঞান হয়ে চোখ বুঝলেন।
প্রধান সাহেব গুনিন দিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়ে, তার পরে ডাক্তার দেখিয়ে রমাপদবাবুকে সুস্থ করে তুললেন।তারপরে রমাপদবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন সে রাতের ঘটনার কথা। রমাপদবাবু সব বললেন। সব শুনে সুশান্তবাবু গম্ভীর হলেন। তিনি আর কিছু বললেন না। তারপর সপ্তাহ খানিক পর রমাপদবাবুকে তার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
সরকারী নিয়ম এমনই যে যত বিপদ হোক না কেন যেখানে তাকে পোষ্টিং দেবে সেখানে তাকে চাকুরি করতে যেতেই হবে। রমাপদবাবুও বাড়িতে সপ্তাহ খানিক কাটিয়ে আবার দেউড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে চাকুরি করতে গেলেন।
কয়েক মাস চাকুরি করার পর একদিন রমাপদবাবু প্রধান সাহেবকে সেদিনের ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করে বললেন- আচ্ছা, প্রধান সাহেব বলতে পারেন আমি সেদিন ঐভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম কিভাবে! এটা কিভাবে সম্ভব হলো!
তখন প্রধান সাহেব রমাপদবাবুর ঐ ঘটনার জন্য যে কাহিনী লুকিয়ে আছে তা তিনি বলতে শুরু করলেন।
(ক্রমশ……..)

কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর-নামখানা
৪ঠা অক্টোবর,২০১৯

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.