বিজ্ঞানী জগৎজ্যোতি কর

বিজ্ঞানী জগৎজ্যোতি কর
মাষ্টার ডিগ্রি করে একটি প্রাইমারী স্কুলে চাকুরি করেন জগৎজ্যোতি কর। খুব মেধাবী ছাত্র। গরীব বাড়ীর কৃষকের সন্তান। নিজের অক্লান্ত শ্রম দিয়ে তবে তিনি কোনোরকমে মাষ্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করতে পেরেছেন। কিন্তু তারপর যথেষ্ট পরিমানে উদ্দম ফি এবং উদ্যোগ ফি দিতে না পারার জন্য তাঁর কলেজের প্রফেসারী কিংবা হাইস্কুলের মাষ্টারী চাকুরী হলো না। বাধ্য হয়ে তাঁকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে হয়। এতে অবশ্য জগৎজ্যোতির আপত্তি নাই। তিনি মনে করেন এতে আর কিছু না হোক পেটের দু'মুঠো অন্ন তো বাবা মায়ের মুখে তুলে দিতে পারা যাবে।
জগৎজ্যোতি ভারি মিষ্টি একটি মানুষ। ছোটোবেলা থেকে ভারি শান্ত তাঁর স্বভাব। কখনো কারুর সঙ্গে তাঁকে জগড়া বা মারপিট করতে দেখা যায় নি। তাই স্বভাবতই তাঁকে সবাই ভালো বাসে। গরীব বাড়ির ছেলে বলে তাঁকে সব সময় দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশুনা করতে হয়। কখনো তিনি পড়াশুনায় অধৈয্য হন না। তাই সবসময় তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়ে এসেছেন।
জগৎজ্যোতির বাড়ি সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। গ্রামটি কলকাতা থেকে এতাটাই দূরে যে কলকাতা থেকে ঐ গ্রামে পৌছাতে সময় লাগে প্রায় চার ঘন্টা। দক্ষিনবাহিনী গঙ্গার শাখানদীর পাশে জগৎজ্যোতির গ্রাম মনসাদ্বীপ অবস্থিত। মনসাদ্বীপে যেতে হলে নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোনো পথ নেই। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র বিদ্যুৎ পৌছালেও মনসাদ্বীপে এখনো বিদ্যুৎ পৌছায়নি। তাই গ্রামটি যখন রাতের গ্রাসে চলে যায় তখন তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসে অসংখ্য তারার মতো আলোকবিন্দু।
জগৎজ্যোতি অধিত বিদ্যাকে বাস্তবে রুপ দিতে একেবারে সিদ্ধহস্ত। তিনি সব সময় ভাবেন যে অধিত বিদ্যাকে কাজে লাগাতে না পারলে সে বিদ্যা অধ্যয়ন করে কোনো লাভ নেই। তাই সব সময় তিনি চেষ্টা করতেন অধিত বিদ্যাকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে। ছোটবেলা অর্থাৎ সেই ক্লাস এইট থেকে তিনি নানা রকম প্রয়োজনীয় জিনিষ আবিস্কার করতে থাকেন এবং সেগুলি মানুষকে তাক লাগিয়ে দিতো।
তাঁদের গ্রামে পানীয় জলের খুব সমস্যা হতো। কারন তখন গ্রামে জি .আই পাইপ দিয়ে গভীর নলকুপ বসানো হতো। এতে কতকগুলি সমস্যা দেখা দিতো দুই এক বছর পর। কারন জলতল নীচে নেমে গেলে বা পাইপ ফুটো হয়ে গেলে নলকুপ থেকে নোনাজল উঠতো। সেই জল কিছুতেই পান করা যেতো না। আবার কখনো কখনো জলে এতো আয়রণ দেখা যেতো যে নলকূপের জল পানের অনুপযুক্ত হতো। এই সসস্যা সমাধানের জন্য জগৎজ্যোতি চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি প্রথমে চারটি কলসীর সাহায্যে বিভিন্ন দানার বালি দিয়ে পুকুরের জলকে ফিল্টার করলেন। তারপর জীবানুমুক্ত করার জন্য তাকে ফুটিয়ে নিয়ে ঠান্ডা করলেই দিব্যি খাওয়া যায় এবং নলকুপের উপর আর নির্ভর করতে হয় না। সকলেই বইতে পড়েছে। কিন্তু কখনো নিজে পরীক্ষা করে দেখেনি।
একবার খেয়া নৌকা পেরিয়ে তিনি রুদ্রনগরে পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় কোনো অসুবিধা হয় নি। কিন্তু ফেরার সময় খেয়া নৌকাটি খুব বিপদে ফেলেছিল।নৌকার সামনের দিকে একটি কাঠ থাকে যে কাঠে নৌকার দুইপাশের তক্তা একজায়গায় মিলিত হয়। বোট বিল্ডিং এর ভাষায় একে বলে স্টেম। আর জেলেদের ভাষায় একে বলে বুড়ি কাঠ। তাই নৌকা তৈরীর পর এই বুড়ি কাঠকে রীতি অনুযায়ী পুজো করেই তবে নৌকা জলে ভাষানো হয়। এই বুড়িকাঠ নষ্ট হলে হয় তাকে পাল্টাতে হয় নতুবা তাকে ফেলে রাখতে হয়। সাধারনত এই বুড়িকাঠ নিম কাঠের তৈরী হয়ে থাকে। নৌকায় নৌকায় ধাক্কা খেলে বা ঘাটে ভিড়লে সব সময়ই বুড়ি কাঠে ধাক্কা লাগে এবং ক্রমাগত ধাক্কার পর সেই কাঠ তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। জগৎজ্যোতি পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় এই বুড়িকাঠ ভেঙ্গে গিয়ে জল ঢুকতে থাকে। অনেক কষ্টে সেই নৌকোকে মাঝিরা ঘাটে নিয়ে আসে। বুড়ি কাঠের এই সমস্যা সমাধানের জন্য জগৎজ্যোতি ভাবতে থাকেন। শেষে গ্রামের একটি নৌকার বুড়িকাঠে তিনি লোহার একখানা পাত স্ক্রু লাগিয়ে বসিয়ে দেন। তাতে বুড়িকাঠের আয়ুষ্কাল প্রায় দশবছর বেড়ে যায়। তার পর থেকে ঐ প্লেটের নাম হয়ে যায় ' করবর্ম'। জগৎজ্যোতি র টাইটেল হলো কর। তার থেকে নামকরন হলো “করবর্ম”।
জগৎজ্যোতি যখন ফিজিক্স নিয়ে এম. এস. সি শেষ করলেন, তখন তার একটি চাকুরীর দরকার ছিল। কিন্তু এইচ. ডি করার ইচ্ছা থাকলেও পেটের টান তার এই আশাকে পূরণ হতে দিলো না। বাধ্য হয়ে তাঁকে একটি প্রাইমারি স্কুলে চাকুরী নিতে হলো। কিন্তু নিত্য নতুন গবেষনা তাঁকে নেশার মতো টানে। ফলে চাকুরীর পয়সায় সংসার চালিয়ে যে টুকু পয়সা বাঁচে, তাই দিয়ে তিনি নতুন গবেষনার কাজে মেতে রইলেন।
ইতিমধ্যে তাদের দ্বীপে অর্থাৎ তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। এখন ঘরে টিভি চলে। বিজ্ঞানের দয়ায় এখন প্রত্যেকেই বিভিন্ন কোম্পানীর ডিশ অ্যান্টেনা লাগিয়েছে।এবারে জগৎজ্যোতির গবেষণার বিষয় হলো কিভাবে গ্রামের মানুষকে ভিডিওকোন কম্পানী, টাটাস্কাই কোম্পানী বা ডিশটিভি কম্পানীর সম্প্রচারিত হওয়া চ্যানেলগুলি বিনা পয়সায় গ্রামের গরীব মানুষেরা দেখতে পারে তার একটি ব্যবস্থা করা। এর জন্য তাকে একটি এমন সেটটপ বক্স বানাতে হবে যাতে ঐসব কম্পানীর চ্যানেলগুলির সিগন্যাল ধরতে পারবে অথচ কম্পানী কিছুই বুঝতে পারবে না। অর্থাৎ চ্যানেলগুলি চুরি করে দেখা। কাজটি কঠিন জেনেও জগৎজ্যোতি গবেষোনায় হাত লাগালো।
জগৎজ্যোতি কলকাতার চাঁদনী মার্কেটে গিয়ে কিছু আই সি., ট্রানজিষ্টার, ক্যাপাসিটার, ইলেকট্রোলাইটিক ক্যাপাসিটার, বিভিন্ন প্রকার ডায়োড, বিভিনন্ন প্রকার কয়েল, বিভিন্ন ভ্যালুর রেজিষ্ট্যান্ট, বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সফরমার ,তামার ফয়েল এবং পি.সি বোর্ড।এরপর শুরু হলো সেট-টপ বক্স নির্মানের কাজ। দীর্ঘ এক বছর চেষ্টার পর জগৎজ্যোতির মনে হলো তিনি কাঙখিত অ্যান্টেনা আর সেট টপ বক্স আবিস্কার করে ফেলেছেন। এবার শুরু হলো টিভিতে কানেক্ট করে ছবি আনানোর প্রচেষ্টা। কিন্তু টিভিতে কানেক্ট করতে ছবি তো আসেই না! খুব চিন্তায় পড়ে গেল জগৎজ্যোতি । সমস্যাটি কোথায় হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছেন না।
জগৎজ্যোতি অনেকদিন ধরে তার তৈরী ডিস অ্যান্টেনা আর সেট টপ বক্স নিয়ে গবেষনা করছেন। হঠাৎ একদিন তিনি খেয়াল করলেন যে যখনই তিনি সেট টপ বক্স থেকে টিভিতে কানেকশান দেন, তখনই তার শরীরে কেমন যেন একটা আবেশ অনুভূত হয়। তারপর তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি খুব গরম অনুভব করছেন। তখন তাঁর মনে হলো তিমি বোধ হয় ফ্যানটা অন করতে ভুলে গেছেন। জগৎজ্যোতি টেবিল থেকে উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করতে গিয়ে দেখে ফ্যানের সুইচ অন হয়ে আছে! তাহলে ফ্যান ঘুরছে না কেন? লাইনে কি কারেন্ট নেই? ইনডিকেটারের দিকে চেয়ে দেখলেন যে ইনডিকেটার জ্বলছে। অর্থাৎ লাইনে কারেন্ট আছে। তাহলে ফ্যান চলছে না কেন? তাহলে কি ফ্যানটা খারাপ হয়ে গেল!
জগৎজ্যোতি সেট টপ বক্স ছেড়ে ফ্যানের দিকে মন দিলেন। কারণ এতো গরমে ফ্যান না চললে ঘরে বসে কাজ করা যাবে না।যেই না জগৎজ্যোতি সেট টপ বক্স বন্ধ করেছে অমনি আপনা আপনি ফ্যানখানা ঘুরতে শুরু করেছে। জগৎজ্যোতি একেবারে হতবাক। কেন এমন হচ্ছে! তার সেট টপ বক্সের জন্য নয় তো? জগৎজ্যোতি আবার সেট টপ বক্সে লাইন দিলেন। দেখলেন ফ্যান আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে। জগৎজ্যোতি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলন। তিনি বসে বসে ভাবতে লাগলেন। এবার জগৎজ্যোতি সেট টপ বক্স থেকে টিভি কানেকশান ছিন্ন করলেন। রইলো শুধু সেট টপ বক্সের সঙ্গে অ্যান্টেনার কানেকশান। এবার তিনি সেট টপ বক্সে ইলেকট্রিক কানেকশান দিলেন। দেখা গেল আগের মতো ফ্যান আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জগৎজ্যোতি মনে মনে একটি সিদ্ধান্তে পৌছালেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি একটি ছোট সিক্স ভোল্টের মোটর দিয়ে ব্যাটারী চালিত ফ্যান বানালেন। তারপর সেট টপ বক্সে ইকেক্ট্রিক লাইন দেওয়া অবস্থায় ফ্যানটিকে ডিশ অ্যান্টেনার কাছে নিয়ে গিয়ে চালিয়ে দিলেন। ফ্যান কিছুতেই ঘুরে না। এবার সেট টপ বক্সের এলেকট্রিক ছিন্ন করে ফ্যান চালালেন। ফ্যান দিব্যি ঘুরছে। তখন জগৎজ্যোতি সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাঁর সেট টপ বক্সটি রেডিও সিগন্যাল বা অডিও সিগন্যাল রিসিভার হিসাবে কাজ করে নি।নিজের অজান্তে সেটি একটি নতুন ডিভাইসে পরিনত হয়েছে যা থেকে ক্রমাগত এলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী করছে। যার ফলে তার চারপাশে একটি চৌম্বক আবেশের জন্য ফ্যানের ঘুর্নন গতি স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড সৃষ্টি হচ্ছে ডিশ অ্যান্টেনা থেকে! কিন্তু এটা হওয়া উচিত ছিল আউটপুট ডিভাইস টিভি থেকে। ইনপুট ডিভাইস অ্যান্টেনা থেকে নয়। তাহলে কি অ্যান্টেনাকে আউটপুটে লাগালে বেশী অর্থাৎ শক্তিশালী ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী হবে। যেই না ভাবা অমনি আউটপুটে অ্যান্টেনা লাগিয়ে দিলেন। এবার তিনি পরীক্ষা করে দেখলেনএবং সত্যি সত্যি তার ধারনা ঠিক। আউটপুট পোর্টে অ্যান্টেনা লাগানোর ফলে এক তীব্র এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড উৎপন্ন হয় যার ফলে প্রবল বেগে ঘোরা ফ্যান ঝপ করে বন্ধ হয়ে যায়।জগৎজ্যোতি এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। এরকম ফ্যান বন্ধ হয়ে যাওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি হতে পারে। জগৎজ্যোতি চিন্তা করতে থাকে।
সেই সময়টা বর্ষাকাল চলছিল। জগৎজ্যোতি ঐ সেট টপ বক্সটি চালিয়ে কিছু একটা গবেষনা করছিলেন। হঠাৎ তাঁর মা ছুটে এসে জানালো এক অদ্ভুত গল্প। তার মা বললো এখন ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টি হচ্ছে। সর্বত্র বৃষ্টি হলেও আমাদের বাড়িসহ চারপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাতাস বৃষ্টি কিছুই হচ্ছে না বললেই হয়। যেটুকু হাওয়া বা বৃষ্টি হচ্ছে তা সামান্য বলা যায়। অথচ ঐ এলাকা ছাড়া বাকি জায়গায় মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে এবং বেশ ঝড়ো হাওয়া বইছে।এই গল্প শুনে জগৎজ্যোতি ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো। সত্যি মায়ের কথা ঠিক। তবে কেন এমন হচ্ছে। হঠাৎ তাঁর মনে হলো সেট টপ বক্সটার জন্য নয় তো? সঙ্গে সঙ্গে জগৎজ্যোতি দৌড়ে এসে সেট টপ বক্স থেকে এলেকট্রিক কানেকশান বিচ্ছিন্ন করলেন। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের বাড়িও ঝড় জলের মধ্যে ডুবে গেল। আবার জগৎজ্যোতি সেট টপ বক্সে এলেকট্রিকের কানেকশান দিলেন। আস্তে আস্তে আবার পুর্বের মতো তার বাড়ি বাদে সর্বত্র ঝড় বৃষ্টি হতে লাগলো।
এবার জগৎজ্যোতির আর আনন্দের সীমা রইলো না। তিনি বুঝতে পারলেন নিজের অজান্তে এমন একটি যন্ত্র তিনি আবিস্কার করে ফেলেছেন যা মানবজাতির বিশেষ উপকারে লাগবে। এই যন্ত্রের ক্ষমতা বাড়িয়ে যদি সুপার সাইক্লোনের গতিপথে দু 'চারটি যন্ত্র রাখা যায় তাহলে ঝড়ের গতিবেগকে কমিয়ে দিয়ে সাধারন বায়ু প্রবাহে পরিনত করা যাবে। ফলে বিভিন্ন দেশকে ঝড়ের তান্ডব থেকে রক্ষা করা যাবে।কিন্তু এই যন্ত্রের কার্যকারিতার তত্ত্ব এবং যন্ত্রের আবিস্কার বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা “নেচার” এ প্রকাশ করতে হবে। তারপর আন্তর্জাতিকভাবে তার যন্ত্রের পেটেন্ট নিতে হবে।
বেশ কয়েকমাস গবেষনার পর জগৎজ্যোতি তাঁর আবিস্কৃত যন্ত্রের কার্যকারিতার ব্যাখ্যা পেলেন। তাঁর হাতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকায় বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা করে বোঝানো না গেলেও তিনি যে সিদ্ধান্তগুলি নিলেন তা হলো-যন্ত্রটি তড়িৎ প্রবাহের সাথে যুক্ত করলে এক বিশেষ ধরনের এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী হয়। এই ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোন পোলারাইজেশান থাকে না। কারন দন্ড চুম্বকের সাহায্যে এর মেরু নির্নয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যখনই দন্ড চুম্বককে যন্ত্রের এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ডের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন চুম্বকটি তার চৌম্বকত্ব হারিয়ে ফেলে এবং ঐ চুম্বকের মধ্যে এমন এক মেরুর সৃষ্টি হয় যা ঐ এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা বিকর্ষিত হয় এবং দন্ড চুম্বকটি দূরে ছিটকে যায়। ইলেকট্রিক ফ্যান তড়িৎ প্রবাহ দ্বারা সংযুক্ত হলে স্টেটারে এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরী হয়। যার ফলে তাদের ফ্লেমিং এর বাম হস্ত নিয়মে রোটার ঘুরতে থাকে। কিন্তু জগৎজ্যোতির উদ্ভাবিত যন্ত্রে উৎপন্ন হওয়া এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এত তীব্র যে ফ্যানের স্টেটারের ম্যাগনেটিক ফিল্ড নষ্ট হয়ে যায় এবংফ্যানের রোটার স্টেটার পুরোটাই এক অদ্ভুত চুম্বকে পরিনত হয়। তখন যন্ত্রের এলেকট্রিক ম্যাগ্নেটিক ফিল্ড দ্বারা বিকর্ষিত হয় এবং বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু তাই নয় জগৎজ্যোতি আরও গবেষণা করে দেখেছে যে তরল বা বায়বীয় অচৌম্বক পদার্থ তার যন্ত্রের এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংষ্পর্শে এলে তাদের পরমানুর এলেকট্রন এবং প্রোটন কণাগুলির যথাক্রমে নেগেটিভ তড়িতাধান বা পজিটিভ তড়িতাধান হারিয়ে একটি বিশেষ ধরনের চৌম্বক পদার্থে পরিনত হয়। পরমানু তথা অনুতে একপ্রকার চৌম্বক মেরুর সৃষ্টি হয়। সেই চৌম্বক মেরু যন্ত্রের এলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা বিকর্ষিত হয়ে দূরে সরে যায়।যন্ত্রের এই গুনটির জন্য পৃথিবীতে এর প্রয়োজন বড্ড বেশী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যন্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীকে সুপার সাইক্লোনের ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা করা যাবে।
জগৎজ্যোতি তার আবিস্কৃত যন্ত্রের মোটামুটি একটি গবেষনা পত্র বানালেন এবং তা মেল করে পাঠিয়ে দিলেন নেচার পত্রিকায়। ভারতের একটি গ্রামের মানুষের গবেষনা নিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তেমন উৎসাহ দেখালেন না। তারা পত্রিকার ঐ গবেষণা প্রকাশকে তাচ্ছিল্যতো করলেন, উপরন্তু এই ধরনের গবেষনা প্রকাশ করায় পত্রিকার কৌলিন্য নষ্ট হয়েছে বলে সমালোচনা করলেন।
কিন্তু প্রতযোগিতা শুরু হলো বিদেশী মাল্টি ন্যাশান্যাল কোম্পানী গুলিতে। তারা প্রত্যেকে জগৎজ্যোতি র সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং তাঁর আবিস্কৃত যন্ত্রটি দেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে।বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়ার “হপম্যান এণ্ড টারনার এবং “কার্লটন এণ্ড রাদারফোর্ড নামে দুই কোম্পানী তাকে যন্ত্রটি নিয়ে আমেরিকায় তাদের দপ্তরে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রন জানিয়েছেন। প্রথম কোম্পানীর কর্নধার হলেন টম ক্রুজ এবং দ্বিতীয় কোম্পানীর কর্ণধার হলেন লার্সেন গাউন। তারা দুজনেই জগৎজ্যোতিকে হেপাজতে নিতে উদ্দোগী হলেন।
এমন সময় আমেরিকার একটি পত্রিকায় রোনাল্ড ব্রাউন নামে এক বিজ্ঞানীর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে লেখা হয়েছে যে মি ব্রাউন দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে গবেষণা করছেন কি ভাবে সুপার সাইক্লোনের গতিবেগ কমিয়ে সাধারন ঝড়ে পরিনত করা যায়। তিনি অনেকটা এগিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় বিজ্ঞানী মি জগৎজ্যোতি কর তা আবিস্কার করে ফেলায় তার কুড়ি বছরের গবেষোনা পন্ডশ্রম হয়। তাই ডিপ্রেসানে ভুগে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। এই সংবাদ মি ক্রুজ ও মি গাউন শুনতে পেলেন। তারা দু'জনেই আন্ডার ওয়ার্ল্ডের দুই ডনকে লাগিয়ে দিলেন যে ভাবেই হোক মি জগৎজ্যোতি সহ তার উদ্ভাবিত যন্ত্রকে তুলে আনার জন্য।
তখন বঙ্গে শীতকাল। বাংলার আকাশ বাতাস বড্ড বেশী মোহ ময় হয়ে উঠেছে।মাঝারী শীত পড়েছে। স্বচ্ছ আকাশে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। সে চাঁদের আলোয় সারা দ্বীপখানি আলোর বন্যায় ভেষে যাচ্ছে। বাঙ্গালার প্রকৃতির রুপে জগৎজ্যোতি পুলকিত। কিন্তু সে আরো বেশী পুলকিত এই জন্য যে ব্লকের সমস্ত প্রাইমারি এবং হাইস্কুলের শিক্ষকরা মিলে চাঁদা তুলেছে জগৎজ্যোতিকে আমেরিকায় পাঠাবে বলে। আগামী সপ্তাহে ভিসা আর পাসপোর্ট রেডি হয়ে যাবে। তাই তার আনন্দ আর ধরে না।
এমন সময় জগৎজ্যোতি আকাশে হেলিকপ্টাটের শব্দ শুনতে পেলেন। রাত তখন বারোটা। হেলিকপ্টারের বিকট আওয়াজে শান্ত দ্বীপের নির্জনতা খান খান হয়ে গেল। জগৎজ্যোতি দেখলো তার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করলো। আর ঠিক তখনই দেখলো আর একটি হেলিকপ্টার কে উল্কার বেগে ছুটে আসতে সেও তাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে ল্যান্ড করলো।এমন সময় কালো পোষাক পরা চারজন লোক তার বাড়ির কাছে আসতে। তাদের মধ্যে একজন পরিস্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করলো- জগৎজ্যোতিবাবু কে আছেন?
জগৎজ্যোতি এগিয়ে গিয়ে বললো- আমি জগৎজ্যোতি । কি দরকার বলুন?
লোকটি বললো- আমরা হপম্যান এণ্ড টারনার কোম্পানী থেকে এসেছি।আপনি এখুনি আপনার যন্ত্রসহ আপনি নিজে আমাদের সঙ্গে চলুন। আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। বেশী দেরী করবেন না। আমাদের হাতে সময় একদম নেই। আর দেরী করলে আমাদের শত্রু এসে পড়বে। তাতে আপনার বিশেষ ক্ষতি হবে। দেরি করবেন না। বেরিয়ে পড়ুন।
জগৎজ্যোতি বুঝতে পারলো সে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের হাতে পড়েছে। এতোদিন সিনেমায় দেখেছিল। আজ নিজেই সেই স্বাদ পেলো। সে বুঝতে পারলো যন্ত্রটি নিয়ে ওদের সঙ্গে না গেলে তার প্রান সংশয় আছে। তাই যাওয়াই ঠিক করলো । সে তাড়াতাড়ি তার যন্ত্রটিকে ঘর থেকে বের করে আনলো । যন্ত্রটিকে দেখামাত্র একজন অস্ত্রধারী সেটিকে বাজপাখীর মতো ছোঁ মেরে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো।আর একজন জগৎজ্যোতি কে কোলে তুলে নিয়ে ছুটতে শুরু করলো।
এমন সময় অন্য হেলিকপ্টারের লোকেরা তাদের দেখতে পেলো। তারা জগৎজ্যোতিদের দিকে ধেয়ে আসতে থাকলো। কিন্তু হপম্যানের লোকগুলি খুব ক্ষমতাশালী। তারা খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে জগৎজ্যোতিকে নিয়ে হেলিকপ্টারের নিকট পৌছালো।এবং কিছুক্ষনের মধ্যে হ্যালিপ্যাডটি আকাশে উড়তে শুরু করলো।
দুই দলের গন্ডগোলের মধ্যে গ্রামবাসীদের ঘুম ভেঙে গেল। তাদের ঘটনাটি বুঝতে একটু সময় লাগলো। ততক্ষনে জগৎজ্যোতিকে নিয়ে হেলিপ্যাডটি আকাশে উঠেছে। অনোন্যপায় হয়ে গ্রামবাসীরা দ্বিতীয় দলকে ধরার চেষ্টা করলো। মানুষের বিশ্বাস হলো দ্বিতীয় দলকে ধরলে জগৎজ্যোতিকে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।
কিন্তু বিদেশীদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। তারা গুলি চালাতে কোন গ্রামবাসী আর ভয়ে এগোলেন না। দ্বিতীয় দলটি কালবিলম্ব না করে হ্যালিপ্যাড নিয়ে জগৎজ্যোতি দের পিছন ধাওয়া করলো।দ্বিতীয় দলের হ্যালিকপ্টারের গতিবেগ বেশী হওয়ায় জগৎজ্যোতিদের নাগাল পেয়ে গেল। দুইটি কপ্টারই তখন ভাগীরথী নদীর উপর। সেই আকাশেই শুরু হলো গুলির লড়াই।অবশেষে দুটি কপ্টারে আগুন লেগে গেল। কপ্টার দুটি এসে পড়লো ভাগীরথীর মাঝ নদীতে।বিদেশীরা সবাই মারা গেল। মারা গেল গ্রামের বিজ্ঞানী সকলের নয়নের মনি জগৎজ্যোতি । ভাগীরথীর অতলে হারিয়ে গেল জগৎজ্যোতির আবিস্কৃত যন্ত্রটি। আজও জগৎজ্যোতির মা আলু থালু বেশে ভাগীরথীর মোহানায় জগৎজ্যোতিকে ডেকে ডেকে ফেরে।
Copyright@
তারাপদ মাঝি
দেবনগর
জন্মাষ্টমী,১৪২৫
০৩/০৯/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.