পাগলী বুড়ি

পাগলী বুড়ি


আমি প্রতিদিন ট্রেনে যাওয়ার সময় এক পাগলী বুড়িকে দেখি। সে প্রতিদিন রাস্তার পাশে একটি জলনিকাশী ড্রেনে কলমী শাক তুলে কোঁচড় ভরে। কলমী শাক সাপের মতো শরীর দিয়ে প্রায় দু'শ মিটার লম্বা ড্রেনকে আষ্টে পৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। তাই সেখানে কলমী শাকের অভাব নেই। প্রতিদিন অফিস যাওয়ার পথে দেখি কয়েকটা অভাবী বুড়ি খুব যত্ন করে কলমী শাক তুলছে। তাদের সঙ্গে পাগলীটাও শাক তুলতে লাগে। অন্যান্য বুড়িগুলো পাগলীটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পাগলিটা কিছুতেই যায় না।
এইসব দেখে আমার কৌতুহল বেড়ে গেল। ভাবলাম বুড়িগুলো শাক নিয়ে করে কি? কিংবা পাগলিটা বা শাক নিয়ে কি করে? খুব জানতে ইচ্ছে করে। একদিন রবিবার আমি সকাল সকাল নামখানার স্টেশনে এসে হাজির হলাম। দেখলাম পাগলি আর বুড়িগুলো কলমী শাক তুলছে। আমি একটি দোকানে বসে চা সিগারেট খেতে বসলাম আর ওদের লক্ষ্য রাখলাম। প্রায় ঘন্টাখানিক পর বুড়িগুলো শাক তুলে উঠলো।তাদের ব্যাগভর্তি কলমী শাক। তখন সকাল প্রায় সাতটা। তারা একটি কলা জঙ্গলের কাছে গিয়ে শাকগুলোকে ছোট ছোট আঁটি করে বাঁধতে লাগলো। আমি বুঝলাম এরা শাকগুলো বাজারে বিক্রি করবে। সুতরাং এদের নিয়ে আর আমার আগ্রহ নেই।
এবার আমি পাগলিটাকে ফলো করলাম। দেখি সে একটি স্টেশন সংলগ্ন নির্নিয়মান বাড়িতে গিয়ে ঢুকলো। আমি বাড়িটার কাছে গিয়ে পাগলিটা কি করে দেখার ইচ্ছা হলো।তাই বাড়িটার কাছে গেলাম। দেখি বাড়িটা বাড়ির মালিক অনেক দিন আগে শুরু করেছিলেন।উপরে ছাদ আছে, চারদিকে দেওয়ালও আছে। কিন্তু দরজা বা জানালা নেই। দরজাগুলোতে খুঁটি পুঁতে বেড়া দেওয়া আছে। তারপর অর্থাভাবেই হোক,বা শরিকি গন্ডগোলেই হোক কিংবা মামলা মোকদ্দমার জন্য হোক বাড়িটা আর তৈরী হয় নি। অনেকদিন এই অবস্থায় পড়ে আছে। পাগলিটা সেই বেড়াখুলে একটি ঘরে জায়গা নিয়েছে। আমি ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম। দেখি বুড়ির কাছে একটা ছেঁড়া পলিথিন পেপার। পুঁটলি বাঁধা কিছু কাপড়। একটি হাঁড়ি আর স্টিলের  ভাঙা থালা। পাশে পাঁচ সাতটা বোতলে জল পোরা দেখতে পেলাম।
বুড়ি কোঁচড় থেকে শাক বের করে থালায় রাখলো। তারপর সেগুলি ভালো করে বেছে হাঁড়ির ভিতরে দিলো। পুঁটলি থেকে কিছুটা চাল নিয়ে তাকে থালায় একবার জল দিয়ে ধুলো। তারপর সেই চাল হাঁড়িতে তুলে দিলো। এবার নিজের তৈরী উনানে (তিন দিকে তিনটি ইট দিয়ে ঘেরা। ইটগুলির মাঝে খানিক গভীর করে গর্ত খোড়া।)খড় আর কাগজ জ্বালিয়ে খিচুড়ি রান্না করতে লাগলো। তাই দেখে আমি চলে এলাম।
পরের দিন আমি অফিস যাওয়ার সময় দেখি পঞ্চায়েতের লোক ঐ জল নিকাশী ড্রেনটাকে পরিস্কার করছে। প্রায় দশ বারো জন পুরুষ আর মহিলা এক'শ দিনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে। তারা সবাই পাতি ঘাস আর কলমী শাকের হদ কেটে পরিস্কার করছে।  পাতিঘাস আর কলমী লতা কাজের শ্রমিকরা গরুকে খাওয়ানোর জন্য প্রত্যেকে ভাগ করে নিলো। সেই দেখে পাগলী বুড়িটার কি কান্না। বুড়ি যে ভাষায় কথা বলছে সে ভাষা আমরা কেউ বুঝি না। মনে হয় বুড়িটা গুজরাটি ভাষায় কথা বলছে। কেউ না জানুক আমি জানি যে কলমী লতাগুলো বুড়ির আহার ছিল। কলমী লতাগুলো মারা যাওয়ায় তার যে পেট মরে যাবে! ভাবলাম ভগবান এতই নিষ্ঠুর। বুড়ির দুঃখে আমারও কান্না পাচ্ছিল। আমি আর থাকতে না পেরে বুড়িকে ছেড়ে স্টেশনে চলে এলাম। বুড়িটার জন্য খানিকটা মসলা মুড়ি বানিয়ে নিয়ে তাকে দিয়ে এলাম। তাই পেয়ে বুড়ি গোগ্রাসে খেতে লাগলো। দেখে আমার মনে হলো বুড়ি মনে হয় পাগল নয়। তার পরিবারের কোন কঠিন হৃদয়ের মানুষ তাকে এই গঙ্গা সাগরে ফেলে গেছে বা বুড়ি গঙ্গা সাগরে এসে হারিয়ে গেছে।
যাইহোক আমি অফিসে গেলাম। অফিস থেকে ফিরে স্টেশনে আবার বুড়ির খোঁজ করলাম। বুড়িকে পেয়েও গেলাম। আমাকে দেখতে পেয়ে সে হোটেল দেখিয়ে ভাত খেতে চাইলো। আমি না করতে পারলাম না। বরং আনন্দিত হয়ে তাকে হোটেলে খাইয়ে দিলাম। বুড়ি বেশ খুশি এবং তৃপ্ত। ভরপেট খেয়ে সে নামখানার প্লাটফর্মে শুয়ে পড়লো। আমিও আমার বাড়ির পথ ধরলাম।
পরের দিন আবার যথারীতি আটটায় স্টেশনে পৌছে গেছি।গিয়েই বুড়িকে খাওয়ানোর জন্য তার খোঁজ করতে লাগলাম। হঠাৎ স্টেশন মাষ্টারের ঘরে দেখি খুব লোকজনের ভিড়। আমি অনিচ্ছা সত্বেও একবার ঘরের দিকে উঁকি মারলাম। দেখি পাগলী বুড়িটা বেশ ভালো কাপড় পরে বসে আছে! আর একজন ভদ্রলোক স্টেশন মাষ্টারের সঙ্গে কথা বলছেন। সব কথা হিন্দিতেই হচ্ছে। তাদের কথা শোনার পর বুড়ির সব ইতিহাস পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল।
বুড়ির বাড়ি গুজরাটে সুরাটের কাছাকাছি। বুড়ির স্বামী স্ত্রী একটি এজেন্সির সহযোগীতায় সাগরমেলায় ঘুরতে এসেছিল। যে কোন কারনেই হোক বুড়ি সাগর থেকে হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাবার পর বুড়ি কাউকে না পেয়ে লঞ্চে নামখানায় আসে। এখানে এসে ট্রেনে শিয়ালদা যায়। সেখানে আত্মীয়দের খোঁজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কাউকে না পেয়ে আবার নামখানায় ফিরে আসে। তখন নামখানায় মেলা শেষ। কাউকে না পেয়ে বুড়ি দিশে হারা হয়ে  নামখানা শিয়ালদা, কিংবা শিয়ালদা ডায়মন্ডহারবার, শিয়ালদা ক্যানিং ঘুরতে থাকে। অবশেষে নামখানায় বুড়ি পাকাপাকিভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বুড়ির স্বামী এজেন্সীর গাড়ি নিয়ে সাগর ,নামখানা, লট নং এইট প্রভৃতি জায়গায় খুঁজেছে।  কিন্তু বুড়িকে পায় নি। অবশেষে বিভিন্ন পত্রিকায় বুড়ির ছবি দিয়ে প্রচার করেছে। কিন্তু বুড়িকে পাওয়া যায় নি। এই করতে করতে বুড়োর একমাস কেটে যায়। শেষে বুড়ো সিদ্ধান্ত নেন যে বাড়িতে গিয়ে একমাত্র ছেলেকে খবর দেবেন। ছেলে যা হোক কিছু সিদ্ধান্ত নেবে।
বুড়োর ছেলে থাকে কানাডায়। সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং এর চাকুরি করেন। বুড়ো ছেলেকে জানাতে বুড়োর ছেলে চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফির আসে এবং মায়ের খোঁজ করতে থাকে।বিগত ছয় মাস ধরে বুড়ির ছেলে তার মাকে খুঁজতে থাকে। তিনি সাগরে,  নামখানায়, শিয়ালদা, ডায়মন্ডহারবারে,  ক্যানিং প্রভৃতি জায়গায় খুজেছেন। কিন্তু কোথাও পান নি। অবশেষে কাল আমি হোটেলে পেট ভর্তি করে খাওয়াতে বুড়ি অঘোরে প্লাটফর্মে ঘুমাচ্ছিল। আর  বুড়ির ছেলে বুড়িকে খুঁজতে সকালের ট্রেনে নামখানায় আসে। নেমেই ছেলে তার মাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে।
এতদিনে বুড়ির শনির দশা কাটলো। স্টেশন ম্যানেজারের ঘরে ম্যানেজারকে বুড়ির ভোটার কার্ড, আধার কার্ড দেখিয়ে ছেলে তার মাকে কাছে পেল।আমি অনিমেষ নস্কর। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। সামান্য কেরানীর চাকুরী করি। তাই আবেগ একটু বেশী, হৃদয়ও কোমল নারী হৃদয়ের মতো। বুড়ির এতদিনের দুঃখ   দেখে আমি আর চোখের জল সামলাতে পারলাম না।যার বাড়িতে ঝি চাকর থাকে, যার ছেলে একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার তাকে কিনা সাতটা মাস ভিখারীর মতো পাগলিনীর বেশে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে! না, আর সহ্য করা যায় না। আমি ভিড় থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার ট্রেন এসে গেছে।  অফিস আমাকে ডাকছে। একটু পরে ভেঁপু বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল।

copyright@
তারাপদ মাঝি
দেবনগর
৮/০৯/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.