জাঁদরেল বড়শেল অশোকদা

জাঁদরেল বড়শেল অশোকদা

সেদিন ট্রেনে অত্যন্ত ভিড়ে আর অসহ্য গরমে বিরক্ত হয়ে জয়নগর স্টেশনে নেমে পড়লাম। উদ্দেশ্য জয়নগর থেকে অটোগাড়ি ধরে আমার অফিস নারায়নীতলা গ্রামপঞ্চায়েতে যাবো। আমি জয়নগর থেকে অটো ধরলাম। কিন্তু জয়নগরের রাস্তার জ্যাম যে বাংলা বিখ্যাত তা আমার জানা ছিল না। স্টেশন ছাড়িয়ে খানিকটা বারুইপুরের দিকে যেতেই মিত্রগঞ্জে গিয়ে জ্যামে আটকে গেলাম।আমার অটো দাঁড়ালো রাস্তার বাঁদিকের একটি দিঘির পাশে। আমি সেই দিঘি দেখে অবাক। অনেকবার এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছি। কিন্তু এত বড় একটা দিঘি যে আছে তা আমার কোনো দিন চোখে পড়ে নি। আমি আরও আশ্চর্য হলাম যে দিঘির পাড়ে এক এক জায়গায় বসে থাকা বড়শেলদের দেখে। গ্রহবৈগুন্যে আমার গাড়ি যে আটকে গেল তা থেকে কখন মুক্তি পাবো একমাত্র ভগবান জানে।

বেশ কয়েক মিনিট পর যখন গাড়ি ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নাই দেখে আমি অটো থেকে নামলাম। দিঘির পাড়ে বসে থেকে বড়শেলদের ছিপে মাছ ধরার দৃশ্য দেখার জন্য অবোধ শিশু হয়ে তাদের একজনের পাশে গিয়ে বসলাম। চুলোয় যাক অফিস। আজ আমি বড়শেল এর সহকারী হতে চাই।তাইতো খানিক অনুমান করে দেখে বুঝে এক বড়শেল  এর পাশে এসে বসেছি।কিন্তু বিধি বাম। তাই আমার ছিপে মাছ ধরার দৃশ্য আর দেখা হলো না।এখন বর্ষাকাল। হঠাৎ দেখি আকাশ ঘনান্ধকারে ছেয়ে গেল। সঙ্গে শুরু হলো মেঘের তর্জন গর্জণ আর বজ্রধ্বনি। বজ্রপাতের ভয় আমার ছেলে বেলা থেকে। তাই খোলা জায়গায় বড়শেল এর পাশে আর বসে থাকতে পারলাম না। আমাকে উঠতেই হলো৷ অফিস বন্ধ করে আমার এইসব সখ উপভোগ করা বোধ হয় ভগবান সহ্য করতে চান নি৷ তাই এই অসময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সুত্রপাত। ততক্ষনে জ্যাম ছেড়ে গেছে। আমি এসে আবার একটি অটোগাড়িতে বসলাম। উদ্দেশ্য হলো আবার অফিসে যাওয়া। বাউন্ডুলে মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য। ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে আমি অফিসে পৌছে গেলাম। আমি অফিসে ঢোকার পাঁচ সাত মনিটের মধ্যে শুরু হলো প্রবল ঝড়বৃষ্টি আর মুহুর্মুহু বজ্রাঘাত।

আমি প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ অফিসে ঢুকেছি। তা দেখে আমাদের সেক্রেটারী প্রবীনদা বললেন-“কি ব্যাপার তপনদা, এতো দেরী করে এলে যে! তুমিতো এতো দেরী করে আসো না! সাধারনত তুমি দশটার মধ্যে অফিসে ঢুকে যাও। আজ এতো দেরী হলো কেনো?”। আমি দেরী হওয়ার কারণ বর্ননা করলাম। ইতিমধ্যে সবাই আমাদের ঘিরে জড়ো হয়েছে। কারন এলেকট্রিক লাইন চলে গেছে। অফিসে একমাত্র  ইনভার্টারে আলো জ্বলছে। কাজকর্ম সব বন্ধ। এমন সময় আমাদের রিফ্রেশমেন্ট অফিসার সুকুমার ভাই প্রস্তাব দিলো যে এই বৃষ্টির মধ্যে সকলে মিলে খিচুড়ি আর পটলভাজা করলে কেমন হয়। সকলে রাজি হয়ে গেলাম। প্রত্যেকে পঞ্চাশ টাকা করে চাঁদা দিয়ে শুরু করলাম খিচুড়ি উৎসব। এদিকে আমাদের সর্বকনিষ্ট তমালভাই বললো-“ তপনদা এই বর্ষার সময় একটা গল্প বলো। এমনি এমনি ঠিক বসে থাকা যায় না”। সকলে তাকে সমর্থন করায় আমি শুরু করলাম আমার গল্প। বললাম- এই বর্ষায় এক জাঁদরেল বড়শেলার গল্প শোনাবো তোমাদের। দেখবে ছিপে মাছ তুলতে গেলে কি বুদ্ধি আর অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়।তো আমাদের সেক্রেটারীর খোঁচা দেওয়ার স্বভাব। তাই প্রবীনদা বললে- আরে বড়শেল কি? সে কি বস্তু না অন্য কিছু? তাকে কি খায় না গায়ে মাখে? তখন আমি বললাম- বড়শেল হলো সেই ব্যক্তি যার ছিপের সাহায্যে মাছ ধরার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দক্ষ এবং অনেক অভিজ্ঞতা আছে ছিপে মাছ ধরার ক্ষেত্রে। এবার সেক্রেটারী একটা সিগারেট ধরালেন এবং আমাকে একটা অফার করলেন। আমি সিগারেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে শুরু করলাম আমার গল্প।
আজ থেকে প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা। আমি তখন মহিষাদল রাজ কলেজে পড়ি। মহিষাদলেই আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি। সেই বাড়ির কর্তা অশোক মাইতি আমার দূর সম্পর্কের মাসতুতো দাদা হন। তার পরিবারে দুই কন্যা আর এক পুত্র সন্তান আছে। আর আছে অশোকদার স্ত্রী সীমা বৌদি। এই মোট পাঁচজনের পরিবার। আমি যাওয়াতে হয় ছয়জন। আমি থাকা খাওয়ার জন্য টাকা দিতে চাইলেও উনারা সেই টাকা নেন না। বিশেষ করে বৌদির আপত্তি। উনি বলেন যে আত্মীয়ের সঙ্গে টাকা পয়সার লেনদেন রাখতে নেই। অগত্যা আমাকে ভাইপো ভাইঝিদের এটা সেটা কিনে দিয়ে আমার কর্তব্য পালন করতে হয়। কখনো আমার পছন্দের বাজার করে এনে দেই। বৌদি মুচকি হেঁসে বলেন- খুব চালাকি শিখেছো না ঠাকুর পো? আমি বোকার মতো একটু হেঁসে দেই শুধু।কারণ বৌদিকে কিছু বলা যাবে না৷ বৌদি একেবারে দাপুটে মহিলা৷ তিনিই বাড়ির হোম মিনিষ্টার এবং ফিনান্স মিনিষ্টার৷ অশোকদা পর্যন্ত বৌদির উপর বিশেষ কিছু বলতে পারেন না৷ বৌদি অত্যন্ত বিচক্ষন আর বুদ্ধিমতী মহিলা৷

দাদার পরিবারের অভাব নেই। বাড়িতে বিঘা সাতেক জমি আছে। আর মহিষাদল বাজারে আছে একটি তেলে ভাজার দোকান। দোকানে দুইজন কর্মী কাজকরে। প্রতিদিন সকালে দু'কেজি মটরের ঘুগ্নি, একহাজার চপ, একহাজার বেগুনি, পাঁচ কেজি পিঁয়াজের পিঁয়াজি করতে হবেই। এছাড়া ডিমের টোষ্ট, ডিমের কষা, ডিমের অমলেট, ডিম সেদ্ধ ইত্যাদি থাকবেই। বিকালেও একই মেনু থাকে। সব সময় দোকান গম গম করে। এতো পরিশ্রম হয় যে সপ্তাহে একদিন রবিবার দোকান বন্ধ থাকে। তাতে নিজে এবং দোকানের কর্মীরা বিশ্রাম পায়।

অশোকদার এতো কাজের ফাঁকেও একটা সখ ছিল। তা হলো ছিপে মাছ ধরা। এই সখ মেটাতে গিয়ে অনেকবার দোকান বন্ধ করে ছিপ ফেলতে গেছেন৷ আর বৌদিকে তখন দোকান সামলাতে হয়েছে৷ দাদা বাড়িতে ফিরলে তাঁর কপালে জুটেছে অজস্র বকুনি৷ আগে সখ খানিকটা মরে গিয়েছিল। কিন্তু  ইদানিং সেই সখটি খুব চাগাড় দিয়ে উঠেছে। অবশ্য চাগাড় দেওয়ার কারনও আছে। কারনটি হলো -অশোকদার ছেলে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে পড়া বন্ধ করে দিয়েছে।তাই সে এখন বাবার সঙ্গে দোকানে বসে। অন্য দুই কর্মীর সঙ্গে সেও হাত লাগিয়ে দেয়। আবার অশোকদা তাসের আড্ডায় বসে গেলে সে ক্যাশ সামলায়। এখন ছেলে সব বুঝে গেছে। দোকানে সে না থাকলেও ছেলে চালিয়ে নিতে পারবে এই ভরসায় যেখানে সেখানে হুইল ছিপ নিয়ে ছিপ ফেলতে চলে যায়। ছেলেও বেশ খুশি। রাজত্ব এখন তার। অর্থের অবাধ স্বাধীনতা দাদা বৌদি তাকে দিয়ে দেওয়ায় সে এখন রীতি মতো দায়িত্ববান। আমি তার থেকে একবছরের বড় বলে আমাকে “ কাকা” বলে ডাকে। কিন্তু দু'জনের মধ্যে বন্ধুর মতো সম্পর্ক।

সেদিনটা ছিল ১৮ই শ্রাবন। বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টি ধরেই আছে। কিছুতেই বৃষ্টি ছাড়ে না। বৃষ্টি আবার ভারি না। ঝিম ঝিম করে হাল্কা বৃষ্টি। আর আকাশ সবসময় মেঘলা। এমন দিনে দাদা খবর পেলেন যে মহিষাদলের রাজবাড়ির দিঘিতে ছিপ ফেলতে দিচ্ছে। রাজবাড়ির কেয়ার টেকার নোটিশ দিয়েছেন যে সাত দিনের জন্য দিঘিতে বড়শেলরা ছিপ ফেলতে পারবেন। দু'টি ছিপ পিছু পাঁচশো টাকার টিকিট লাগবে প্রতি দিনের জন্য।

এই খবর পেয়ে দাদার আর আনন্দ ধরে না। কারণ দিঘিতে দিনে যদি  একটি মাছও ধরা যায় তাহলে দু'দিনের খরচ উঠে আসবে। সুতরাং সাতদিনের সকাল সাতটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত  আস্তানা হবে রাজবাড়ির দিঘি।

এবার দাদা দু'খানা ভালো হুইলের ছিপ কিনলেন। তাই দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম- এ কেমন ছিপ রে বাবা। সুতো আছে অনেকখানি। কিন্তু সুতোটা আমি আগে কোনোদিন দেখি নি। কারন এই সুতো উন্নত পলি ইথিলিনের ফাইবার জাতীয় সুতো। এর ডায়ামিটার ১.৫ মিলিমিটার । এই সুতো দেখতে সরু হলেও এর ইলাসটিসিটি প্রায় ৩.০মিলিমিটার কর্ড সুতোর সমতুল। এতে পনের কুড়ি কেজি মাছ অনায়াসে তোলা যাবে।আমি বসে বসে দাদার কান্ড কারখানা দেখছি। যুদ্ধ দেখলে যেমন ক্ষত্রিয়ের রক্ত নেচে উঠে, পূজার্চনা দেখলে যেমন ব্রাম্ভনের রক্তের স্রোত বেড়ে যায়, ঠিক তেমনি মাছ ধরার খবর পেলে জেলের রক্ত ছলকে উঠে। দাদার এই কান্ড দেখে আমারও রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করে ছলকে উঠতে লাগলো।

এবার দাদা মাছের চার বানাতে লাগলেন। সংগ্রহ করে এনেছেন বচ, তাম্বুল, একাঙ্কী, সর্ষের খোল, নারিকেলের পচা শ্বাঁস, পচা চিংড়ি, চালভাজা। সবগুলিকে একত্র করে হামামদিস্তায় পেশাই করা হলো। তারপর তৈরী করতে বসলেন মাছের টোপ। দুই প্রকারের টোপ তৈরী করা হলো। একটি হলো- পাউরুটিকে একটুখানি গরম করে তাতে কি মেশালেন জানি না। তবে বেশ খানিকটা দেশী মদ যে মিশিয়েছেন, তা মদের গন্ধ শুকে বুঝে নেওয়া যায়। শালা মাছেরও মদে আসক্তি! এ যে বিশ্বাস করা যায় না!

এবার পরেরদিন দাদা দোকান থেকে আনলেন আলুকষা আর হাতে গড়া রুটি। সঙ্গে কিছুটা ডিমের কষা এবং সিঙ্গাপুরী কলা। এবার আমাকে বললেন-“ ভাই সাত দিনের জন্য তোমার কলেজ বন্ধ। এই সাতদিন তুমি আমার সঙ্গে ছিপ ফেলতে যাবে। তুমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে।দাদার কথা শুনে আমার জেলে রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগলো।আমার পড়ার তেমন চাপ ছিল না। আমি দাদার প্রস্তাব একেবারে লুফে নিলাম। সুতরাং আমারও সাতদিনের ঠিকামা হলো রাজবাড়ির দিঘি।দাদার কান্ড কারখানা দেখে বৌদি গুম মেরে আছেন।আমার সামনে দাদার সঙ্গে ঝগড়া করতে চান নি। তাই মুখে কুলুপ দিয়েছেন।দাদাও বেজায় খুশি৷

আমরা সকাল ঠিক সাতটার সময় দিঘির গেটে গিয়ে হাজির। আমাদের আগে এসে গিয়েছেন আরও অনেক বড়শেল। তো আমরা পাঁচশো টাকার একখানি টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম। আমরা বসলাম একটি আমগাছের তলায়। দু'জনে দু'টো বড় ছাতা নিয়েছি। আমগাছের তলায় ছাতা খাটিয়ে দু'জনে বসে পড়লাম। প্রথমে দাদা দিঘিতে মাছের চার ছড়িয়ে দিলেন। তারপর রুটি আর আলুকষা বের করতে বললেন।দুজনে মিলে বেশ আলু কষা দিয়ে রুটি খেয়ে নিলাম। চার ফেলার আধা ঘন্টার পর দাদা ছিপ ফেলতে শুরু করলেন। আমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। কখন ছিপে মাছ লাগবে। আর আমি ছাকনি জ্বাল নিয়ে মাছকে তুলে আনবো। আমার কান্ড দেখে দাদা হাসতে লাগলেন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন- তোকে দেখলে কে বলবে তুই জেলের ছেলে! আমি বললাম- কেন এমন বলছেন দাদা। আমি কি ভুল করেছি? আরে তুই জানিষ সেই শ্লোকটি?- দাদা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম- কোন শ্লোকটা? দাদা বললেন-“বড়শির মাছ না দেখে খাঁচা, ধনীর বেটা না দেখে মাচা” শ্লোকটি। অর্থাৎ বড়শির মাছ কখন খাঁচা দেখবে,তা যেমন বলা যায়না। ঠিক তেমনি ধনীর বেটাও কখনো মাচা দেখে না যে মাচায় কত ধান আছে। আর তুই ছাকনি জ্বাল ধরে বসে আছিস মাছ তোলার জন্য! বোকা কোথাকার।

দাদার কথা সঠিক প্রমানিত হলো।সারাদিন বসে থাকলাম৷ কিন্তু একটাও মাছ পেলাম না৷ যত সময় গড়াচ্ছে ততই দাদার মুখ শুকনো হতে শুরু করেছে৷ কারন রাতে বাড়ি ফিরে যদি বৌদিকে মাছ না দেখানো যায়, তাহলে বৌদি খুব বকা ঝকা করবেন৷ আমিও চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ আমাকেও বৌদি আসতে না বলেছিলেন৷ হঠাৎ আমার মাথায় এক বুদ্ধি এলো৷ আমি দাদাকে বললাম – দাদা, এক কাজ করলে হয় না? দাদা বললেন- কি কাজ? তখন আমি বললাম- আমরা যদি বাড়ি ফেরার বাজার থেকে কিলো দুয়েক মাছ কিনে নিয়ে বৌদিকে দিলে কেমন হয়৷ দাদার মুখ আনন্দে ভরে গেল৷ আমরা  সময়ের শেষে দিঘি থেকে উঠে বাড়্রির পথ ধরলাম৷ বাজারে গিয়ে দেখি প্রায় জ্যান্ত পোনা মাছ বিক্রি হচ্ছে৷ আমি ওর থেকে বেছে বেছে তিনটে মসছে নিলাম৷ একটা এক কেজি দু'শ আর দুটো মিলে এককেজি আড়াই'শ৷ বাড়িতে আসার পথে বড়শি দিয়ে তিনটে মাছের গাল ফুটো করে দিলাম যাতে বৌদি কোন সন্দেহ করতে না পারে৷ দাদা আমার বুদ্ধির তারিফ করলেন৷

বাড়তে এসে বৌদিকে মাছ দেওয়া হলো৷ বৌদি আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালেন৷ আমার বুকটা শুকিয়ে গেল৷ কিন্তু তা প্রকাশ করতে দিলাম না৷ বৌদি মাছগুলোকে উলটে পালটে দেখলেন৷ তারপর মাছের গাল পরীক্ষা করলেন৷ আমি মনে মনে হাসছি৷ আম্র মনে মনে বলছি- বাবা জেলের বেটার চুরি তুমি ধরবে! সে ক্ষমতা তোমার নাই৷ এবার বৌদি দাদাকে বললেন – এবার তুমি হিসাব দাও৷ কত টাকা টিকিটে, কত টাকা মদে,কত টাকা ছিপে আর চারে গেছে৷ আর ধরে এনেছো মাত্র দু'শ পচিশ টাকার মাছ! আমি তো অবাক! দাদাও অবাক! শালা অ্যাকুরেট মাছের দাম বলে কি করে৷ না কাকতালিয়ভাবে মিলে গেছে!৷ দাদা বললেন-  মদের হিসাব এতে ধরা হবে কেন? তুমি নেশার জন্য সবসময় পান খাও, আমি তেমন নেশার জন্য মাঝে মাঝে মদ খাই৷ তাই নেশার খরচ বাদ দিলে যে আয় হয়েছে তাতে আমাফের কিছুটা ক্ষতিও হয়েছে৷ ও পরেরবার উসুল হয়ে যাবে৷

আমরা পর পর চারদিন এমনি এমনি গেলাম আর ফিরে এলাম। কিচ্ছু পড়লো না৷ চারদিনের প্রতিদিন বৌদিকে বোকা বানানোর জন্য বাজার থেকে মাছ কিনে নিয়ে গেছি৷ বাবার পাঠানো টাকাও শেষ৷ আর যে টাকা আছে তা খরচ হয়ে গেলে বেশ বিপদে পড়ে যাবো৷ শুধু আমরা নই, কেউই কিছু ধরতে পারে নি। অথচ চারিদিনে আমাদের খরচ হয়ে গেছে দুই হাজার টাকা, চারটে পাঁচশো মিলিলিটারের হুইস্কির বোতল, চারটে বিয়ারের বোতল আর মাছের চার ও টোপ।আর বৌদিকে ধোঁকা দিতে চারদিনের মাছ কেনার খরচ  একহাজার দু'শ টাকা৷ দাদা হুইস্কি খেয়েছে আর আমি খেয়েছি বিয়ার। ঝিম ঝিম বর্ষাতে যা লাগছিল না সে আর কি বলবো।

পঞ্চমদিনে দাদা ৬.০মিলিমিটারের শ'ফুটেক দডি আর একটি ইটের টুকরো সঙ্গে নিলেন। চার ফেলার আগে দড়ির একপ্রান্তে ইট বেঁধে দিঘিতে ফেললেন। তারপর সেটা আস্তে আস্তে টানতে লাগলেন। ইট কাছে আসতে তিনি সাবধানে তার গায়ে লেগে থাকা কাদা হাতে নিয়ে শুকতে লাগলেন। শুকেই দাদার মুখ হাসিতে ভরে গেল। আমি বললাম- হাসছো কেন দাদা? দাদা বললেন- হাসবো না? তুইও এই কাদা শুকলে হাসবি। আমি কাদা তুলে শুকতে শুরু করলাম। তাতে গুড়কু তামাকের গন্ধ পেলাম। বললাম- এ তো গুড়াকু তামাকের গন্ধ দাদা! দাদা বললেন- হ্যাঁ রে তাই তো হাসছি। শালা কেয়ার টেকার আমাদের সঙ্গে চিটিং করছে। আমাদের আসার আগে দিঘিতে গুড়াকু তামাক ফেলে দেয়। যাতে তামাকের গন্ধে মাছে ধারে না আসতে পারে। তুই ছিপ ফেললে কি হবে! মাছ তো ধারে আসছে না। তাই ছিপে মাছ গাঁথছে না। বললাম- তাহলে কি করবে? দাদা বললেন- কি করি দেখ না!

এবার দাদা দুটি ছিপের সিঙ্কারের ওয়েট বাড়িয়ে দিলেন। তারপর দাঁড়িয়ে বেশ জোর দিয়ে পঞ্চাশ ষাট ফুট দূরে টোপ ফেললেন। টোপ ফেলার মিনিট দশেক পর হঠাৎ দেখি দাদার ছিপের ফাতনাটি ডুবে গেল। ছিপে লেগে গেল বড় একখানা মাছ।শুরু হলো দাদার সঙ্গে মাছের দড়ি টানাটানি খেলা৷ একবার দাদা টেনে আনে তো পরের বার মাছ দাদাকে টানে৷ তখন দাদা হুইলের সুতো টানতে বাধ্য হন৷ দাদা অনেক খেলিয়ে তাকে ধারে তুললেন। কাছে আসতে দেখা গেল সেটি কাতলা মাছ। ওজন প্রায় সাত কেজি। আমার আর আনন্দের সীমা রইলো না। আমাদের দেখাদেখি সকলেই সিঙ্কারের ওয়েট বাড়িয়ে দূরে ফেলতে শুরু করেছে। এবং ফলও ফলতে শুরু করেছে। সেদিন আমরা তিনখানা মাছ ধরেছিলাম। তিনখানা মাছ মিলে মোট সতের কেজি ওজন হয়েছিল। ছোট মাছটির ওজন ছিল দু' কেজির উপর। বড় দু'টি মাছ  চার হাজার ন'শ টাকায় বিক্রিয় হয়েছিল। সেদিন বৌদির কাছে দু'কিলোর মাছটা ফেলে দিয়ে দাদা বললেন- নাও আজ বড় মাছ ধরেছি। আর হাতে টাকাগুলো গুঁজে দিয়ে বললেন- বড় মাছগুলো বেচে দিয়ে এই টাকাগুলো পেয়েছি। বৌদি বললেন- এত দিনে তাহলে মাছ ছিপে তুলতে পারলে? দাদা বললেন- মানে, প্রতিদিন তো মাছ ধরে এনে দেই। আজকের টা একটু বড়।বৌদি হেসে বললেন- আর মিথ্যে কথা বলো না। প্রতিদিন তুমি বাজার থেকে মাছে কিনে বড়শিতে মাছের ঠোঁট ফুটো করে ছিপে ধরা মাছ বলে চালিয়েছো। আমি কি বিশ্বাস করেছি ভেবেছো? তবে আজকেরটি ছিপে ধরা। আমি আর দাদা হেসে কুটোপাটি।এমন সময় বৌদি আমায় ধমক দিলেন- এই যে ঠাকুরপো দাদাকে তো বেশ কুবুদ্ধি দিচ্ছো দেখছি? আমি বললাম- আমি আবার দাদাকে কি কু বুদ্ধি দিলাম! বৌদি মুখের পান চিবানো পিকটা ফেলে দিয়ে বললেন- বাজার থেকে মাছ কিনে মাছের ঠোঁট ফুটো করে বাড়িতে আনার বুদ্ধি দাদাকে কে দিয়েছিল? আমি আর কিছু বলতে পারলাম না৷ বৌদি এবার বললেন- আমি কুড়ি বছর ধরে মানুষটার সঙ্গে ঘর করছি৷ ওকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি৷ ওর মাথায় এই বুদ্ধি আসবে না৷ এসব চালাকি যে তোমার তা আর বুঝতে বাকি থাকে না৷ এবার তিনি বললেন- বাবা তোমায় কত টাকা পাঠিয়েছিলেন? বললাম- চার হাজার টাকা৷ বোদি এবার বললেন- টাকাগুলো এনে আমায় দাও৷ আমি এবার পড়ে গেলাম ভীষণ ফাঁপরে৷ টাকাতো প্রায় শেষ৷ আছে মাত্র সামান্য ক'টা টাকা৷ ভেবেছিলাম ভাইপোর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে চালিয়ে দেওয়া যাবে৷ তারপর বাবা টাকা পাঠালে ভাইপোকে মিটিয়ে দেবো৷ কিন্তু বৌদি এখনই টাকা চেয়ে বসবেন তা আমার ধারনার অতীত ছিল৷অগত্যা আমার কাছে থাকা বারো'শ টাকা বৌদিকে দিলাম৷ বৌদি বললেন-আমার মেশোমশাই অর্থাৎ তোমার বাবা আজ এসেছিলেন৷ অনেককরে থাকতে বললাম৷ কিন্তু তমলুকে কি একটা কাজের জন্য কিছুতেই থাকলেন না৷ ফেরার সময়  আবার আসবেন এবং থাকবেন বলেছেন৷ আর তোমার জন্য হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে গেছেন৷ কিন্তু তুমি টাকা রাখতে পারবে না৷ সব টাকা আমার কাছে থাকবে৷ তোমার দরকার পড়লে আমার কাছ থেকে চেয়ে নেবে৷ আর যে টাকাটা নেবে তা কিভাবে খরচ করলে আমাকে জানাবে৷ দাদা বললেন- এটা তোমার বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু! তার বাপের টাকা সে যেমনভাবে পারুক খরচ করবে৷ তুমি আটকাবার কে? বোদি ধমক দিয়ে বললেন- থামো তুমি! তুমি জানো ও পয়সা কিভাবে খরচ করে!

আমি এবার বিপদের গন্ধ পেলাম৷ কলেজে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরী হয়েছে সে আমার বড় ভাইঝি বীনা জানতে পেরেছে৷ সেটা বৌদিকে জানিয়ে দিয়েছে৷ তাই বৌদির সামনে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে দাদাকে ঠেলা দিয়ে অন্যদিকে চলে গেলাম৷ বৌদি তখনও কিসব বলে যাচ্ছে আমি আর কান দেই নি৷

পৃথিবীতে নারীরাই হলো পুরুষের অন্তর্যামী। পুরুষ যাই করুক না কেন, নারীর কাছে ঠিক ধরা পড়ে যাবেই যাবে। তাই নারীই অন্তর্যামী, নারীই রণচন্ডী, নারীই দশভূজা দানবদলনী দুর্গা, নারীই শক্তি আবার নারীই ভাগ্যনিয়ন্তা৷ হে নারী হে দেবী তোমায় প্রনাম করি৷
আমার গল্প শেষ। ওদিকে খিচুড়ী রান্না হয়ে গেছে। শুরু হলো খিচুড়ীর ভোজ।

copyright@
তারাপদ মাঝি
দেবনগর
০৭/০৯/২০১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.