#গল্প#রোগীর_আত্মকথা#তারাপদ মাঝিবসে আছি জানালার পাশে। জানালাটি বাড়ির পশ্চিমে। একটি পাল্লা খোলা।। পশ্চিম দিক থেকে বেশ ফুরফুরে হাওয়া বইছে। রোদ ঝলমলে আকাশ হতে যেন আগ্নেয়গিরির তপ্ত লাভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আষাঢ়ের এই গরমে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। তাই ফুরফুরে হাওয়া গায়ে লাগলে আরাম হওয়ার কথা। কিন্তু সেই হাওয়া গায়ে লাগতেই বেশ শীত শীত করতে লাগলো। আর করবেই বা না। ক'দিন ধরে আমি অসুস্থ যে! আমি যে মারণ ব্যাধিতে ভুগছি এবং সব সময়ই গায়ে মৃদু জ্বর থাকে। চলাফেরা আর করতে পারি না। বিছানা এখন একমাত্র আশ্রয়। বাড়ির লোকেরা কোন ক্রমে ধরে ধরে টয়লেটে নিয়ে যায়। ঐ টুকু যাতায়াত করতে প্রান ওষ্ঠাগত হয়। বাকিটা সময় বিছানায় কাটানো ছাড়া কোন উপায় নেই।আমার নাম বিশ্বনাথ বসু। বয়স পঁয়তাল্লিশ। আমি কিডনী অপারেশন করিয়েছিলাম। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছিল। কিন্তু মাস দু'য়েক পর সেখানে যন্ত্রনা শুরু হয়। সেই যন্ত্রনা কিছুতেই থামে না। ডাক্তার দেখানো হলে ডাক্তার আমায় শোনায় যে ওখানে ইনফেকশান হয়েছে। তাই এখন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সামান্য ইনফেকশানে আমার বাড়ির লোক এত উদ্বিগ্ন হবেন কেন? আমি চিন্তায় পড়লাম। একদিন প্রচন্ড ঘুমাচ্ছি এ রকম ভান করে পড়ে রইলাম বিছানায়। তখনই আমায় নিয়ে বাড়ির লোকেরা আলোচনা করতে লাগলো। তখন আলোচনায় জানতে পারলাম যে আমার ক্যান্সার হয়েছে। মনটা ভেঙে গেল। যাহ্, এত অল্প বয়সে মরে যেতে হবে! কিছুই তো করা হলো না। দুই সন্তান যে এখনও নাবালক। উমা কি করে সামলাবে এই সংসারটা। আজ শরীরটা বেশ দুর্বল লাগছে। খিদে একেবারে নেই। খাওয়া বলতে সামান্য একটু ভাত, এক টুকরো মাছ, সকাল বিকাল এক কাপ করে হরলিক্স। বিছানাটা বড় নোংরা হয়ে গেছে! বিছায় শুধু পিঁপড়ে ঘোরা ফেরা করছে পাছা উঁচু করে। রেগে কয়েকটাকে তর্জণী দিয়ে টিপে মেরে ফেললাম। পিঁপড়ে মেরে খুব দুঃখ হলো। কি যন্ত্রনা না পেল পিঁপড়েগুলো! আমিও তো মরবো! এ রকম যন্ত্রনা পাবো! শুধু অপেক্ষা! কখন আসবে সে! আমি কি তাকে দেখতে পাবো! না অনুভূতি পাবো! কি রকম হবে সেই মৃত্যু।জানালা দিয়ে দেখলাম দু'টি ফুটফুটে সুন্দর বাবুই পাখিকে। ফুরুত ফুরুত উড়ছে। তারা দেখি চঞ্চুতে ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে বাসা তৈরীর জন্য। অর্থাৎ আমার মতো সংসার পেতেছে! মনে মনে বললাম-বাঁধিস না, সংসার করিস না। অকালে চলে গেলে কি হবে তোর! বাবুই চলে যাওয়ার পর এলো কি সুন্দর মাথায় ঝুঁটিওয়ালা একটি বুলবুল আর দোয়েল।তারা খানিকটা নেচে গেয়ে আবার কোথায় চলে যায়। তারপর একা একা কিছুটা সময় বসে থাকা। খানিক পরে এলো একটি গিরগিটি আর একটি প্রজাপতি। হঠাৎ দেখি প্রজাপতির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে গিরগিটি। নিমেষে প্রজাপতির স্থান হলো গিরগিটির পেটে। আবার একটি মৃত্যু!এবার আমার স্ত্রী উমা আমার কাছে এলো। হাতে গোটা চারেক কলা আর এক কাপ হরলিক্স। আমি দেখে মুচকি হাঁসলাম। আমার হাঁসি দেখে সে বললো- হাঁসছো কেন?-হাঁসি পাচ্ছে তাই হাঁসছি।-হাঁসি পাচ্ছে কেন?- বলবো না। তুমি দুঃখ পাবে।-কেন দুঃখ পাবো?-আমি যে জেনে গেছি আমার ক্যান্সার হয়েছে! আমাকে বাঁচানোর তোমাদের ব্যর্থ প্রয়াস দেখে আমার হাঁসি পেল।উমা আমার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইলো আর তার চোখ থেকে টপ্ টপ্ করে জল পড়তে লাগলো। আমি আর কিছু না বলে কলা খেতে লাগলাম। উমা হরলিক্সের গ্লাসটা পাশে রেখে দিয়ে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।হরলিক্স খাওয়ার খানিকটা পর, আমার পেটে অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হলো। আমি আর বসতে পারলাম না। বিছানায় লুটিয়ে পড়লাম। যন্ত্রনায় ছটপট করতে লাগলাম। আস্তে আস্তে অপারেশনের সময় মানুষ যে অনুভূতিতে জ্ঞান হারায় আমিও সেভাবে জ্ঞান হারাতে লাগলাম। একসময় আমার শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেল। শরীরে আর কোন ব্যাথা যন্ত্রনা নেই বলে অনুভব করলাম। আমি উঠে বসলাম। কিন্তু এ কি! আমার শরীরটা যে নিথর অবস্থায় বিছানায় পড়ে আছে! তাকে জড়িয়ে উমা অঝোরে কাঁদছে! ঘর লোকে লোকারণ্য! কিছুক্ষন পর দেখলাম আমার বাবা এসে উপস্থিত। বললাম বাব তুমি! বাবা বললে- তোকে নিতে এসেছি যে। তোর যে এখন আমার সঙ্গে যাওয়ার সময় হয়েছে। বললাম- তোমার বউমা যে কান্নাকাটি করছে বাবা! আর একটু থেকে যাই! বাবা বললেন- থেকে লাভ নেই। ঐ প্রথম কয়েকদিন একটু কাঁদবে, তারপর সব ভুলে যাবে। তুই এখানে থাকলে বরং বেশী কষ্ট পাবি। বাবা আমার হাত ধরতেই কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম। হাওয়া হয়ে চলছি তো চলছি। চলা আর শেষ হয় না।হরলিক্স খেয়ে পেটের যন্ত্রনায় শুয়ে পড়েছিলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারি নি। তাতেই দিবা স্বপ্ন দেখছিলাম। উমার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি উমা বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে তেল আর গামছা নিয়ে। দেরি না করে চান করতে চললাম।কপিরাইট @তারাপদ মাঝিদেবনগর২২শা জুন, ২০২২ খ্রীষ্টাব্দ।Add to your postSave
Leave a Comment