রঙ

। রাম বত্রিশের তরতাজা যুবক আর কাজল পঁচিশের ডাগর যুবতী। সৃষ্টি কর্তা যেন দু'জনকে একে অপরের জন্য বোধহয় সৃষ্টি করেছেন। শ্যামলা রামের শরীরের গড়ন একেবারে গাট্টাগোট্টা। আর কাজলও একেবারে নিরেট পাথরে গড়া মুর্তি। দুইটি শরীর যেন গ্রানাইট পাথর কুঁদে তৈরী করেছেন সৃষ্টি কর্তা। আর দু'জনের শরীরেও অসীম শক্তি। তাই তো উজানে সহজেই গুন টেনে এগিয়ে চলেছে।
আর দ'দিন পর দোলউৎসব। গ্রামের প্রায় মাঝখানের ঝাকড়া বুড়ো বটগাছ তলায় ভগবান কৃষ্ণের মন্দিরে পুজো দিয়ে শুরু হবে দোল উৎসব। শুরু হবে রঙের খেলা। ভালোবাসার খেলা। সম্পৃতির খেলা। মন দেওয়া নেওয়ার খেলা।সকালের মৃদুমন্দ দখিনা বাতাসের পরশ অঙ্গে লাগিয়ে শুরু হবে মজাদার রঙ খেলা। এই রকম দিনে কাজল তার প্রিয়তম প্রানাধিক বন্ধুবর রামচন্দ্রের হৃদয় লাভ করেছিল। তাই প্রতি বছর দোলের উৎসব তাদের কাছে একটি বিশেষ মাত্রা বয়ে আনে।
নদীতে প্রবল স্রোত। জোয়ারের টান বলে কথা। উজানে নৌকা চালিয়ে চলেছে রামচন্দ্র বাগ আর তার বউ কাজল। চোট্ট নৌকা। রাম ধরেছে হাল আর গুন টানছে কাজল
হাতে পয়সা না থাকলে কোন উৎসবই সুখকর নয়। তাই পাড়ার অন্যান্য মৎসজীবীদের সঙ্গে রাম আর কাজলও তাদের নৌকা নিয়ে চলেছে লথিয়ানের চরে কাঁকড়া ধরতে। সবার আগে চলেছে রাম-কাজলের নৌকা। তাদের পিছনে আসছে গোপাল বাউলি, নরেন সর্দার,রমেশ বাগ,পঞ্চানন বেরা আর সুশিল বাগের নৌকা। সবাই স্বামী-স্ত্রীতে দলবেঁধে নৌকা বেয়ে চলে লথিয়ানের চরে কাঁকড়া ধরতে।
শিবনগর থেকে সাঁড়ি নদী শেষ করে তারা এসে পড়লো বড় হাতানিয়া দোয়ানিয়ায়। এখানে অনেক নদী এসে মিশেছে বলে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী বড় ভয়ংকর।খুব সাবধানে আড়পাড় হতে হয়। আড়পাড় হলেই লথিয়ান চর। এটি সুন্দরবনের একটি দ্বীপ যা একেবারে ম্যানগ্রোভ বনে ঢাকা। তবে সব সময় যাতায়াত করে তাদের এই নদীকে আর ভয়ংকর বলে মনে হয় না।চলছে রাম হাঁক দিয়ে বলে-“ ও নরেনকা, কুন দিক দিয়া গাঙ পারিব। চন্দনপিড়ি দিয়া যাবো, না হরিপুর দিয়া যাবো?”
-“জোয়ারের টান আছে রাম। চন্দনপিড়ি দিয়া গেলে অনেকদুর উত্তরে টানি লিবে। হরিপুর দিয়া গেলে সবচেয়ে ভালা হবে। তাই হরিপুর দিয়া যাই চ।“
-“তাউ হউ। হরিপুর দিয়া চলো।
সকলে একসঙ্গে হরিপুর দিয়ে নৌকার মুখ পূর্বদিকে করে হাতানিয়া দোয়ানিয়া পাড়ি দিতে শুরু করলো।ঢেউয়ের কল কল শব্দে লহরীর দোলায় নাচতে নাচতে ঘন্টাখানেকের মধ্যে লথিয়ান দ্বীপে পৌছে গেল।যখন ওরা লথিয়ানে পৌছালো, তখন ফরেস্ট অফিসের লোক এসে তাদের বলে গেল যে তারা যেন সাবধানে কাঁকড়া ধরে। কারন বর্তমানে নদীতে কিছু কুমীর ছাড়া হয়েছে।সেগুলি তাদের বিপদ ঘটাতে পারে। ওরা লথিয়ানে গেলে ফরেস্ট অফিসাররা প্রতিবারই এরকমভাবে সাবধান করে যান। সুতরাং এটাতে এতো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ তারা করে নি।
ওরা সবাই দুপুর একটার দিকে যাত্রা করেছিল। বিকাল চারটার দিকে লথিয়ানে পৌছে গেল। এবার হাঁড়িভাঙা নদীতে গিয়ে সবাই অপেক্ষা করবে। তারপর রাতের জোয়ারে সারারাত কাঁকড়া ধরে দিনের জোয়ারে বাড়ি ফিরবে।জোয়ার আসার আগে তারা সবাই কাঁকড়া ধরার জাল আর টোপ রেডি করতে লাগলো।
সারারাত কাঁকড়া ধরে, সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাম আর কাজল তখনো তরতাজা। তারা কাঁকড়া ধরেছে প্রায় একমন।এর দাম বর্তমান বাজারে কম করে হলেও বিশ হাজার টাকা। দোলের আনন্দ পুরা মাত্রায় নিতে পারবে। তাই তাদের আনন্দের সীমা নেই।
সকালের জোয়ার শুরু হয়েছে। এবার তাদের ঘরে ফেরার পালা। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে সবার আগে বাজারে কাঁকড়া নিয়ে যেতে হবে নামখানায়। সবার আগে গেলে সবচেয়ে ভালো দাম পাওয়া যাবে। ফেরার সময় একটা কেওড়া গাছের দিকে তাকালো রাম। কি সুন্দর কেওড়াফল ধরে আছে। থোকা থোকা আঙুরের মতো ঝুলছে।কেওড়া ফল দিয়ে শোল মাছের টক খুব প্রিয় খাদ্য রামের।সে কাজলকে বললো-“এই কাজরী তুই লগি ধরে খানিকটা দাঁড়া দেখি। আমি কয়েকটা কেওড়া ফল তুলি আনি। শোল মাছের টক খাবা”।
-না,গো তুমি যাও নি। গাছটা অতটা দূরে! ওখানে গাছের গোড়ায় জল যাইতে দেরী আছে। অতদূর হাঁটি গাছ পর্যন্ত হাঁটি যাইতে হবে।কুমির আইসতে পারে।না তুমার যায়া কাজ নাই। সে আমি আমসি বা তেঁতুলের টক রাঁধি দিবা।
-দূর পাগলি! তুই ভয় পাউডি কেনি।আমি যাবা আর আইসবা। কুমির আমার কুন করতে পারবে নি। অনেকদিন কেওড়া ফলের টক খাইনি।আইজ কেওড়া ফলের টক খাবা।
কাজলের অনিচ্ছা সত্বেও রাম কেওড়া ফল আনতে গেলো। নৌকা থেকে কাদায় নেমে ফুট পঞ্চাশেক হেঁটে গিয়ে কেওড়া গাছে গিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করলো রাম। অনেক কষ্টে গাছে ঊঠে প্রায় কিলো দুই কেওড়াফল নিয়ে আবার কাদায় হেঁটে নৌকায় ফিরছে রাম।প্রবল জোয়ারের বেগে তখন নৌকার কাছে একহাটু জল।জোয়ারের টানে কাজল নৌকাকে ঠিক সামলাতে পারছে না। লগিটাও পাঁকে অনেকটা পুঁতে গেছে। রাম দেখলো কাজল নৌকাটিকে কিছুতেই তার কাছে নিয়ে যেতে পারছে না। এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গীরা অনেকটা এগিয়ে গেছে। রাম আর ধৈয্য ধরতে পারলো না। সে লুঙ্গীতে কেওড়াফল নিয়ে কোমর জলে নেমে পড়লো।
কাজল আপ্রান চেষ্টা করছে নৌকাকে রামের কাছে নিয়ে যেতে। যখন দেখলো রাম কোমর জলে নেমে এসেছে তখন তার বুক দুরু দুরু কাঁপতে শুরু করেছে। আর তখনই ঘটলো বিপদ। কোথায় ছিল মৃত্যু দূত কুমীর। এক নিমেষে রামকে জলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল। কাজল হায় হায় করে উঠলো। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।তার কান্নার ধ্বনি আকাশ বাতাস মুখরিত করে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো।
তার কান্না শুনে তার গ্রামের গোপাল,নরেন,পঞ্চানন,সুশীল রমেশরা ফিরে এলো।এসে সব কিছু বুঝতে পারলো।কাজল বিহ্বল।কান্নায় আর হতাশায় তার বাহ্যজ্ঞানশুন্য অবস্থা। এদিকে জোয়ারের টানে নৌকা ভেসে চলেছে নামখানার দিকে।গোপাল তার বউকে নৌকা সামলাতে দিয়ে কাজলের নৌকায় ঊঠে পড়ে। তারপরে নৌকাটিকে সেই কেওড়াগাছের কাছে আনে। কেওড়াগাছ তখন পাঁচ ছয়ফুট পর্যন্ত জলে ডুবে গেছে। সব নৌকাগুলি এদিক ওদিক ঘুরছে। যদি কুমীরভায়া রামকে কোনো প্রকারে ছেড়ে দেয়।বা রাম কোন প্রকারে কুমীরের হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসে।
এমন সময় কেওড়াগাছ থেকে কিছুটা দূরে জলে হলো প্রচন্ড আলোড়ন। জল যেন উথাল পাতাল অবস্থা। মনে হয় জলের ভিতরে একটি বিষ্ফোরণ হয়ে গেছে। তারপরে উঠলো টকটকে লাল রক্তের উৎস্রোত।তাই দেখে কাজল ডুকরে কেঁদে উঠলো। তারপরে জলে ভেসে উঠলো রাম আর কুমীর একসাথে।কুমীরটা জলে সাপের মতো ভেসে ক্রমাগত পালটি খেতে লাগলো।দেখা গেল তার চোখে একটি ছুরি আদ্যন্ত গেঁথে দিয়েছে রাম। ফলে রাম মুক্তি পেয়েছে কুমীরের কাছ থেকে।
সবাই মিলে রামকে অনেক কষ্টে নৌকায় তুললো।দেখা গেল তার উরুতে, ঘাড়ে কুমীরের দাঁত আর নখের আঁচড়ে ছিন্ন ভিন্ন। শরীরে কোন ষ্পন্দন নেই যেন। কেবলমাত্র হৃদষ্পন্দন ধুক্ পুক্ করছে।সারা শরীরের বয়ে চলেছে রক্তের ধারা।কাজল রামের শরীরকে কোলে নিয়ে বসলো।সবাই চিন্তা করলো যে যদি নৌকাকে স্রোতের অনুকুলে ভাসিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আধা ঘন্টায় নামখানায় পৌছে গিয়ে রামের চিকিৎসা করা যায়। সে ক্ষেত্রে রাম বেঁচে যেতে পারে। সবাই নৌকা ছেড়ে দিল স্রোতের টানে। তীরবেগে ছুটলো নৌকাগুলি।
নামখানা থেকে রামকে কাকদ্বীপে পাঠানো হলো। কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেছে।রাম তার প্রিয়তমা কাজলকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে। যখন ডাক্তার রামকে মৃত বলে ঘোষণা করলো, তখন কাজল আর থাকতে পারলো না। রামের বুকের উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো-“ওগো তুমি উঠো। কাঁকড়াগুলা অনেকক্ষন খাঁচায় রইলে মারা যাবে যে! ওগুলো বিকব নি? অনেক টাকা হবে গো। সেই টাকায় রঙ লিয়াইসব।এই দেখ তুমার রঙে আমি কেমন রঙ মাখচি। সব লাল রঙ।
তার কান্নায় হাসপাতালের সকলে তার দিকে চেয়ে রইলো। তাদের এই বধুকে কি বা বলার আছে।তাই তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের জলেই কাজলকে রঙের উৎসব পালন করতে হবে। এই বোধহয় বিধির বিধান।

কপিরাইট @তারাপদ মাঝি
দেবনগর
২৩শে মার্চ ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দ।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.