#রঙ _যেন_মোর_মর্মে_লাগে


#রঙ _যেন_মোর_মর্মে_লাগে

হাতানিয়া দোয়ানিয়ার খেয়া পেরিয়ে দেখলাম হাতে আর মাত্র মিনিট সাতেক সময় আছে। ওই সময় টুকুতে কিছুতেই স্টেশনে পৌছানো যাবে না। অথচ আজ যে করেই হোক অফিসে রাইট টাইমে পৌছাতে হবেই। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
এমন সময় দেখলাম, প্রায় এক অষ্টাদশী যুবতী স্কুটিতে চলেছে। রাস্তায় জ্যামের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পরনে জিন্সের প্যান্ট আর শার্ট। মাথায় নিরাপত্তার জন্য শিরস্ত্রান পরা। ফলে চিনতে পারছি না। হঠাৎ মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবলাম আজকালকার মেয়েরা বেশ স্মার্ট হয়। তা এই স্কুটি বাহিনী ললনাও বেশ স্মার্ট। তাহলে ওকে একটু লিফট চাইলে কেমন হয়? প্রত্যাখান করলে করবে। কিন্তু সকলের সামনে বসের ঝাড় খাওয়ার চেয়ে এই হাঁটুর বয়সী পুঁচকিটার কাছে প্রেস্টিজ যাওয়া ভালো।ভাববো আমার মেয়ে ভালোবেসে আমার প্রেস্টিজ হ্যাম্পার করেছে। তাই মেয়েটার কাছে গিয়ে বললাম- ওমা শুনছো?
-হ্যা বলুন। মেয়েটি মৃদু হেসে শিরস্ত্রানের ভিতর থেকে উত্তর দিল।
- বলছিলাম কি, একটু লিফট দেবে মা! আমাকে পয়না বাঁধে নামিয়ে দিলে হবে। তুমি যদি লিফট দাও, তাহলে অফিসে যেতে পারবো!
-মৃদু হেসে মেয়েটি বললো-লিফট দিতে পারি, কিন্তু আমার সঙ্গে আপনার মরতে আপত্তি নাই তো?
-আমি অবাক হয়ে বললাম-মানে?
-মানে আর কিছু নয় কাকু, আমি এখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স পাই নি। ভয়ে ভয়ে রাস্তায় বেরিয়েছি। যদি অ্যাক্সিডেন্ট করি, তাহলে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। তাই মরার কথা বললাম।
-আমিও স্মার্টলি উত্তর দিলাম- তুমি কেন মরবে মা। সেরকম হলে আমারই যেন মৃত্যু হয়। তোমায় যেন ঠাকুর বাঁচিয়ে রাখেন।
আমি আর দেরি করলাম না। স্কুটিতে উঠে পড়লাম। মেয়েটি বেশ দক্ষতার সঙ্গে আমাকে নিয়ে পয়না বাঁধে না নামিয়ে একেবারে স্টেশনে নিয়ে এলো। আমি একেবারে ধন্য হয়ে গেলাম। হাতে তখনো তিন মিনিট সময় আছে।
সৌজন্যবসত জিজ্ঞাসা করলাম- তোমার নাম কি মা?
-মেয়েটি হেলমেট খুলে বললো-আমার নাম চৈতালী কর। বাবার নাম হিমাংশু কর। বাড়ি ঈশ্বরীপুর। চিনতে পারেন আমাকে? আচ্ছা, আপনি সৌমেন রায় তো?
বললাম- তুমি ঠিকই বলেছো মা। আমি সৌমেন রায়। কিন্তু মা তোমায় তো চিনতে পারছি না। ঈশ্বরীপুর সম্পর্কে আমি বিশেষ কাউকে চিনি না। কিন্তু তুমি আমায় জানলে কি ভাবে?
-অবশ্যই বিশেষ কাউকে চেনেন। আর বিশেষ কাউকে চেনেন বলেই আমি আপনাকে চিনি। আপনি অনুপমা দাশকে চেনেন না?
-অনুপমা দাশ!?
-হ্যা, কাকু অনুপমা দাশ?
-আমি এক অনুপমা দাশকে চিনতাম। কিন্তু উনার বাড়ি তো নামখানায়! ঈশ্বরীপুরে নয়।
-উনার বিয়ে হয়েছে ঈশ্বরীপুরে। আমি উনার মেয়ে।
-তার মানে তুমি আমাকে আগে থেকে চেনো!
মেয়েটি আর কিছু বললো না। শুধু মৃদু হাসলো। সেই ভুবন ভোলানো হাসি। ঠিক তার মায়ের মতো। তারপর হেলমেট মাথায় দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল।
ট্রেনে বসে আমি অতীতে হারিয়ে গেলাম। আমার আর অনুপমার ব্যর্থ প্রেমের দিনগুলির কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেন যাত্রা করতে লাগলাম। এখনো মনে পড়ে অনুপমার অকৃত্রিম ভালোবাসা, তার সান্নিধ্য, তার ভালোবাসার অত্যাচার এখনো মাঝবয়সীর বসন্তকে দোলা দিয়ে যায়। ওর ভালোবাসায় ভেসে গিয়ে ওর কত অন্যায় আবদারকে যে আমায় সহ্য করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
যেদিন ও আমাকে এসে বললো যে কুজাত বলে আমার সঙ্গে ওর বাবা বিয়ে দেবে না আর ওর বাবার অবাধ্য ও কিছুতেই হতে পারবে না, সেদিন আমার ভালোবাসার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল। কিন্তু ওকে আরও ভালোবেসেছিলাম এই জন্য যে ওর বাবার প্রতি শ্রদ্ধা দেখে। ও আমাকে এতটা ভালোবাসে যে নিজের মেয়েকে তার প্রাক্তন প্রেমিকের পরিচয় দিয়েছে! আজ অনুপমার মেয়ে মায়ের ভালোবাসার রঙ এই বসন্তে বিলিয়ে গেল। আমি ধন্য ভালোবেসে। আমি ধন্য এই বসন্তে ভালোবাসার রঙ মেখে।
কপিরাইট @তারাপদ-মাঝি
নামখানা-শিয়ালদহ ট্রেন।
১৩ই ফেব্রুয়ারী ২০১৯।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.