নির্বাচনের গল্প

নির্বাচনের গল্প
বলতে বলতে ৯ম পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রায় ঘড়ের উপর এসে পড়লো। নির্বাচনগুলোতে আমরা বেশ কয়েকজন বেশ খাটাখাটুনি করতাম। আমি, উমা, তাপস, হিমাংশু, আব্দুল হাই, দেবাশিষ,বাপ্পা আমরা প্রায় প্রত্যেকে বাড়তি কিছু দায়িত্ব নিতাম। আর আমাদের স্যার অর্থাৎ মাননীয় বি ডি ও সাহেবও আমদেরকে বেশ ভরসা করতেন।তবে আমরা প্রত্যেকে একটা একটা বিশেষ সেলের ষ্পেশালিষ্ট ছিলাম। কেবলমাত্র আমার কোন ষ্পেশাল সেল ছিল না। আমাকে প্রয়োজন মতো যেকোনো সেলে কাজে লাগানো হতো। যেমন পি পি সেলে কাজ করতো তাপস আর আব্দুল হাই শেখ, মুভমেন্ট সেলে কাজ করতো হিমাংশু, মেটিরিয়াল সেলে কাজ করতো দীপংকর, ব্যলোট পেপারে কাজ করতো উমা। এছাড়া সাহেবের নির্দেশ মতো যাকে যেখানে কাজে লাগানো হতো সে সেই কাজ দায়িত্বের সঙ্গে করতো।তাই সাহেবের নির্দেশ মতো আমি কখনো পি পি সেলে, কখনো মেটিরিয়াল সেলে, কখনো বেলোট ইউনিটে, কখনো সেক্টারে, কখনো ডি সি আর সি তে কাজ করেছি। প্রতিটা কাজে কিছু না কিছু স্মরনীয় ঘটনা ঘটেছে। তার দু-একটা আজ শেয়ার করবো। আমার সহকর্মী বন্ধুরা যারা আছো তারা এই ঘটনা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য থাকলে করো। তাহলে এখন আমরা একসাথে না থাকার দু:খটা ভুলতে পারবো।
তা গত পঞ্চায়েত ভোটের একটি স্মৃতির কথা বলা যাক। তখন আমরা কুল্পী ব্লকে কাজ করতাম। বি ডি ও ছিলেন মাননীয় সেবানন্দ পন্ডা মহাশয়। অত্যন্ত মানবিক মানুষ। তিনি আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। আমরাও বেশ শ্রদ্ধা করতাম এবং এখনও করি। আমার দেখা অন্যতম সেরা বি ডি ও। তো অষ্টম পঞ্চায়েত নির্বাচনে পি পি সেলে কাজ করছি আমি,উমা মানে উমাশংকর দলপতি এবং আব্দুল হাই সেখ।আমরা খুব সম্ভব বিকেল ৫ টার মধ্যে সমস্ত পোলিং অফিসার ট্যাগ করে দিয়েছিলাম। সবাই চলে গেছেন। ডি সি আর সি একেবারে ফাঁকা। বি ডি সাহেব এস ডি ও এবং খুব সম্ভব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। আমরা মুভমেন্ট সেলে গিয়ে হিমাংশু আর নিরুপমের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পোলিং স্টেশান থেকে পোলিং অফিসার পাঠানোর অনুরোধ এলে রিজার্ভ পোলিং অফিসার ট্যাগ করে দেওয়ার কাজ করছি। এই করে প্রায় আটটার দিকে স্যার এসে বললেন যে আজ আর পোলিং অফিসারের দরকার হবে না। যা লাগবে কাল অর্থাৎ ভোটের দিন। আপনারা সবাই বাড়ি যান। সারাদিন বেশ ধকল গেছে।বাড়িতে গিয়ে রেষ্ট নিয়ে তরতাজা হয়ে যান। কাল সকাল সাতটার আগে রিপোটিং করবেন। 
তা পরের দিন আমরা যথারীতি সাতটার আগে স্যারের কাছে রিপোর্টিং করলাম।স্যারের নির্দেশ মতো রির্জাভ পোলিং পার্সনদের ডেকে ডেকে প্রয়োজনমতো বুথে পাঠাচ্ছি। রাত্রি আটটার পর থেকে আর কোনো বুথ থেকে পোলিং অফিসার পাঠানোর অনুরোধ আসলো না। রাত দশটার সময় স্যার বললেন আর রিজার্ভ পোলিং অফিসারদের রেখে লাভ নেই। উনাদের রিলিজ করে দিন। উনাদের নিয়োগপত্র আমার কাছে আনুন। আমি রিলিজ করে দিচ্ছি। উমা বললো- স্যার এখনো ভোট শেষ হয়নি। ভোট হয়তো ভোর পর্যন্ত চলবে। তখন যদি পোলিং পার্সনের দরকার পড়ে তখন কাকে কোথায় পাবো। উনি বললেন- দেখুন আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এখন রাত দশটা। প্রায় ফিফটি পারসেন্ট বুথ ফেরত এলো। বাকি বুথ প্রায় হয়ে যাবে। দেখুন মানুষগুলোকে কাল থেকে আটকে রেখেছি। এখন ছাড়লে এখনও তাদের ৭৫% বাড়ি যেতে পারবেন। সেটা কম নয় কিন্তু। আমরা কি উনাদের এটুকু করতে পারি না? সত্যই স্যার মানবিক। উনি সবাইকে রিলিজ করে দিলেন।
কিন্তু আমার মনে কোথাও একটি সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। তা হলো স্যার এতটা সাহস ধরেন কিভাবে। নির্বাচন বলে কথা। যদি পোলিং পার্সনের দরকার পড়ে তাহলে তখন তিনি কি করবেন। কোথা থেকে তিনি সেই ঘটতি পুরণ করবেন। উনার মতো একজন বিচক্ষন মানুষ এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। কোথাও উনার কোনো বড় হাতিয়ার আছে। যার জোরেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি যে আমরা পঞ্চায়েতের কর্মচারীরা হলাম তাঁর তুরুপের তাস। সেটা বুঝতে পারলাম রাত দুটোর সময়। রাত দুটোয় চন্ডীপুর পঞ্চায়েতের জামালপুর বুথে ভোট কর্মীরা আর ভোট নিতে পারছেন না। লাইনে প্রায় শ' দুয়েক লোক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনজন পোলিং পার্সন পাঠান। সেক্টার অফিসার আমাদের কাছে এই ম্যাসেজ পাঠালেন। এবার আমি ভাবছি দেখি স্যার এবার কি করেন। কারন কোন পোলিং অফিসার তো নেই। সবাইকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। এবার স্যার কাকে পাঠাবেন। স্যার আমাদের কাছে এসে বললেন- দেখুন এখন রাত দুটো। হিসেব মতো এখন কোন পোলিং অফিসারের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন যখন হয়েছে, তখন পরিস্থিতি জটিল। এই অবস্থায় পোলিং অফিসার থাকলেও আমি তাদের পাঠাতাম না। আজ এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য উপযুক্ত লোক আপনারা তিনজন অর্থাৎ আমি, উমা আর আব্দুল হাই। তখনই আমি বুঝতে পারলাম "সব বি ডি ও কিন্তু বি ডি ও হয় না। বি ডি ও হতে গেলে নিজেকে কতটা অনুশীলন করতে হয় তা উনাকে দেখে বুঝলাম।"
আমি একেবারে হতবাক। আমি এই অবস্থার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। কুল্পী ব্লক সম্পর্কে আমাদের সকলের একেবারে টনটনে জ্ঞান। চন্ডীপুর পঞ্চায়েতের জামালপুর একেবারে উত্তেজনাপুর্ন বুথ। সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। সেখানে ভোট নিতে যাওয়া বেশ রিস্কি। তার উপর রাত দুটোর সময়! আমি বললাম - স্যার আমি কখনো ভোট নিতে যাই নি। আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। তখন উনি বললেন- জীবনে কোন না কোন কাজ প্রথম করতে হয়। এটা না হয় প্রথম হবে। তাছাড়া আমি আপনাকে যতদুর চিনি, তাতে মনে আপনিও একজন উপযুক্ত ব্যক্তি যে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। তা সত্বেও আমি কিছুতেই যেতে না চাওয়ায় উনি উনার ব্রম্ভাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। উনি বললেন- তারাপদবাবু, আপনি ভাববেন না যে সেবানন্দ পন্ডা বলছি। আমি কিন্তু বি ডি ও এবং রিটার্নিং অফিসার বলছি। এরপর আমার আর উনাকে ' না' বলার সাহস হলো না।
যাইহোক জামালপুরে মেসেজ গেলো যে বি ডি ও র প্রতিনিধি আসছে ভোট নেওয়ার জন্য। আমারা তিনজনকে স্যার যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে টাটাসুমো গাড়িতে ভোট নিতে পাঠালেন। আমরা বুথে গিয়ে দেখি দু' শ নয়, প্রায় চার'শ লোক। আমরা ভোট নেওয়া শুরু করলাম। সত্যি এলেকশানের ট্রেনিং সেলে কাজ করে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা সেদিন আমরা ভোট নিতে প্রয়োগ করেছিলাম। এবং নেজেদের ঢোল নিজে পেটাতে নেই, তবু বলি বুথে উপস্থিত পোলিং এজেন্টরা মন্তব্য করেছিল-" আপনারা যদি প্রথম থেকেই আসতেন, তাহলে ভোট ৬ টায় শেষ হয়ে যেত।" আমাদের দ্বারাই যে এই কাজ সম্ভব, সেটা একমাত্র স্যার বুঝেছিলেন এবং এই প্ল্যান করে মানবিক হয়ে রিজার্ভ পোলিং পার্সনদের ছাড়ার সাহস করেছিলেন।
যাইহোক, ভোর ৫ টায় ভোট শেষ করে সিলিং করে সমস্ত কাজ শেষ করতে প্রায় ছ'টা বাজলো। তারপর একঘন্টা রাস্তা এসে সকাল সাতটায় আর সি তে পৌছলাম। স্যার আমাদের বেশ আপ্পায়ন করলেন। আমরা আসতেই আমাদের দেওয়া হলো মাংসরুটি, ৫০০মি.লি মিনারেল ওয়াটার আর পি পি সেলের প্রাপ্য টাকা ছাড়াও প্রত্যেককে প্রথম পোলিং অফিসারের প্রাপ্য সমতুল অনারিয়াম(একেবারে কড়কড়ে নতুন নোট দেওয়া হয়েছিল)। আমাকে আবার গাড়িতে করে নামখানায় পৌছে দিয়েছিলেন।
সত্যি এরকম স্যার থাকলে কাজ করে তৃপ্তি পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচনের কাজে পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। সেখানে একজন মানবিক বি ডি ও থাকলে কর্মচারীরা নিশ্চিন্তে থাকে এবং কাজের অনুপ্রেরনা পায়। কারন কাজ করতে গেলেই ভুল হবে। আর সেই ভুলগুলো উনি সামলে দিলে তবেই না কাজে মজা পাওয়া যায়। ঐ ৮ম পঞ্চায়েত নির্বাচনে নমিনেশনর সময় যে ভুল করেছিলাম,তা কিভাবে যে উনি সামাল দিয়েছিলেন, সে গল্প আর একদিন হবে।

তারাপদ মাঝি
দেবনগর
১১/০৪/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.