২০ কিলো মৌরালা মাছ

২০ কিলো মৌরালা মাছ
আমার তখন বয়স খুব অল্প। কত বয়স আর হবে, খুব বেশী হলে পঁচিশ তিরিশ। তো তখনকার একটা আভিজ্ঞতার কথা বলি। এই বলে দাদু গল্প শুরু করলেন। তো আমি বললাম- দাদু গল্পটা যেন ভালো হয়, মানে কর্নরোচক হয়। দাদু বললেন- আরে শোন না। গল্পটা শুনলে তুই অবাক হয়ে যাবি। ভাববি এরকম আবার হয় নাকি। আমি বুঝতে পারলাম বুড়ো গল্পের গরুকে গাছে না তুলিয়ে ছাড়বে না। তা হোক। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।
দাদু আবার বলতে শুরু করলেন- শোন ভাই একবছর বন্যা হলো। সেই গল্পটা বলি শোন। তখন আষাঢ় মাসের শেষ। আকাশের ভাব গতিক ভালো না। সুর্যের মুখ দেখা যায় না। সারাদিন শুধু বৃষ্টি পড়ছে।আর দক্ষিন পশ্চিম দিকথেকে হাওয়া বইছে। তখন তো আর আজকালকার দিনের মতো আবহাওয়ার পুর্বাভাস পাওয়া যেত না। তাই আমাদের সতর্ক হওয়ার কোন ব্যবস্থাই ছিল না। ফলে পেটে ফোঁড়া হলেও যা আর ক্যানসার হলেও তা। আবার তখন পাকার বাড়িও ছিল না। ফলে ঝড়বৃষ্টি হলে, বন্যা হলে মানুষকে বেশ কষ্টভোগ করতে হতো।কত মানুষ যে না খেতে পেয়ে মারা যেত, তার ইয়ত্তা নাই।
তা আমরা সবাই বাড়িতে বসে বৃষ্টি বাদলের কথা ভাবছি।ছেলেরা সব হইচই করছে।আর আমি বসে বসে তামাক খাচ্ছি।এমনিতে অভাবের সংসার। তার উপর যদি বন্যা হয়, তাহলে ছেলেপুলেগুলোকে মানুষ করা যাবে কিভাবে। ঠিক এমন সময় উঠলো প্রবল ঝড়। সে কি বাতাস। মোটা মোটা গাছগুলোকে ভেঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাড়ি ছাড়া কাহারও বাড়ি আস্ত নাই। আমার বাড়ি নদীর উচু বাঁধের কোলে।বাতাস যা বয়, বাঁধে ধাক্কা খেয়ে বাড়ির উপর দিয়ে পালায়। কিন্তু খানিক পরে নদীর জোয়ার এতো বৃদ্ধি পেলো যে, বাঁধ আর সইতে পারলো না। ভেঙ্গে গেল।তাতেও আমার বাড়ি রক্ষা পেল।কারন আমার বাড়ি বাঁধের গোড়ায় হওয়ায় ওখানকার বাঁধ ভাঙে নি। বাড়ির দুপাশে দু'জায়গায় ভেঙেছে।জলের গতি সামনে।ফলে বাড়ি রক্ষা পেল।
খানিক পরে ঝড় থামলো। গোটা গ্রাম জলে থই থই। মানুষ আর গরু ছাগল সবাই ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি একা কাকে বাঁচাই আর কাকে ছাড়ি। তারপর বুকে সাহস নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম। সবাইকে টেনে এনে আমার বাড়িতে রাখতে শুরু করলাম। আমি এবার বুঝলাম- সালা বুড়ো এবার গুল দিতে শুরু করেছে। আমি যতদুর জানি মামার মাটির বাড়িটা কখনো পচিশফুট বাই কুড়ি ফুটের বেশী ছিল না। তাই তার চালের খড় কোনো বছরই ভালো থাকতো না। বড় বড় গাছ ভেঙ্গে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর বুড়োর বাড়ি টিকে আছে গ্রামের মানুষকে বাঁচানোর জন্য! সালা গাঁজাখুরি গল্প বলারও সীমা আছে।কিন্ত আমি কিছু বললাম না। বুড়ো দু' একটা আজগুবি গল্প বললেও বাকিগুলো মোটামুটি বেশ ভালো হয়। তাই ফোড়ন না কেটে চুপ করে রইলাম।
বুড়ো আবার বলতে শুরু করেছে। আমি সাধ্য মতো আমার বাড়িতে যত লোককে রাখা যায় তাই রাখলাম। তাও কম লোক নয়।প্রায় আড়াই'শ জন লোক আমার বাড়িতে ঠাঁই হলো। বাকি লোক কেউ গাছের উপরে, কেউ ভাঙ্গা বাড়ির চালে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। এতগুলো লোককে খাওয়াবো কি! আমাদের যা আছে তাতে আমাদের পরিবারের পাঁচদিনের মতো চলতো। কিন্তু সবাইকে না দিয়ে তো আমরা খেতে পারি না! আমাদের খাদ্য সকলকে খাওয়ালে একবেলাই হবে। তা যাই হোক রাতটা কোনো রকমে কাটলো। সকাল হতে দেখি সারা গ্রাম জলে থই থই করছে। আমার বাড়িতে যারা ছিল, তাদেরকে দুপুরে ভাত খাওয়ানো হলো।যেটুকু বেশী হলো গ্রামে আর যারা আছে তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হলো। আমি সবাইকে বললাম- মরলে সবাই এক সঙ্গে মরবো। আমাদের খাদ্য বলে কিছু হয় না। এই খাদ্যে সকলের অধিকার আছে।
এবার পড়লাম আরও চিন্তায়। এতগুলো লোকের খাদ্যের ব্যবস্থা হবে কিভাবে! অনেক ভেবে ঠিক করলাম- বন্যার সময় মাছের অভাব হবে না। মাছ ধরে সকলকে খাওয়ানো যেতে পারে। আমাদের গোয়াল ঘরে যা কাঠ আর ঘুঁটে আছে, তাতে অন্তত ৫০০ জনের খাদ্য একমাসের মতো রান্না করা যাবে। তাই বড় বড় পেরেক বাঁশের মাথায় লাগিয়ে বর্শার মতো বল্লম বানানো হলো পাঁচ খানা। তাই নিয়ে পাঁচজন জোয়ান ছেলে নিয়ে আমি রাতের বেলা মাছ শিকারে বের হলাম। আমার হাতে টর্চ লাইট। আমরা ছয়জনে এগিয়ে চলেছি। বাদার জল নদীবাঁধের ভাঙ্গা জায়গা দিয়ে যেখানে বের হচ্ছে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সালা মাছগুলোকে এখান দিয়েই যাতায়াত করতে হবে। ফলে এখানেই মাছ ধরার সুবিধা।
আমি সবেমাত্র লাইট জ্বালিয়েছি।এমন সময় দেখি কয়েকটা মাছ আমাদের দিকে আসছে। আমি ছেলেগুলোকে লাগিয়ে দিলাম। তারা পাঁচজনই অনেক লড়াই করে পাঁচখানা মাছ ধরলো। বেশ বড় বড় মাছ। এক একটা প্রায় কুড়ি কিলো। মাছগুলা কাছে আনতেই দেখি সেগুলা মৌরালা মাছ! বেশ জব্বর খাওয়া হবে ভেবে আমাদের আর আনন্দের সীমা রইলো না।
আমি আর চুপ করে রইতে পারলাম না। প্রতিবাদ করতেই হলো। বললাম- আর ঢপের গল্প দিও না দাদু। সালা যে মাছের ওজন দু'গ্রাম তাকে তুমি কুড়ি কিলো বানালে! আর একটা কথা বলি- গ্রামের ভালো বাড়িগুলো ঝড়ে ভেঙ্গে গেল। আর তোমার ভাঙ্গাবাড়ি আর গোয়ালঘর আস্ত রইলো? গোয়ালে মাত্র একখানা গরু। আর বাস্তুতে মাত্র পাঁচখানা খেঁজুর গাছ। তাই দিয়ে ৫০০ জনের এক মাসের রান্নার জ্বালানী হয়?তোমার কতবড় পেরেক গো। তাই দিয়ে তুমি বল্লম বানালে আর তাই দিয়ে কুড়ি কিলো মাছ ঘায়েল করলে?
আমাকে থামিয়ে দাদু বললে- আর কথা বলিস না ভাই।আমার কথাগুলো তোর বিশ্বাস হচ্ছে না তো! তুই ঠিক ভেবেছিস। আসলে কি জানিস- তোদের আধুনিক সমাজে সব আছে শুধু বিশ্বাসটুকু নাই।সন্তান তার পিতা মাতার কাছে বিশ্বাস হারিয়েছে,স্বামী এবং স্ত্রী পরস্পরের কাছে বিশ্বাস হারিয়েছে,শিক্ষক ও ছাত্র পরস্পরের কাছে বিশ্বাস হারিয়েছে।আমি যে মানুষ, আমি প্রাচীন হলেও আমার একটা পছন্দ অপছন্দ আছে সেটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। ফলে তোদের পছন্দকেই আমাদের মেনে নিতে হয়।আমার গল্পটা আজগুবি বলে তুই প্রতিবাদ করলি, আর আমার চাষের জমি বেচে ব্যাংকে টাকা রাখলে বেশী লাভ এই ধারনাকে আজগুবি মনে হওয়াতে সেটা আমার অপরাধ হলো। আর তার শাস্তি স্বরুপ আমার নিজের বাড়ি ছেড়ে তোদের বাড়িতে থাকতে হয়েছে।তোর অনুরোধে তোর মামার আবদার মেনে নিতে আমার কোনো কষ্ট হয় নি। আর আমার আজগুবি গল্পটা শুনে তুই যে ফুটুনি কাটছিস তার বেলা!
আমি বেশ ব্যাথা পেলাম।সালা বুড়ো আমায় আচ্ছা শিক্ষা দিলেন। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম বুড়োকে কোনো অবস্থাতেই কাছছাড়া করবো না।

তারাপদ মাঝি
নামখানা শিয়ালদহ ট্রেন
২০/০৪/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.