#জহুরা_বিবি
#গল্প
#জহুরা_বিবি
#তারাপদ_মাঝি
আমি তখন চন্ডীতলা গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করি। তো একদিন এক মহিলা আমার কাছে এসে বললেন- জব কার্ড করতে গেলে কি কি লাগবে?
-বললাম-জবকার্ড করতে গেলে যাদের জব কার্ডে নাম তুলতে হবে তাদের প্রত্যেকের ভোটের কার্ডের জেরক্স, আধার কার্ডের জেরক্স, নিজেদের ফটো, নিজ নিজ ব্যাঙ্কের পাশ বইয়ের জেরক্স, পঞ্চায়েতের ট্যাক্সের রসিদ এই সব ডকুমেন্ট লাগবে। তারপর বললাম- এখন তো জবকার্ড দেওয়া যাবে না। সরকার থেকে জবকার্ড দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
-আমার কথা শুনে মহিলা চোখ পাকিয়ে কেমন একটা মুখভঙ্গি করে বললেন- জবকার্ড বন্ধ আছে না খোলা আছে সে আমি বুঝে নেব। কিভাবে জবকার্ড বের করতে হয় সে আমি জানি। এই বলে আমাকে এক রকম শাসিয়ে চলে গেলেন।
আমি তো একেবারে অবাক। মহিলা অফিসে থ্রেট দিয়ে চলে যাচ্ছে! আমার অন্যান্য স্টাফেরা তা দেখে কিছুই বলছে না! আমি একেবারে কিংকর্তব্য বিমুঢ় হয়ে গেলাম।
এমন সময় প্রধান অফিসে ঢুকলেন। উনি অফিসে ঢুকতেই আমার এক সহায়ক বললেন- প্রধান সাহেব, জহুরা বিবি এসেছিল। সেক্রেটারীকে শাঁসিয়ে গেছে। বলেছে জবকার্ড কিভাবে বের করতে হয় সে নাকি ভালো করে জানে। তারপর প্রধান সাহেব সহায়কের কাছ থেকে সব কিছু শুনলেন এবং তারপর জহুরা বিবিকে ফোন করে অফিসে ডাকলেন।
ঘন্টাখানিক পর জহুরা বিবি অফিসে এলেন। প্রথমে আমি ঐ মহিলাকে ভালো করে দেখি নি। এখন দেখলাম। মহিলা একেবারে স্থুলকায়া যাকে বলে দশাসই চেহারা। গায়ের রঙ কালো হওয়ার জন্য উনাকে আরও ভয়ংকর লাগছিল। কথায় কথায় জানলাম উনি পার্টির একনিষ্ট কর্মচারী এবং যেকোন জায়গার মিটিং এর লোক জোটানোর জন্য পার্টি উনার উপর পুরোপুরি নির্ভর করে।ফলে স্বাভাবিকভাবেই উনার একটু লপঝম্প তো হবেই।
জহুরা বিবিকে ডেকে প্রধান বললেন- তুমি সেক্রেটারীকে কি বলেছো?
-কাকে, ঐ কালোদাকে? বলে আমার দিকে তাকিয়ে উনি হাঁসলেন। অফিসের সবাই উনার কথায় হেঁসে উঠলো।আমিও আর না হেঁসে থাকতে পারলাম না।
-এবার প্রধান গম্ভীর হয়ে বললেন- আমাদের পঞ্চায়েতে আজ পর্যন্ত কোন কর্মচারীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি। কর্মচারীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে পঞ্চায়েতের বদনাম হয়। তখন সেই পঞ্চায়েতে কোন কর্মচারী আসতে চায়না। আর যদিও বা আসে সেখানে বেশীদিন থাকে না। তাছাড়া সন্ত্রাস সৃষ্টি করা আমার পঞ্চায়েতের কালচার নয়। তাই তোমার ব্যবহারে পঞ্চায়তের ক্ষতি হয়েছে। তুমি সেক্রেটারীর কাছে ক্ষমা চাইবে।
এবার জহুরা বিবি গম্ভীর হলেন এবং বার বার হাত কচলাতে লাগলেন। অবস্থা দেখে আমি বললাম- প্রধান সাহেব, উনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না। তবে এবার থেকে উনি যেন পঞ্চায়েতে এসে সংযত আচরণ করেন, আমি শুধু এই অনুরোধ রাখবো।
-২-
সেদিন থেকে পন করেছি যে জহুরা বিবিকে আমি এতটাই ভালোবাসা দেব যে একদিন ও আমার জন্য চোখের জল ফেলবে।তারপর জহুরা বিবি, পঞ্চায়েতে এলে একেবারে হামলে পড়ে বলতাম- দিদি, কেমন আছেন?
-উনি রেগে গিয়ে বলতেন- আমায় দিদি বলে ডাকবে না। আমি কি তোমার থেকে বড় নাকি?
-আমি বলতাম- শুধু বড় হলেই কি লোকে দিদি ডাকে! ছোটদেরকে কি আদর করে দিদি ডাকা যায় না?
-উনি তখন বলতেন-সবাই দিদি বললে, আমি যাই কোথা। আমার কি ভালো মন্দ স্বাদ আহ্লাদ নেই! বলে উনি মুখ টিপে হাঁসতেন।
এইরকমভাবে জহুরার সঙ্গে আমার দূরত্ব কমতে থাকে। সেই দূরত্ব কমতে কমতে একদিন ঘনিষ্টতর হলো। আমার আর জহুরা বিবির মধ্যে একটি অব্যক্ত সম্পর্ক গড়ে উঠলো যা আমরা পরষ্পর অনুভব করি কিন্তু বলতে পারি না।
একদিন আমি জহুরা বিবির পাড়ায় এনকোয়ারী করতে গেছি। খান পাঁচেক বাড়ি ঘুরতে হবে। সেই মতো হাতে সময় নিয়ে বেরিয়েছি। আমি ঠিক করেছি এনকোয়ারী সেরে, পাঁচটার ট্রেনে বাড়ি ফিরবো। সময় শ্রাবন মাস। দুটো বাড়ি এনকোয়ারী করার পর নামলো মুষলধারে বৃষ্টি। আমার সঙ্গে আছে জহুরা বিবি। বৃষ্টি কিছুতেই ছাড়ে না। বৃষ্টি যখন থামলো, তখন রাত আটটা। আমার বাড়ি ফেরার শেষ ট্রেনটি সাড়ে সাতটায় চলে গেছে।
অগত্যা জহুরার অনুরোধে জহুরার বাড়িতে থেকে গেলাম। আমার কিছুতেই ওখানে থাকতে মন চাইছিল না। কিন্তু ওদের পাড়ার সকলের অনুরোধে জহুরার বাড়িতে থাকলাম।
জহুরার বাড়ি খুবই সাদামাঠা। দুই কামরা বিশিষ্ট দুইচালা টিনের ঘর। এতেই তার মায়ে পোয়ে বেশ কেটে যায়।ছেলেটির বয়স বছর পনের মতো হবে। আমি যেতে ও খাওয়া দাওয়া করে মাদ্রাসার হোষ্টেলে শুতে চলে গেল।আমাকে বলে গেল- চাচা, আপনি আমার ঘরে শোবেন। তাই আমি মাদ্রাসার হোষ্টেলে শুতে গেলাম। বললাম- মাদ্রাসায় যাওয়ার দরকার নেই। চাচা ভাতিজায় এক বিছানায় শুলেই হলো। কিন্তু ছেলেটি শুনলো না। সে নিকষকালো অন্ধকারে বেরিয়ে গেল।
বিছানায় শুয়ে অনেক কিছু ভাবতে লাগলাম। একাকী ঘরে আমি। গৃহকর্ত্রী একজন মহিলা। সেও একা। যদি আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে, তাহলে আমি ফাঁসতে বাধ্য। সবে একটু তন্দ্রামতো এসেছে, এমন সময় জহুরা ঘরে ঢুকলো। বললো দাদা আলো বন্ধ করে শুয়েছেন কেন?
-বললাম- আলো বন্ধ না করলে যে আমার ঘুম আসে না। তাই আলো বন্ধ করে শুয়েছি।
তারপর জহুরা আর ঘুমাতে দিল না। আমার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। আমার কথা, আমার পরিবারের কথা সে বিস্তারিত জানলো। আমাকেও তার স্বামীর মৃত্যুর কথা, জীবন সংগ্রামের কথা ইত্যাদি জানালো।একসময় ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে তাকে যে দেহ বিক্রি করতে হয়েছে তাও সে জানালো। তার দুঃখের কাহিনী শুনে আমি প্রায় কেঁদেই ফেললাম। আমার তখন ইচ্ছা করছিল তাকে এই কথা বলতে যে জহুরা তোমার দুঃখের দিন শেষ। আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমার দৈহিক চাহিদা ছাড়া আর সব রকম চাহিদা আমি মেটাতে পারি। তুমি আর চোখের জল ফেলো না।কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতির কথা ভেবে আমি তা করতে পারলাম না।
এই ঘটনার পর থেকে জহুরা প্রায়ই আমার জন্য তার বাড়ি থেকে খাবার আনতো। তাকে বারণ করলেও সে শুনতো না।এই নিয়ে অফিসে সবাই হাসাহাসি করতো।আমি ওসব গুরুত্ব দিতাম না। এভাবে বছর তিনেক কেটে গেল। এর পর আমার ট্রান্সফারের অর্ডার হলো। আমাকে অফিস থেকে ফেয়ার ওয়েল জানালো।
জহুরা একটি শালের চাদর আমাকে দিয়ে বললো- এটা দিলাম দাদা। যখন এটা পরবে তখন মনে করবে তোমার জহুরা তোমায় জড়িয়ে ধরেছে। তখন পারলে এই অভাগীর জন্য একটু দোয়া করো। এই বলে সে কাঁদতে লাগলো।আমি বাকরুদ্ধ হলাম। পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপ না হয়, আমি তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম।
আজ এই আশি বছর বয়সে এসে জহুরার কথা বেশ মনে পড়ছে। আমি ওখান থেকে চলে আসার পর কিছুদিন ফোনে কথা হয়েছিল। তারপর আমি কাজের মধ্যে ডুবে যাই।জহুরা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতল সাগরে। রিটায়ার্ড হওয়ার পর একদিন খবর পেলাম যে জহুরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর
৩০ শা আগষ্ট, ২০২১
Leave a Comment