#অজয়বাবু_এবং_তার_মেয়ে


#গল্প

#অজয়বাবু_এবং_তার_মেয়ে

#তারাপদ_মাঝি


অজয়বাবু প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। কুড়ি বছর শিক্ষকতা করে তিনি কিছুই করতে পারেন নি। অর্থাৎ জমি বা বাড়ি কিছুই করতে পারেন নি। আর করবেন  কি করে!! শিক্ষকের বেতন কম। তাও আবার প্রতি মাসে পাওয়া যায় না। দুই তিন মাস করে বাকি পড়ে থাকে। তখন গ্রামের মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হয়। সেই টাকা আর কিছুতেই শোধ হয় না। ধার শোধ হলেই আবার ঋণ হয়ে যায়। 


অজয়বাবু তাই বড় চিন্তায় পড়ে গেছেন। চাকুরি আর কুড়ি বছর আছে। এই কুড়ি বছরে তিন মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। এক ছেলেকে মানুষ করে তুলতে হবে। কিন্তু এই চাকুরীর উপর ভরসা করলে হবে না। অন্য কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কি করবেন? অনেক ভেবে ঠিক করলেন যে নামখানা বাজারের ফুটপাতে খুচরা পান বিক্রি করবেন। সঙ্গে রাখবেন সুপারী। তবে গোটা নয়। কুচানো সুপারী। মাত্র একশো টাকা মুলধন নিয়ে অজয়বাবু ব্যবসায়ে নামলেন।


অজয়বাবু তিরিশ টাকা দিয়ে পাঁচশো মাঝারী সাইজের পান এবং ষাট টাকা দিয়ে এক কেজি সুপারী কিনলেন। সেই সুপারী তিনি গিন্নিকে দিলেন। তিনি তার পান খাওয়ার জাঁতি দিয়ে দু তিন দিনে কুচিয়ে দিলেন।  সেই কুচানো সুপারী তিনি প্রায় দেড়গুন দামে বিক্রি করতে লাগলেন। এইভাবে অজয়বাবু মোটামুটি ব্যবসাটি বুঝে নিলেন। ব্যবসার পরিধী বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সঙ্গে তিনি বাঁধানো ঝাঁটা, কুস্তে, চুপড়ি ইত্যাদি বেচতে লাগলেন। সিজিনের সময় সিজিন ব্যবসা শুরু করলেন। যেমন লক্ষ্মী পূজার সময় লক্ষ্মী গনেশের মুর্তি, কাচ্চা আর কাঁচা গোটা সুপারী বেচেন। আবার দোলের সময় নানা রঙের আবির বেচেন এবং কালী পূজার সময় মোমবাতি বেচেন। এতে বেশ পয়সা আসতে থাকে। বলতে গেলে নিজের বেতন থেকেও বেশী রোজগার হয়। সকাল থেকে দশটা পর্যন্ত দোকানদারী করে কোন রকমে কিছু খেয়ে বাজার থেকে এক মেইল দূরে স্কুলে চলে যান। তারপর তিনটের সময় স্কুল থেকে ফিরে কিছু মুখে গুঁজে আবার দোকানে বসেন সেই রাত ন'টা পর্যন্ত।


অজয়বাবু দেখলেন যে একটা করে পান ফাউ দেওয়া ভালো, কিন্তু পয়সা কম নেওয়া যাবে না।  কারণ অজয়বাবু দেখলেন যে পয়সা কম নিলে সঠিকভাবে লাভ পাওয়া যায় না। এতে তার প্রতিদিন কুড়ি থেকে তিরিশ পয়সা লাভ কম হয়। অর্থাৎ এইভাবে তার বছরে অনেক পয়সা লোকসান হবে। 


ব্যবসা থেকে অজয়বাবুর মাথায় নতুন কূট চিন্তা এসে ঢুকলো। তিনি ভাবলেন যে তিনি বাজার করার সময় দরকষাকষি করে যদি কিছু পয়সা কমাতে পারেন, তাহলে তো বেশ কিছু পয়সা বাঁচানো যাবে। এটা বোঝার পর থেকে, তিনি বাজার করতে গিয়ে সব জায়গায় দর কষাকষি করতে লাগলেন এবং দেখলেন দিব্যি প্রতিদিন প্রায় বারো আনা থেকে একটাকা বেঁচে যাচ্ছে।


এবার অজয়বাবুর মাথায় চাপলো নতুন খেয়াল। তিনি ঠিক করলেন যে তিনি বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে যত পয়সা বাঁচাবেন, তাই তিনি লক্ষীর ভান্ডারে রাখবেন। পরে ভান্ডার ভেঙ্গে সব কয়েনকে নোটে পরিনত করে ব্যাঙ্কে জমা করে দেবেন।  এই সব মনের কথা কাউকে না জানিয়ে তিনি তার উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে গেলেন।


দেখতে দেখতে অজয়বাবু ফুলেফেঁপে বেশ ধনী হয় গেলেন। একে একে তিন মেয়ের বিয়ে দিলেন। কিন্তু শেষ যে পুত্র সন্তান আছে তাকে মানুষ করার আগে প্রায় বাষট্টি বছর বয়সে মারা গেলেন। অজয়বাবুর স্ত্রী পড়লেন মহা বিপদে। তিন মেয়ের বিয়ে হলেও পুত্রের বয়স যে মাত্র চৌদ্দ বছর। তাকে পড়াশুনা করিয়ে মানুষ করে তুলতে যে অনেক কষ্ট হবে। তাছাড়া পড়াশুনার জন্য এত টাকা তিনি পাবেন কোথায়?


এই অবস্থায় জামাইরা কেউ এগিয়ে এলো না। অগত্যা অজয়বাবুর স্ত্রী তার ছেলে তীর্থঙ্করকে নিয়ে বিঘা পাঁচেক জায়গা আর পেনশানের টাকা নিয়ে কোন রকমে দিনাতিপাত করতে লাগলেন। 


একদিন পুরানো কাগজ পত্র ঘাটতে ঘাটতে অজয়বাবুর স্ত্রীর হাতে ব্যাঙ্কের একটি পাশবই এলো।কিন্তু কি সেটি!! তা বুঝতে না পেরে মিনতীদেবী ছুটলেন তার বড় মেয়ের কাছে বইটি সঙ্গে নিয়ে। বড় মেয়ে বইটি হাতে নিয়ে বুঝতে পারলেন যে এটি ব্যাঙ্কের পাশ বই এবং তাতে সঞ্চিত রয়েছে আড়াই লক্ষ টাকা! তাই দেখে বড় মেয়ের মাথায় এলো কূট বুদ্ধি। তিনি ঠিক করলেন, এই টাকা তিনি আত্মস্বাদ করবেন। তাই তার মা'কে ভুলভাল বুঝিয়ে বইটা কাছে রেখে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মা'কে বাড়ি পাঠিয়ে বরকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলেন ব্যাঙ্কে।টাকার লোভে ও উত্তেজনায় দু'জনার বুকের হৃদপিন্ড লাফাতে শুরু করেছে।


কিন্তু অজয়বাবু যে এত চালাক আর এত বৈষয়িক তার মেয়েরা বোঝেন নি। কারণ বইতে দেখানো আড়াই লক্ষ টাকা তিনি বইতে না রেখে স্ত্রী মিনতীদেবীর নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে গেছেন পাঁচ বছরের জন্য যার মেয়াদ শেষ হতে আর মাস ছয়েক বাকি। অর্থাৎ আর ছয়মাস পর মিনতীদেবী পাবেন পাঁচলক্ষ টাকা!!! এই টাকা ১৯৬৫ সালের সময় অনেক বেশী মুল্যবান। বলতে গেলে এখন তার মুল্য পঞ্চাশ লক্ষ টাকার কম নয়।


বিষয় এবং বিষ প্রায় সমতুল্য। তাই এত টাকা পেয়েও মিনতোদেবীর শান্তি নেই। সব সময় তিন মেয়ে কিভাবে সেই টাকা হাতাবে সেই চেষ্টায় তৎপর থাকায়, মিনতীদেবী সব সময় সন্ত্রস্ত থাকেন। তাছাড়া পাড়ার বিভিন্ন এজেন্টদের প্রলোভন থেকে মুক্ত থাকতেও তাকে কম বেগ পেতে হয় নি। শুধু কি তাই, জামাইরা এক একটি এজেন্ট ধরে এনে শাশুড়ি মা'কে বিভিন্ন রকম ইচির মিচির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আত্মস্বাদ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু মিনতীদেবী গলবার বস্তু নয়। তার একমাত্র সন্তানকে মানুষ করতে হলে এ টাকা রক্ষা করতেই হবে। তাই তিনি এক লক্ষ টাকা গচ্ছিত রেখে বাকি চার লক্ষ টাকা আবার ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতেই তিন মেয়ে পাড়ায় মোড়লের কাছে বিচার জানায় যে তার মা তাদেরকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করছেন। তাই এর সঠিক বিচার চাই।


অর্থ আর সম্পত্তি লোভ এমন ভীষণতর যে, দয়া মায়া মমতা সবকিছুকে উপেক্ষা করে মানুষ তার ইস্পিত লক্ষ্যে পৌছাতে পিছ পা হয় না। মিনতীদেবীর মেয়েদের বেলায়ও তাই হলো।


কপিরাইট @তারাপদ মাঝি

৩১শা ডিসেম্বর, ২০২১

দেবনগর

 



কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.