#সেদিন_ফাগুন_শেষে


#গল্প

#সেদিন_ফাগুন_শেষে

#তারাপদ_মাঝি


প্রায় ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়। জয়ন্ত বেনে তার তিন ডিঙা নিয়ে চলেছেন নৌকা বিহারে। উদ্দেশ্য তাম্রলিপ্ত বন্দর ছাড়িয়ে খানিকটা উত্তর দিকে হুগলী বরাবর এগিয়ে যাওয়া। খুব আনন্দে তিনি আজ তার সমস্ত কর্মচারী এবং পরিবার নিয়ে নৌকা বিহারে বেরিয়েছেন। আনন্দের কারণ হলো রাজা শশাঙ্কের মৃত্যু। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যু হয়েছে বলে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। কারণ রাজা শশাঙ্ক কিছুতেই ধনী বনিকদের আর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সহ্য করতে পারতেন না। ধনী বনিকদের থেকে নানা উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করতে কিছুতেই তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। আজ তাঁর মৃত্যুতে সেই বিপদ কেটে গেল। তার উত্তরসূরী এখন রাজ্য সামলাতে ব্যস্ত। তাছাড়া উত্তরসুরী রাজা মানব রাজ্য শাসনে একেবারে অপটু। জয়ন্ত বেনের আশা খুব শিঘ্রই সম্রাট হর্ষবর্ধন বাঙলা জয় করবেন এবং বনিক ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তা দেবেন। এই আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে আজ জয়ন্ত বেনে লোক লস্কর পরিবার নিয়ে নৌকাবিহার করছেন।


জয়ন্ত বেনের পরিবার বলতে ষোড়শ বর্ষীয়া কন্যা চপলাসুন্দরী, একমাত্র ষষ্ঠ বর্ষীয় পুত্র বোধিসত্ব এবং পত্নী কুসুমসুন্দরী। জয়ন্ত বেনে সবেমাত্র চল্লিশ বসন্ত পেরিয়েছেন। তাই এই একচল্লিশ বসন্তের নৌকাবিহারে তার শরীর ও মন খুবই আনন্দ বিহ্বল। তিন ডিঙ্গার মধ্যে প্রথম ডিঙায় আছেন জয়ন্ত বেনে, অপরূপা সুন্দরী স্ত্রী কুসুমসুন্দরী, পুত্র বোধীসত্ব এবং ডিঙা চালনাকারী নয় জন মাঝি মাল্লা। দ্বিতীয় ডিঙায় আছেন জয়ন্ত বেনের একমাত্র কন্যা চপলাসুন্দরী, তার দাইমা, পাঁচ সহচরী এবং ডিঙা চালনাকারী নয় জন মাঝি মাল্লা। তৃতীয় ডিঙায় আছেন জনা দশেক পাহারাদার, রসুইকারী এবং নয় জন ডিঙা চালনাকারী মাঝি মাল্লা। জয়ন্ত বেনে ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে নৌকাবিহারে বেরিয়েছেন। তার ইচ্ছা তিনি তাম্রলিপ্ত থেকে বেরিয়ে গঙ্গা বক্ষে বিচরণ করতে করতে খানিকটা উত্তরে এগিয়ে যাবেন। গঙ্গাবক্ষে নিশিযাপন করে পরের দিন অপরাহ্নে বাড়ি ফিরবেন।


জয়ন্ত বেনে পত্নী কুসুমসুন্দরীর সঙ্গে কথোপকথনে ব্যস্ত হলেন। তার মন আজ লাগাম হীন হয়ে পড়েছে। এখন তিনি বানিজ্য করে যা লাভ করবেন তা তিনি নিজ অধিকারে রাখতে পারবেন। নিজেকে ঐশ্বর্যে ভরিয়ে তুলতে পারবেন। তাই নিজেদের অতীত জীবন নিয়ে আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়লেন। ছোট্ট বোধীসত্ব খেলনা নিয়ে খেলতে মন চাইলো না বলে ডিঙার ছাদে এসে নদীর অপরূপ রূপ লেহন করতে লাগলো।


এদিকে চপলাসুন্দরী অত্যন্ত চপল স্বভাবের। তিনি দেখতে যেমন পরীর মতো সুন্দরী, তেমনি মনটা হরিণীর মতো চঞ্চল। সে সহচরীদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠলো। দূর থেকেও তাদের হাসি ঠাট্টার শব্দ শোনা যায়। সহচরীরা চপলাসুন্দরীকে নানাভাবে সাজাচ্ছে। ধাইমা তাই দেখে বিচার করে বলতে হচ্ছে কোনটা ভালো বা মন্দ হয়েছে এবং কেন হয়েছে।


ওদিকে প্রহরীরা পাশা খেলায় মত্ত। পাশা খেলার সঙ্গে সঙ্গে সামান্য মাত্রায় মদিরা সেবন চলছে অবহেলায়। রসুইকররা দ্বিপ্রাহরিক আহার রন্ধনে ব্যস্ত হয়েছেন। এই অবস্থায় মাঝি মাল্লারা হাল্কা পালের হাওয়াতে ডিঙা চালাতে ব্যস্ত। 


দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষে সকলে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। কিন্তু ডিঙা চলেছে ঠিক ধীর গতিতে। হঠাৎ পশ্চিমাকাশে দেখা দিল ষাঁড় রঙা কালো মেঘ। মাঝি মাল্লারা প্রমাদ গুনলেন। অসময়ে আম্রঝড়!! মাঝিরা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ডিঙা চালনা করে নদীর পশ্চিম ভূ-খন্ডের সাঁড়ি নদীতে প্রবেশ করতে পারলেও চপলাসুন্দরীর ডিঙা কিছুতেই নদীর পশ্চিম ভূ-খন্ডের সাঁড়ি নদীতে প্রবেশ করতে পারলো না। পশ্চিমী বায়ুর তান্ডবে সেই ডিঙা মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল।


এদিকে আর একটি ডিঙাতে রাজা মানবের নৌবাহিনীর প্রধান সেনাপতি সমুদ্রদেব মল্ল চলেছেন কর্নসুবর্নের দিকে। সমুদ্রদেব দেখলেন একটি ডিঙা ঝড়ের তান্ডবে যমদূতের মতো এগিয়ে আসছে তাদেরই ডিঙার দিকে। তিনি অনেক কষ্টে সেই ডিঙাকে পাশ কাটিয়ে বাঁচলেন। কিন্তু যেভাবে অপরিচিত ডিঙাটি ছুটে চলেছে, তাতে দুর্ঘটনা ঘটবেই।


সমুদ্রদেব সৈনিক। যুদ্ধ করা তার নেশা। ঝড়ের সময় শত্রু নৌবহরে আক্রমন করা তার কৌশল। তাই ঝড়ের সময় নৌকা চালনাতে তিনি খুবই পটু। দক্ষ নাবিকদের নিয়ে মাকু আকৃতির ছুঁচালো ডিঙা ছুটিয়ে দিলেন বিপদগ্রস্ত বিশালাকৃতির ডিঙাটিকে উদ্ধার করতে। তিনি আন্দাজ করেছিলেন যে, যে গতিতে ডিঙাটি ছুটে চলেছে পুর্ব দিকে, সেটি অবশ্যই পাড়ে আছড়ে পড়বেই। তাই সেই রকম আন্দাজ করে সমুদ্রদেব ডিঙা চালনা করলেন। খুব কম সময়ে সমুদ্রদেব ডিঙার হদিস পেলেন।


ভূমি থেকে কিছুটা দূরে ডিঙাটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে কলার মোচার মতো নাচছে। মাঝি মাল্লারা সবাইকে ডাঙায় তুলতে পারলেও চপলাসুন্দরী এবং ধাইমাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। ডিঙার মাঝি পাগলের মতো "চপলাদিদি" বলে ডাকাডাকি করছেন। কিন্তু কোন সাড়াই পাওয়া যাচ্ছে না। এমন সময় সমুদ্রদেব সেখানে পৌচলেন। তিনি মাঝির কাছ থেকে সব কিছু শুনলেন এবং তারপর দক্ষিনে নৌকা ছূটিয়ে দিলেন। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রায়ান্ধকার পরিবেশে একটি নারীদেহ দেখতে পেলেন। নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সমুদ্রদেব। তার লোহার মতো পেটানো শরীর বান মাছের মতো লক্ লক্ করে নারীদেহের দিকে এগিয়ে গেল। নারীকে তুলেই বুঝতে পারলেন যে ইনি চপলাসুন্দরীই হবেন। তারপর ধাইমাকে অনেক খোঁজাখুজি করেও পাওয়া গেল না। বেচারী ধাইমা যিনি নবজাতককে পৃবিবীর আলো দেখাতেন, আজ বিধাতা তার জীবন থেকে আলো কেড়ে নিলেন।


এদিকে চপলাসুন্দরীকে সমুদ্রদেবের নাবিকরা  সবাই সেবা শুশ্রূষা করে জ্ঞান ফিরিয়েছেন। কিন্তু পরিবেশ এখনো শান্ত না হওয়ায় তিনি বৃষ্টির আঘাত সহ্য করতে না পেরে কদলীপত্রের ন্যায় কাঁপছেন। সমুদ্রদেব বিফল মনস্কাম হয়ে ডিঙায় ফিরে এসে চপলাসুন্দরীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি ডাঙায় ভিড়লেন এবং একটি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে সেখানে আশ্রয় নিলেন। সুর্যাস্তকালীন সময়ে আনকো আলোয় সমুদ্রদেব বুঝলেন যে আশ্রয়স্থানটি জেলেদের বানানো অস্থায়ী কুটির। এই কুটিরে তারা রাত্রি যাপন করে আর নিজের জাল লক্ষ্য রাখে। ঝড়ে কুটিরে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে তারা সবাই বাড়িতে ফিরে গেছে। কিছুক্ষন পর ঝড়ের তান্ডব নৃত্য সমাপ্ত হতেই পরিবেশ একেবারে শান্ত হয়ে গেল। পূবাকাশে উঠেছে রুপোলী থালার মতো পূর্নিমার চাঁদ। তার আলোর বন্যায় চরাচর প্লাবিত। কিছুক্ষন আগে যে ঝড়ের মারণ তান্ডব চলেছিল, তা একেবারেই বোঝা যায় না।


শান্ত পরিবেশের মধ্যে সমুদ্রদেব চপলাসুন্দরীর ডিঙার যাত্রীদের নিয়ে পশ্চিম পাড়ের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। উদ্দেশ্য চপলাসুন্দরীকে তার পিতৃদেবের হাতে অর্পণ করে তিনি আবার কর্নসুবর্ণের দিকে যাত্রা শুরু করবেন। সন্ধ্যে প্রায় তিন প্রহরের সময় জয়ন্ত বেনের ডিঙা সমুদ্রদেবের নজরে এলো। কারণ জয়ন্ত বেনের ডিঙা চপলাসুন্দরীর ডিঙার সন্ধ্যানে বের হয়েছেন বলে সমুদ্রদেবের সুবিধা হয়েছে।


এদিকে সমুদ্রদেব চপলাসুন্দরীর রূপে একেবারে মোহিত হয়েছেন। তিনি পূর্বে কখনো এমন সুন্দরী নারী অবলোকন করেন নি। তিনি ভাবছেন এ কি মানবী,  না মানবীর বেশে কোন অপ্সরা বা কিন্নরী! সমুদ্রদেব চন্দ্রালোকে চপলাসুন্দরীর রূপসুধা পান করতে লাগলেন।


বিপরীতে চপলাসুন্দরী অনেকটা প্রকৃতিস্থ হয়েছেন এবং ধাইমাকে হারানোর শোক নিয়েও সমুদ্রদেবের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলেন। তিনি দেখলেন যে সমুদ্রদেবের লোমশ উর্ধাঙ্গ নগ্ন। নিম্নাঙ্গে একটি রাজকীয় ঘরানার ধূতি মালকোছা দিয়ে পরা। উজ্জ্বল গৌরবর্ণের দেহ একেবারে নিটোল। সেই নিটোল দেহ সৌষ্ঠব এখনো নদীর জলে সিক্ত। মস্তকের কেশরাশি থেকে এখনো শিশির বিন্দুর ন্যায় জল পড়ছে এবং চন্দ্রালোকে সেই জলকনাগুলি চিক্ চিক্ করে পড়ছে। এমন অপরূপ পুরুষ বোধহয় চপলাসুন্দরী কখনো দেখেন নি। 


অবশেষে জয়ন্ত বেনের সঙ্গে সমুদ্রদেবের সাক্ষাৎ হলো। তিনি সমুদ্রদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন- তুমি কে যুবক?

-আজ্ঞে দাসের নাম সমুদ্রদেব মল্ল। আমি মহারাজা শশাঙ্কের নৌসেনাপতি। খবর পেলাম তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। তাই তাঁর পুত্র একমাত্র উত্তরাধিকারী রাজা মানব তলব করেছেন। এখন আমি রাজধানীতে যাচ্ছি।

-আমার একটি অনুরোধ রাখবে?

-সমুদ্রদেব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- কি অনুরোধ মহাশয়।

-আমি তাম্রলিপ্তের বেনে জয়ন্ত বিশ্বাস। বানিজ্য আমার পেশা। তুমি আমার প্রানাধিক কন্যা চপলাসুন্দরীর প্রান বাঁচিয়েছো। তাই আমার অনুরোধ আমার সঙ্গে এই রাত্রিটুকু কাটিয়ে আগামীকল্য আমার সঙ্গে তাম্রলিপ্তে যাবে। সেখানে আমাদের কয়েকদিন আতিথ্য গ্রহন করে তারপরে রাজধানীতে গেলে কি অসুবিধা হবে?

-মহাশয়, যেহেতু রাজার আদেশ, তাই আমার শিঘ্র যাওয়াটা জরুরী। কিন্তু আপনার অনুরোধও অবহেলা করতে পারছি না। তাই আজ রাত কাটিয়ে অন্তত একদিন আপনার তাম্রলিপ্তে কাটাতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু একদিনের বেশী থাকা সম্ভব হবে না।

আসলে চপলাসুন্দরীকে দেখার পর সমুদ্রদেবের অন্তরে প্রেমের কুঁড়ি এসেছে। তাই সেই কুঁড়িকে ফুলে পরিনত না করে কিছুতেই তিনি তাম্রলিপ্ত ছাড়বেন না।


রাতের খাবারের সময় হলে চপলাসুন্দরী মায়ের কাছে আবদার ধরলো যে সেই আজ সমুদ্রদেবকে আহার পরিবেশন করবে। মা কুসুমসুন্দরী এবং বাবা জয়ন্ত বেনে বুঝে গেলেন মেয়ের মনের কথা। যে মেয়ে নদীর জলে লড়াই করে মৃতাবস্তা হয়েছিল এবং যার শরীর এখনো দূর্বল ও ক্লান্ত,সে যদি সম্পুর্ন অপরিচিত পুরুষকে খাদ্য পরিবেশনের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তাহলে তার মনের অভিপ্রায় বোঝা যায় না কি? বাবা মা তাই কোন বাধা দিলেন না।


কুসুমসুন্দরীর মনের খবর হয়তো জয়ন্ত বেনে জানে না। কিন্তু তার মনেও একটি হিসাব নিকাশ চলছে। যদি সমুদ্রদেবকে জামাতা করা যায়, তাহলে জামাতার সুত্র ধরে কর্ণসুবর্নের রাজপ্রাসাদে তিনি প্রভাব খাটাতে সমর্থ হবেন। তাই মেয়ের সঙ্গে সমুদ্রদেবের মেলামেশায় বাধা দিলেন না।


পরের দিন সমুদ্রদেব এবং তার নাবিকগন তাম্রলিপ্তে উপস্থিত হলেন। জয়ন্ত বেনের বিষয় বৈভব দেখে সমুদ্রদেব মুগ্ধ হলেন। তিনি জয়ন্ত বেনের প্রাসাদ দেখেও বুঝলেন যে এই বেনে ধনে গুনে রাজার থেকেও কম যান না।


এবার সমুদ্রদেব জয়ন্ত বেনের পুষ্পোদ্যানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তিনি মনে মনে আর বিরহ সইতে পারছেন না। কিভাবে তিনি চপলাসুন্দরীর সঙ্গে পরিচিত হবেন, তার সঙ্গ পাবেন সেই কথা ভাবছেন। কিন্তু তিনি যা কিছু ভাবছেন কিছুতেই তা বাস্তবায়িত করার মতো মনের অবস্থা তার নেই।


এদিকে চপলাসুন্দরীর মনের অবস্থাও ভালো নয়। তার  মন সর্বদা সমুদ্রদেবকে চাইছে। তাকে আলিঙ্গন করে চুম্বন করতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কিভাবে এবং কি ছুতোয় তার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন তাই ভেবে পাচ্ছেন না।


লতিকা কুমারী নামে চপলাসুন্দরীর এক বুদ্ধিমতী সহিচরী ছিল। সে তার সহচরীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে সমুদ্রদেবের বিশ্রাম কক্ষে গিয়ে জানতে পারলেন যে সমুদ্রদেব জয়ন্ত বেনের প্রাসাদ এবং পুষ্পোদ্যান ঘুরে ঘুরে দেখছেন। এই কথা জানার পর লতিকা কুমারী ছুটলেন পুষ্পোদ্যানে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি সুমুদ্রদেবকে দেখতে পেলেন। দেখলেন সমুদ্রদেব একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় বসে আনমনে কিছু ভাবছেন। তিনি বুঝলেন যে কন্দর্পনারায়ন সমুদ্রদেবকেও আহত করেছেন। তাই কালবিলম্ব না করে তিনি ছুটলেন অন্দর মহলে। গিয়েই চপলাসুন্দরীকে পরামর্শ দিলেন।


চপলাসুন্দরী চলেছেন পুষ্পোদ্যানে পূজোর পুষ্প চয়ন করতে। সেখানে গিয়েই লতিকার কথা মতো বাগানের পশ্চিমে গিয়ে কৃষ্ণচূড়ার তলে সমুদ্রদেবকে দেখতে পেলেন। দু'জনের চোখাচোখি হলো। কেউই চোখ সরাতে পারছেন না। এমন সময় সলজ্জ ভাবে চপলাসুন্দরী ফেরার জন্য শরীরে মোচড় দিয়েছেন, এমন সময় সমুদ্রদেব বললেন- একটু দাঁড়ান!

-কেন? চপলাসুন্দরী মুখ নীচু করে উত্তর দেয়।

-আপনাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। সত্যি বলতে কি আপনার মতো এমন সুন্দরী নারী আমি কখনো দেখি নি।

-মিথ্যা বলছেন আপনি। চপলাসুন্দরী উত্তর দেয়।

-না, বিশ্বাস করুন। আমি একেবারে সত্যি কথা বলছি।

-কি করে বিশ্বাস করবো। আপনি কর্ণসুবর্নের নৌসেনাপতি। রাজধানীতে আমার মতো কোন সুন্দরী নেই কি?

-থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আমি দেখি নি।

-তা সেনাপতি মহাশয় আমাকে কি শুধু দেখবেন, না অন্য কোন অভিপ্রায় আছে?

-ইঙ্গিত পেয়ে সমুদ্রদেব এবার চপলাসুন্দরীর কাছে এসে বললো- অভপ্রায় আছে সুন্দরী। কিন্তু বলতে সাহস হচ্ছে না।

-সে কি! এই আপনি সেনাপতি!  একজন সামান্য মেয়ের কাছে নিজের ইচ্ছার কথা বলতে যে পারে না, সে সেনাপতি হয় কিভাবে বুঝি না।

-চপলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। নেবে আমায় তোমার করে। আমি যে আর সইতে পারি না। 

- এবার চপলাসুন্দরীর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। সে আর তার চোখের জল ধরে রাখতে পরলো না। কাঁদতে কাঁদতে সে সমুদ্রদেবকে জড়িয়ে ধরে বললো- সেনাপতি, তোমার ছোঁয়ায় আমার শরীরে যে অজস্র ফুল ফুটেছে সে ফুল আমি তোমার পায়ে অর্পন করলাম। আজ থেকে আমার জীবন তোমাতে উৎসর্গ করলাম।

- সমুদ্রদেব চপলাসুন্দরীকে বাহুযুগলাবদ্ধ করে তার বিম্বোষ্ঠে চুম্বন করলেন। তারপর বললেন-আমার এই চুম্বন হলো একটি রঙ মাখা তুলি। আমি বাড়িয়ে দিলাম আমার প্রেমের হাত। তুমি রাঙিয়ে নিও তোমার আগামী দিনগুলি।


কপিরাইট @তারাপদ মাঝি

১৭ই ফেব্রুয়ারী, ২০২২

দেবনগর।


[কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ এই গল্পটি লিখতে গিয়ে অধ্যাপক কিরণ চৌধুরীর লেখা "ভারতের ইতিহাস", অধ্যাপক কল্যান চৌধুরীর লেখা " ভারতের ইতিবৃত্ত", উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া র সাহায্য নেওয়া হয়েছে]



কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.