#বৃহন্নলা
#গল্প
#বৃহন্নলা
#তারাপদ_মাঝি
প্রথম অধ্যায়
গাজনটা অমরের খুব ভালো লেগেছে। জয় মা কালী গাজন দল এবারে যে গাজনের নাটকটি বানিয়েছে, তাতে একটি চরিত্র হলো বৃহন্নলার। সে কিন্তু বৃহন্নলা নয়। একটি যুবক বৃহন্নলা সেজে দিব্যি বৃহন্নলার সঙ্গে মিলে জনগনের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে বেশ মোটা রোজগার করছে।কেউ তাকে চিনতে পারে নি। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। সপ্তাহ খানিক থেকে আবার চলে যায়। তারপর বৃহন্নলার ছদ্মবেশে দিব্যি বৃহন্নলার সঙ্গে মিশে পাবলিকের কাছ থেকে সেই প্রথাগত কায়দায় অর্থ আদায় করে ভালোমতো রোজগার করে।
অমর সিদ্ধান্ত নেয় যে সেও এইভাবে রোজগারের জগতে প্রবেশ করবে। কিন্তু কাছে পিঠে কোথাও করা যাবে না। দূরে গিয়ে এই পেশায় ঢুকতে হবে। এখন কাজের যা অভাব তাতে এই পেশাটা মন্দ নয়। তাছাড়া অমর খুব অলস প্রকৃতির ছেলে। কম পরিশ্রম করে বেশী রোজগারের ঝোঁক তার সর্বদা। সে সিদ্ধান্ত নিলো যে হাওড়া স্টেশনে গিয়ে সে এই পেশায় ঢুকবে।
এবার অমর নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলো। প্রস্তুতির প্রথম পর্বে সে বন্ধুদের সঙ্গে কেরালায় কাজ করতে গেলো। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর চতুর অমর নিজেকে বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা করে গুজরাটে চলে গেল অন্য কাজে। সেখানে সে একটি কারখানায় প্রহরীর কাজ করে।
অমরের কিছুতেই দাড়ি গোফ ওঠে না। এ জন্য বউয়ের কাছে সে অনেকবার তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়েছে। কিন্তু সেই ঈশ্বরের অভিশাপ আজ তার কাছে যে এভাবে আশীর্বাদ হয়ে যাবে তা সে ভাবতে পারে নি। অমর বাড়ি থেকে আসা থেকে আর চুল কাটে নি। ফলে বছর খানিক পর তার মাথার চুল একেবারে মেয়েদের মতো লম্বা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সে তাদের রান্নার মাসির কাছ থেকে গুজরাটি স্টাইলে মেয়েদের মতো কাপড় পরা শিখে নিয়েছে।
একদিন কোম্পানীর কাজ ছেড়ে সমস্ত টাকা পয়সা নিয়ে হাওড়া চলে আসে। হাওড়াতে একটি স্বল্প মুল্যের বাড়ি ভাড়া নেয়। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় সে বৃহন্নলার বেশেই বাড়ি ভাড়া নেয়। তারপর একদিন বৃহন্নলার সাজে সজ্জিত হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখেই সে অবাক। এ যে একেবারে সত্যি সত্যি বৃহন্নলার মতো লাগছে। আর পুরুষের কন্ঠ হওয়ার জন্য একেবারে ধরার উপায় নেই যে সে আসলে একজন পুরুষ মানুষ।
এবার স্টেশনে এসে সে তার রোজগার করতে শুরু করে। দুই তিন দিন বেশ ভালোই কামাচ্ছিল। প্রতিদিন বেশ পরিশ্রম করলে হাজার দুয়েক টাকা রোজগার কিরা কোন ব্যাপার না। পঞ্চম দিন শুরু হলো ব্যাঘাত। এক দল বৃহন্নলার দল রে রে করে দৌড়ে এলো। তারা এসে বললো-এই তুই কোথাকার মাল রে?
-অমর একটুও ভয় না পেয়ে বললো-আমি গুজরাটের মাল।
-তাহলে বাংলায় কথা বলছিস যে!!!
-বাড়ি গুজরাটে। কিন্তু বাবা মা বাঙালী যে!!!
- ও, তা তুই এখানে নোঙ্গর ফেললি কেন? আর নোঙ্গর যদি বা ফেলিস, তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু তুই তা করিস নি কেন?
- তোমাদের ঠিকানা জানলে, তবে ত যোগাযোগ করবো।এই তোমরা এলে। যোগাযোগ হয় গেল। এখম আমার প্রতি কি আদেশ বলো?
-আদেশ কথা শুনে, বৃহন্নলা দলের সর্দার বা সর্দারনি বেশ খুশি হলো। বললো- তোর ব্যবহারে আমি বেশ খুশি হয়েছি। তোকে আমরা দলে নিলাম।.কিন্তু তার আগে তোকে পরীক্ষায় পাশ করতে হবে।
-কি পরীক্ষা দিতে হবে আমায়?
-আজকাল অনেক পুরুষ বৃহন্নলা সেজে আমাদের দলে ঢোকে। তুই সে রকম করেছিস কিনা দেখতে হবে।
-অমর রাজি হয়ে গেল। কিন্তু মনের মধ্যে তার ভয় ঢুকে গেল। এমন সময় এক জন বৃহন্নলা বললো- মাসি, একে পরীক্ষা করার দরকার নেই। এর সবকিছু স্বাভাবিক। ওকে বিনা পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দাও।
-তখন তথা কথিত মাসি বললে- তোরা সবাই যখন বলছিস, তাহলে ও পাশ করলো। এবার মাসি বললে- আমাদের দলে কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়মগুলো মানতে হবে।
-আমি তোমার সব নিয়ম মেনে চলব। ভক্তিতে গদ গদ হয়ে অমর বললো।
-তা বাছা তোমার নাম কি? মাসি জিজ্ঞাসা করে।
- অমরাবতী। অমর উত্তর দেয়।
- তা "অমরাবতী" নামটা বড্ড বড়। আমরা তোমায় "অমর" বলে ডাকলে অসুবিধা হবে?
-আজ্ঞে না মাসি। অমর উত্তর দেয়।
দ্বিতীয় পর্ব
অমর বৃহন্নলাদের অফিসে এসেছে। অফিসটি দু'তলা। বেশ বড়ই অফিস। সেখানে একটি সাধারণ সভা বসেছে। সেই সভায় উপস্থিত আছে শিয়ালদহ শাখার বৃহন্নলা, হাওড়া শাখার বৃহন্নলা এবং কলকাতা শাখার বৃহন্নলা। সভাপতি সভা শুরু করলেন। তিনি সভার শুরুতে চলতি বছরে নতুন সদস্যদের নাম পাঠ করে শোনালেন এবং পাঠের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সদস্যরা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন সবাইকে।
এবার সভায় সাধারণ সম্পাদক চলতি বছরে আয় ব্যয়ের হিসাব পাঠ করে শোনালেন। আয়ের হিসাব শুনে অমরের মুর্ছা যাওয়ার অবস্থা। এত টাকার লেনদেন কোন কোম্পানীর মালিক করেন কিনা তার সন্দেহ আছে। তবে এই সভা থেকে অমর জানতে পারলো যে বৃহন্নলারা কতটা হৃদয়বান। মাসে যা আয় হয় তা ব্যাঙ্কে জমা হয়। জমা টাকার ষাট শতাংশ টাকা নিজেরা বেতন হিসাবে ভাগ করে নেয়। বাকি চল্লিশ শতাংশ টাকা বৃদ্ধ বৃহন্নলাদের সাহায্যার্থে, কোথাও বন্যা ত্রানে, দরিদ্র পরিবারের মেয়ের বিয়েতে, দরিদ্র ছাত্রের পড়াশুনাতে এবং ভুভুক্ষু মানুষের ক্ষুদা নিরাময়ে সাহায্য করা হয়। বৃহন্নলা সংগঠনের উদ্যেশ্য হলো ধনবানের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে নির্ধন গরীবদের সাহায্য করে তাদের বাঁচানো।
আজ বছর খানিক হলো অমর বৃহন্নলার পেশায় ঢুকেছে। এই এক বছরে সে অনেক কিছু শিখেছে ও জেনেছে। বাড়িতে টাকা দিতে এসে সে রত্নার কাছে ধরা পড়েছে যে তার বাড়ি গুজরাটে নয়। আসলে তার বাড়ি যে কুল্পীতে! রত্না এও জেনেছে যে অমর আসলে বৃহন্নলা নয়, বৃহন্নলার বেশে একজন সম্পুর্ণ পুরুষ! কিন্তু এ সব জানার পরও রত্না দলের কাছে সত্য প্রকাশ করে নি। কেন করে নি তার কারণ অবশ্য অমরের অজানা।
কিন্তু অমরের কপাল খারাপ। তার বাড়িতে বউ যখনই টাকা চেয়েছে, তা অমর উজাড় করে দিয়েছে। বেশ কিছু টাকা বাগিয়ে বউ অন্য একজনকে নিয়ে ভেগেছে। এ কি যন্ত্রনা! টাকা ধরলে বউ পালায়। আবার বউ ধরলে টাকা পালায়। এখন আমর কি করবে বেবে পাচ্ছে না।
ট্রেন স্টেশনে আসার জন্য অমররা অপেক্ষা করছিল। এক জায়গায় অমর মন খারাপ করে বসেছিল। এমন সময় রত্না এসে বললো- কি রে মন খারাপ কেন?
-কই মন খারাপ? আমি ঠিক আছি।
-শালা আমার কাছে লুকোচ্ছিস! এবার রত্না চুপি চুপি বললো-দেখ তুই যেমন বৃহন্নলা নস, আমিও সেরূপ বৃহন্নলা নই। আমি একেবারে একজন কমপ্লিট নারী। আমার শরীররে স্তনযুগল না থাকার কারণে আমার বিয়ে হচ্ছিল না। তাই আমি ট্রেনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলাম। এরা আমার কাছ থেকে সব শুনে আমায় দলে নিয়ে নেয়। আমি সেই থেকে দলে আছি। এবার রত্না চুপি চুপি বললো- আমি নারী হয়ে বলতে পারি তোর মনের মধ্যে এখন ঝড় বইছে। কি ঝড় বইছে সেটা অবশ্য আমি আন্দাজ করতে পারি, তবে বলবো না। এমন সময় ট্রেন চলে আসায়, সবাই কাজে নেমে পড়লো।
তৃতীয় অধ্যায়
রত্নার অনুরোধে সে দিন আর অমরের ভাড়া বাড়িতে যাওয়া হলো না। সে রত্নার সঙ্গে অফিসের দোতলায় রত্নার সঙ্গে থেকে গেল। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা দুজনে শুতে যাওয়ার আগে রত্না বললো- এবার বলতো তোর সমস্যা কি?
-সমস্যা কিছু নয়। আমি এখান থেকে টাকা পাঠাই। কিন্তু বউ সব টাকা নিয়ে অন্য একজনকে নিয়ে ভেগেছে। এভাবে সংক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল অমর।
-তুই এখন কি করবি ভাবছিস?
-কিছুই তো ভেবে পাচ্ছি না।
-দেখ বউকে টাকা দিলে সবকিছু দেওয়া হয় না। তার আরও কিছু অবাব থেকে যায়। সেই অভাবের জন্য বাড়ি থেকে ভেগেছে। এখন ও সব ভেবে কোন কাজ নেই। রত্না বলে।
-তাহলে আমার এখন কি করা উচিত বলে তোর মনে হয়? অমত জিজ্ঞাসা করে।
-তুই আবার বিয়ে করে নে? ঝামেলা মিটে যাবে। রত্না বলে।
-এখানেই তো ঝামেলা। বউ যদি ফিরে এসে আমার বিরুদ্ধে কেস করে তো আমি ফেঁসে যাবো। তখন আমি কোথায় যাবো। অমর বিরক্ত হয়ে বলে।
- তখন রত্না একটি সমাধানের কথা বলে। সে বলে -তুই আমায় বিয়ে করে নে। তাহলে কোন অসুবিধা হবে না। আমারা ভালোভাবে সংসার করতে পারবো। তাছাড়া তোর বউ ফিরে এসে যদি আবার ঘর সংসার করতে চায় তাহলে করুক না। আমার কোন আপত্তি নাই। আমার শুধু একটি সন্তান চাই।
- এই রত্না, তোর বয়স কত রে?
-শালা মারবো এক লাথি জানিস। তুই বিয়ে করবি একটি নারীকে। তাকে নিয়ে দুই তিন মিনিটের একটি খেলা খেলবি। বেশ এখানেই বিয়ের উদ্দেশ্য শেষ। তাছাড়া আমি কি একেবারে বুড়িয়ে গেছি নাকি? সবে তো একত্রিশ বর্ষা দেখেছি। এই বলে রত্না ঝর ঝর করে কাঁদতে থাকে।
-আমর এবার রত্নার কাছে সরে আসে। সে আলতো করে রত্নার কাঁধে হাত রাখে।
-রত্না ফুঁপিয়ে কাদঁতে কাঁদতে বলে-তোরা পুরুষরা শুধু মেয়েদের শরীরটাকে বেশী গুরুত্ব দিস। তাদের যে একটি সুন্দর মন আছে, সে দিকে তোদের নজর পড়ে না। এই জন্যই পুরুষ জাতটাকে আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না।
-অমর হাত জোড় করে রত্নার কাছে ক্ষমা চায়। তারপর সে রত্নাকে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে। তারপর সে রত্নাকে বলে- চল আমরা নতুন করে আবার জীবন শুরু করি। নতুনভাবে বাঁচতে শুরু করি।
-কোথায় থাকবি?
-কেন? আমার বাড়িতে। সেখানে তোকে কেউ চিনবে না। আমরা নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারবো।
-আমায় ফেলে দিবি না তো?
-কথা দিচ্ছি, প্রান থাকতে তোকে আমি ত্যাগ করবো না।
পরের দিন অমর আর রত্না দেখলো নতুন সূর্য এবং নতুন ভোরের আলো। নিজেদের চেহারার পরিবর্তন করে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে নতুন পথে এগিয়ে চললো। শুরু হলো নতুনভাবে পথ চলা।
কপিরাইট @তারাপদ মাঝি
দেবনিগর
৫/১২/২০২১
Leave a Comment