#বুনো_ওল_আর_বাঘা _তেঁতুল


#গল্প

#বুনো_ওল_আর_বাঘা _তেঁতুল

#তারাপদ_মাঝি


পাড়ার ছেলে মেয়ে আর বউদের নিয়ে বেশ বিপদে পড়লাম। বিপদের কারণ শুনলে আপনারা হয়তো হাসবেন, কিন্তু আমার একেবারে গা জ্বালা করে।  তাহলে শুনুন গায়ে জ্বালা ধরা বিষয়টি।


নতুন বাস্তুতে ফলকর গাছ ভালো হবে ভেবে বাজার থেকে ভালো জাতের আম আর পেয়ারা গাছ কয়েকটা লাগিয়েছি বাড়িতে। জায়গা কম, তবুও পুকুরের পাড়ে খান তিনেক আম আর খান চারেক পেয়ারা গাছ পুঁতেছি।ঠাকুরের কৃপায় বছর পাঁচেক পর দেখলাম আম গাছে আম এবং পেয়ারা গাছে পেয়ারা ফলতে শুরু করেছে। 


কিন্তু গাছের আম আমি আর খেতে পেলাম না। গাছে আম দেখে পাড়ার বউরা যার যেমন দরকার পেড়ে নিয়ে গেল।আমি তো দেখে অবাক। যারা আম পাড়ছে, তারা যে যার ইচ্ছে মতো আম পাড়ছে। আমাদের পাড়া গাঁয়ে বাড়ি। বাস্তুর চার দিক তাই খোলা। গাছ বাঁচানোর জন্য সামান্য বাঁশ খুটির বেড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু পাড়ার ছেলে আর বউরা সে বেড়া ভেঙ্গে ঢুকে পড়ে এই সব কীর্তি করছে। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম- ও বউমা তোমরা আমার গাছের আম পাড়ছো কেন? 

-আম খাব বলে পাড়ছি। একজন উত্তর দিল।

-আমার গাছের আম তোমরা পাড়বে কেন?

-ছি, সব সময় আমার আমার করতে নেই দাদা! সবাইকে দিয়ে খেতে হয় জানেন না!! একজন উত্তর দিল।

-তোমরা তো সব আম পেড়ে নিলে! আমার আর রইল কোথায়?

- সে যাওয়ার সময় কিছু আম দিয়ে যাবো এখন। এবার উত্তর দিল কানাইয়ের বউ।



এমন সময় কানাই এসে উপস্থিত। সে আমাকে হাসতে হাসতে উপদেশ দিল- দাদা, বাড়িতে আম জাম আর পেয়ারা গাছ লাগালে পাড়ার ছেলে বউদের আম পেয়ারা জাম থেকে বিরত করা যায় না। তারা কোন না কোন সময় এসব চুরি করেই হোক, ভিক্ষা চেয়েই হোক বা জোর করেই হোক তা তারা খাবেই। এগুলি থেকে তাদের আটকানো যাবে না। তাই এসব বিষয়ে রাগ করো না দাদা।এগুলি সয়ে যাও।


আমার মটকায় তখন বার হাজারের ভোল্টেজ। আমি রাগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু না বলে আমি তখনকার মতো চুপ করে গেলাম। গিন্নি বললো- ও আম আর পেয়ারার গাছ রেখে লাভ নেই। সব তো পাড়ার বউ বাচ্চারা খেয়ে নেবে। তার চেয়ে ওই জায়গায় নারিকেল চারা বসিয়ে দাও। আর কোন সমস্যা থাকবে না।


আমি বললাম- দেখো, আমি বামুনের ছেলে। বুদ্ধিতে আমি ওদের থেকে ঢের এগিয়ে। ওদের পাতা ফাঁদে যদি ওদের কুপোকাত করতে না পারি, তবে আমার নাম দ্বৈপায়ন মুখুজ্জে নয়।


পরের দিন, আমার পুকুরে যা মাছ ছিল তা ধরে বিক্রি করে দিলাম। হাতে বেশ কিছু নগদ টাকা এলো। আমার নতুন বাস্তু বলে আর তেমন কিছু ফল গাছ নেই। নারকেল গাছ খান সাতেক আছে। কিন্তু সেগুলি এখন বেশ ছোট। পেয়ারা গাছে এখন পেয়ারা আসে নি। ফলে পাড়া পড়শীর বউয়েরা আর আমার বাড়িতে কোন কিছু নিতে পারবে না।


এবার আমায় খেলা শুরু করতে হবে। আমার মাছ ধরার একটি বেশ বড় খেপলা জাল ছিল। তাই নিয়ে রবিবার অফিস ছুটির দিন কানাইয়ের পুকুরে গিয়ে হানা দিলাম। কানাই আর কানাইয়ের বউ দুরের চাষ জমিতে সবজি চাষ করতে গেছে। বাড়িতে আছে তার একমাত্র মেয়ে রূপা। তাকে দেখিয়ে আমি একবার পুকুরে জাল দিলাম। তাতেই খাবার জোগাড় হয়ে গেল। আমি গোটা সাতেক বড় কই মাছ আর দুটো পাঁচ সাতশো ওজনের রুইমাছ নিয়ে বাড়ি এলাম।


আমার জাল ফেলা দেখে রূপা তার বাবা মায়ের কাছে সাইকেল নিয়ে দৌড়ে গিয়ে খবরটা দেয়। কানাই দৌড়ে এসে আমার উপরে চোটপাট করতে শুরু করে। বলে কোন অধিকারে আমার পুকুরে তুমি মাছ ধরলে?

-যে অধিকারে তোর বউ আমার গাছের আম পেড়েছিল, সেই অধিকারে। আমি শান্ত স্বরে উত্তর দিলাম। কানাই স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল, আমার কথা শুনে। তারপর বললে- আম আর মাছ কি এক জিনিষ?

-না, এক জিনিষ নয় তো! যেমন তেমনভাবে পুকুরে মাছ ছাড়লে, মাছ হবে। কিন্তু আম ফলাতে পরিশ্রম আর ভাগ্য লাগে! আমি শান্তভাবে বললাম। কানাই গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে গেল। 


পরের দিন হানা দিলাম দুলালের পুকুরে। দুলালের বউ প্রায় কিলো তিনেক আম কোঁচড়ে করে বয়ে নিয়ে গেছে। ওটাই পালের গোদা। দুলালের পুকুরে জাল দিতেই উঠে এলো কিলো দেড়েক কাতলা আর খান তিনেক পাবদা এবং খান দশেক মাঝারী মাপের কই। তাই নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। দুলাল বাড়িতে নেই। সে গাড়ির ড্রাইভার। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে রাতে বাড়ি ফেরে। রাতে বাড়ি ফিরে সব শুনে দুলাল সেই রাতেই আমার বাড়িতে এসে আমায় জিজ্ঞেস করলে- দীপুদা, তুমি আমার পুকুরে মাছ ধরলে কেন?

-তোর বউ আমার গাছের আম পাড়লো কেন?

-কোথায় আম আর কোথায় মাছ!! মাছের সঙ্গে আমের তুলনা হয়? দুলাল বলে।

-তুই ঠিক বলেছিস। আমের সঙ্গে মাছের তুলনা চলে না। মাছ যেমন তেমনভাবে ফলানো যায়। কিন্থ আম ফলাতে গেলে পরিশ্রম আর ভাগ্য লাগে। তোর বউ যখন আমার গাছের আমগুলো পেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তোর মতো আমারও কষ্ট হয়েছিল। আমি জাতে বামুন। জগড়া ঝাটি করলে পাছে অভিশাপ দিয়ে ফেলি, এই ভয়ে আর কোন উচ্চবাচ্য না করে দুলাল পিঠটান দিল।


পরের দিন ছিল মঙ্গলবার। আমার অফিস যাওয়ার দিন। সকালে পাড়ার মোড়ল বিপিন খুড়ো বাড়িতে এসে উপস্থিত। সঙ্গে আছে কানাই,দুলাল,বিমল আর রবীন। বুঝলাম যারা আম পেড়েছিল, তাদের হয়ে খুড়ো ওকালতি করতে এসেছে। খুড়ো কোন রকম গৌরচদ্রিকা না করে সরাসরি বললে- বাবা, দীপু এরা সবাই আম তোলার ব্যাপারটা যে অন্যায় হয়েছে, তা মেনে নিয়েছে। এরা আর কোনদিন তোমার ফলের দিকে তাকাবে না কথা দিচ্ছে। তুমি আর ওদের পুকুরে হানা দিও না।

-আমি হাসতে হাসতে বললাম- তা না হয় মানলাম খুড়ো। কিন্তু এখনো বিমল আর রবীনের পুকুরে হানা দেওয়া বাকি। ওদের পুকুরে হানা না দিলে, কানাই আর দুলালের উপর অবিচার করা হবে যে!!

- এবার বিমল আর রবীন বললো- আমরা দু'দিন মাছ খাওয়াবো দাদা। আমাদের ভুল হয়েছে। তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও।


আমি অফিস বেরিয়ে পড়েছি। তাই সংক্ষেপে বললাম- আমার বেদনা বোঝাতে আমি এই কান্ড করেছি ভাই। আমাকে তোমরা ভুল বোঝ না। তারপর কানাই আর দুলালের হাতে তিন'শ করে টাকা করে গুঁজে দিয়ে বললাম- তোদের ক্ষতি পূরণ দিলাম। কিছু মনে করিস না। আমি এবার দেরি না করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।


কপিরাইট @তারাপদ মাঝি

২'রা জানুয়ারী,২০২২

দেবনগর।


কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.