#”মায়াবন_বিহারিণী _হরিণী”


#গল্প

#”মায়াবন_বিহারিণী _হরিণী”

#তারাপদ_মাঝি


(এই গল্প একেবারে কাল্পনিক। বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। কারুর সঙ্গে যদি মিলে যায় তা নিহাতই কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত)


দাদা, আপনি শুধু আমাদের উপর রাগ করেন।কই কোন দিন তো শর্মিলার উপর রাগ করতে দেখিনি। তার বেলায় তো বেশ দরদ দিয়ে কথা বলতে শুনি। আগের মিটিং এ দেখলাম শর্মিলা আপনাকে ভুল রিপোর্ট দিল। আপনি সেটা চিহ্নিত করলেন কিন্তু কিছু বললেন না। দিব্যি হেঁসে হেঁসে সব কিছু মানিয়ে নিলেন। ঐ ভুল যদি শর্মিলা ছাড়া আমরা কেউ  করতাম, তাহলে আমাদের আস্ত চিবিয়ে খেতেন। কেন আপনি এমন বৈষম্যমুলক আচরণ করছেন একটু বলবেন কি?


কথাটি বললো সাব-সেন্টারের দিদিমনি ঋতুরাণী গুহ। প্রতি পঞ্চায়েতে প্রতি মাসের চতুর্থ শনিবার একটি স্বাস্থ্যের মিটিং বসে। তাতে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোন সমস্যা হলে আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করা হয়। এ ছাড়া আরও অনেককিছু আলোচনা হয়। এই মিটিং এ উপস্থিত থাকেন মাননীয় পঞ্চায়েত প্রধান, স্বাস্থ্যের সঞ্চালক, সমস্ত সাব সেন্টারের দিদি, আশা দিদি, হেলথ সুপার ভাইজার,  আই সি ডি এস এর দিদি ছাড়া আরও অনেকে। প্রায় নব্বই এক'শ জন লোকের মাঝে ঋতুরাণী যে অভিযোগ তুললেন মাননীয় সেক্রেটারী বিকাশ মন্ডলের বিরুদ্ধে তা শুনে সবাই অবাক এবং হতবাক হলেন। অবশেষে মাননীয়া প্রধান বেনুবালা মাইতি বলেন- ঋতু তোমার অভিযোগ ভিত্তিহীন।ব্যাপারটা সম্পুর্ণ কাকতালীয়।


কিন্তু প্রধানের এই বক্তব্যের পরেও সাত দিদির মধ্যে ছয়জন তীব্র প্রতিবাদ করলেন। বাধ্য হয়ে সেক্রেটারী বিকাশবাবুকে এই অভিযোগের উপর নিজের বক্তব্য রাখতে হলো।বক্তব্য রাখতে উঠে বিকাশবাবু বললেন-ঋতুদিদির অভিযোগ সত্য। উনি যে অভিযোগগুলি করেছেন তার সবগুলি সঠিক। হ্যা,আমি শর্মিলাদির রিপোর্ট গুলি ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে সংশোধন করে দেই। দু একটি ডিলে বার্থ বা ডেথ সার্টিফিকেট পাইয়ে দেই। উনার সাব সেন্টারের যে যে অসুবিধা হয় সেগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করে দেই। এই সুবিধাগুলি অন্য দিদিরা পায় না। তাই আমি পক্ষপাত দুষ্ট।


প্রধান বেনুবালা রেগে আগুন হয়ে গেছেন। তিনি চিৎকার করে বললেন- আরে আপনি এ সব কেন করছেন! কোন উত্তর আপনার কাছে আছে কি?

-উত্তর নিশ্চয় আছে। কিন্তু তা জানতে হলে সভায় শর্মিলাদির থাকা চলবে না।

-আমাকে তো থাকতেই হবে। আমি যে এই সুবিধাগুলো পাই তা আমি জানতাম না। আমি জানি আমার মতো সবাই এই সুবিধাগুলো ভোগ করে। শুধু আমাকে কেন এই সুবিধগুলো দেওয়া হবে! আমিও এর প্রতিবাদ করছি।

-এবার প্রধান বেনুবালা বললেন- সেক্রেটারীবাবু এবার আপনি আপনার বক্তব্য জানান। কেউ বাইরে যাবে না। সবাই থাকবে মিটিং এ।


বিকাশবাবু বললেন-শর্মিলাদি আমি যে কথা বলতে যাচ্ছি তা আমার একেবারে ব্যক্তিগত। আপনি এর মধ্যে একেবারেই জড়িত নন। কিন্তু আমার কথা শোনার পর সবাই আপনাকে খারাপ ভাবে দেখবে। আপনিও আমাকে আর সেভাবে শ্রদ্ধা করবেন না। তাই আপনাকে মিটিং এ থাকতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু আপনি যখন শুনবেন ঠিক করেছেন, তাহলে শুনুন।


বিকাশবাবু বললেন- আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে আপনি পড়তেন নারায়নপুর হাইস্কুলে। তখন আপনি কম বেশী ষোড়শী হবেন।পড়তেন মাধ্যমিকে। দেখতে আজ যেমন সুন্দরী, তখন ছিলেন আরও বেশী সুন্দিরী। আপনার দীঘল নয়ন, হরিণীর মতো গমন, উর্বশীর মতো কিন্নর কন্ঠ যে কোন যুবকের হৃদয় ষ্পন্দনকে স্তব্ধ করার পক্ষে যথেষ্ট। সেই স্কুলে আমি তখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তাম। আপনার প্রেমে পড়ে গেলাম এক তরফাভাবে। বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় আপনার রবীন্দ্র নৃত্য দেখে কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। ভালোবাসার কথা আর জানানো হয় নি। কিন্তু সেই ভালোবাসা আমি আজও ভুলিনি।

-এতদিনে আমার সমস্যা মিটলো। যেদিন থেকে আপনি পঞ্চায়েতে এসেছেন, সেদিন থেকে আপনাকে আমার চেনা চেনা মনে হতো। কিন্তু কিছুতেউ মনে করতে পারছিলাম না। শর্মিলা কথাগুলি বললে।

-আমি যাকে ভালোবাসি, তার ভুল ভ্রান্তির দায় আমি মাথা পেতে নিতে পারি। কিন্তু বাকিদের দায় আমি কেন নেব? বিকাশবাবু কথাগুলো বললেন।


-আচ্ছা, আপনি যে শর্মিলাকে ভালো বাসতেন, তা তাকে জানিয়েছিলেন কোন দিন? প্রধান বেনুবালাদেবী বিকাশবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন।


-মাথা খারাপ! জানিয়ে মরি আর কি? বিকাশবাবু বলে।

-কেন? বেনুবালা জিজ্ঞাসা করে।

-আমি গরীবের ছেলে। কোন দিন খাবার জোটে, আবার কোন দিন জোটে না। দেখতেও খারাপ। দেখতেই পাচ্ছেন আমার গায়ের রঙ কয়লাকেও হার মানাবে। ছিল একমাত্র উর্বর মস্তিষ্ক। তা তখন মাথার দাম আর কে দেয় বলুন। তাহলে কিসের গর্বে উনাকে ভালোবাসার কথা জানাবো যেখানে শর্মিলাদির বাবা আমার অংকের টিচার, অসম্ভব ধনী ব্যক্তি। এগুলো বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম বলে আজ ন্যুনতম পক্ষে সেক্রেটারী হতে পেরেছি। তা না হলে ওখানেই আমার সমাধী হতো।


এবার ঋতুদিদি বললে- তা বিকাশবাবু, শর্মিলাদির মধ্যে কি আছে, যা আমাদের মধ্যে নেই! শর্মিলাদিকে যেমন ভালোবাসেন, তেমনভাবে আমাদেরকেও ভালোবাসুন। আমরাও আপনাকে এখনো ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে পারি। 


এই কথা শুনে সবাই হো হো করে হেঁসে ওঠে। এমন সময় প্রধান বেনুবালাদেবী বললেন- মিটিংটাকে প্রেমের পাঠশালা করে লাভ নেই। সেক্রেটারীবাবু আপনি নিজেকে সংশোধন করুন। তবে আপনার সত্যবাদীতার জন্য ধন্যবাদ। তাই আশা করছি আপনি নিজেকে সংশোধন করতে পারবেন। 


অবশেষে মিটিং শেষ হলো।


************************************************ 


এই ঘটনার এক মাস পরে বিকেলে কালবৈশাখী ঝড় হলো। চললো সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত।সাড়ে সাতটার সময় শর্মিলা সেক্রেটারী বিকাশবাবু ফোন করে বললো- সাব সেন্টারে আটকে আছি। ঝড়ের জন্য বাড়ি ফিরতে পারি নি। আমাকে একটু বাড়ি পৌছে দেবার ব্যবস্থা করুন।


বিকাশবাবু রাত আটটার সময় একটি টোটো গাড়ি নিয়ে শর্মিলাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। মিশমিশে কালো অন্ধকার। কেবল টোটো গাড়ির হেড লাইটে দেখা যাচ্ছে অজগর সাপের কালো শিরদাঁড়া। পিছনে দুটি হৃদয়। হঠাৎ শর্মিলা বিকাশকে অন্ধকারে জড়িয়ে ধরলো এবং নিজের পক্ক বিম্বোষ্ঠ ছুঁইয়ে দিল বিকাশের ঠোঁটে।


কপিরাইট @তারাপদ মাঝি

দেবনগর

৪ঠা জুন, ২০২২ খ্রীষ্টাব্দ।


কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.