#বাঁশ_নিয়ে_বাঁশ_দেওয়ার_গল্প


সুন্দর গল্প ও কবিতা


“বিশ্বাস” এমন একটি গুন যা অর্জন করতে পারলে জগতে কত কাজ না সহজে সমাপন করা যায়। তাই কোন ব্যক্তিকে বিশ্বাস করবার আগে খুব ভালোভাবে যাচাই করার পর বিশ্বাস করা উচিত। যাচাইয়ের পরও যদি দেখা যায় যায় ব্যক্তিটি সত্যই বিশ্বাসের উপযোগী তাহলে বৃহৎ কোন কাজে বিশ্বাস করার আগে সেই কাজের লাভ ক্ষতি হিসেব করে তবে বিশ্বাস করা উচিত। আমি যখন এই কথাগুলি বললাম, তখন আমার এক ছাত্র দাঁড়িয়ে উঠে বললো- স্যার বিষয়টা বোধগম্য হলো না। একটু উদাহরণ দিয়ে যদি বুঝিয়ে বলেন তাহলে বুঝতে সুবিধা হতো।
ঐ চাত্রটিকে আমি একেবারে সহ্য করতে পারি না। কারণ ও মাঝে মাঝে এমন সব প্রশ্ন করে বসে যার বাস্তবে কোন উত্তর হয় না। ওর প্রশ্নগুলো শুনলে আপনারা অবাক হবেন কি না জানি না। কিন্তু আমি সমাজবিদ্যার শিক্ষক হয়ে ওর ঐ প্রশ্নগুলো একেবারে সহ্য করতে পারি না। টেবিল এর নাম খাট হলো না কেন? বাঘের নাম সিংহ হলো না কেন? জলকে তেল বললে কি এমন অসুবিধা হতো শুনি?ভাতকে রুটি বলে নামকরণ হয় নি কেন? ইত্যাদি সব মাথামুন্ডুহীন প্রশ্ন করে জ্বালাতন করতো। ওর জন্য আমি এবং ওর সহপাঠিরা খুব বিরক্তবোধ করতো। কিন্তু ঐ চাত্রটির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ওর কথায় যে আমরা বিরক্ত বোধ করছি, তা সে কেয়ারই করতো না! চেলেটির নাম ছিল অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়। বামুনের ছেলে বলে ওর উপর খুব একটা তর্জন গর্জন করতাম না। তা আজ একটা ওর কাছ থেকে যুতসই প্রশ্ন শুনে খুব আনন্দ পেলাম। আমার মনে হয় অনির্বাণ এই প্রথম একটি সুচিন্তিত প্রশ্ন করলো।
যাইহোক আমি অনেক উৎসাহ নিয়ে একটি গল্পের সাহায্যে “বিশ্বাস” নামক মানবিক গুনটির অপব্যবহার বোঝাতে প্রয়াসী হলাম। আমি আমার গল্প শুরু করলাম-
এক গ্রামে নারায়ন সমাদ্দার নামে এক চতুর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার চাতুর্য দিয়ে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়ে ছিলেন। কিন্তু তার সমুহ সম্পত্তি অসৎ উপায়ে অর্জন করা।নারায়নের গ্রামে প্রচুর পানের বরজ ছিল। বরজে প্রচুর বাঁশের প্রয়োজন হতো।একদিন নারায়নের মাথায় এক বদ বুদ্ধি এলো। একদিন সে পান চাষীদের কাছে গিয়ে বললো- আমি তোমাদের যত বাঁশ লাগে সব বাঁশ সরবরাহ করবো। বাশের দাম তোমরা একেবার শহরের দামে পাবে এবং তোমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌছে দেওয়া হবে। তবে বাঁশ পৌছে দিলেই হাতে হাতে বাঁশের দাম দিয়ে দিতে হবে।
চাষীরা নারায়নের কথা ভেবে দেখলো যে এতে চাষীদের লাভ বই ক্ষতি হবে না। তাই চাষীরা নারায়নের কথায় রাজী হয়ে গেল। এবার নারায়ন কিছু টাকা নিয়ে শহরের সবচেয়ে বড় বাঁশ বিক্রেতার দোকানে গিয়ে বাঁশের দরদাম করলো এবং একসঙ্গে অনেক বাঁশ নিচ্ছে বলে দোকানী তাকে বাঁশের দামও একটু কমালো এবং তাদের গ্রামের বড় রাস্তা পর্যন্ত বাঁশগুলো পৌছে দেওয়ার সুবিধা দিলো। এতে নারায়নের বেশ ভালো একটা লাভ থাকলো।
প্রতি মাসে নারায়ণ বাঁশের দোকানে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকার বাঁশ কিনতে লাগলো এবং সবই নগদে কিনতো। এই রকম করে বছর খানেক ব্যবসা করার পর নারায়ন শহরের বাঁশ দোকানী পরমব্রতবাবুর খুব বিশ্বাসী খদ্দেরে পরিনত হলো।
একদিন প্রচুর ঝড় হলো। ঝড়ের কোন পূর্বাভাষ ছিল না। ফলে পান চাষীরা ঠিক মতো বরজ রক্ষণাবেক্ষণ করার সময় পান নি। ফলে সেই ঝড়ে গ্রামের সকল বরজ ভূপতিত হয়। ঝড়ের পরে গ্রামে বাঁশের চাহিদা বেড়ে যায়। নারায়ন সবাইকে বাঁশ দেবে বলায় সবাই নারয়নকে বাঁশের অর্ধেক টাকা অগ্রিম দেয়। যেহেতু আজ পর্যন্ত নারায়ন গ্রামের কোন চাষীকে ঠকায় নি, তাই সেই বিশ্বাসে নারায়নকে বাঁশের জন্য অগ্রিম টাকা দিতে অসুবিধা হয় নি।
সেই টাকা নিয়ে নারায়ন শহরের দোকানে যায়। সেখানে গিয়ে সে পরমব্রত বাবুর সঙ্গে কথা বলে যে সে তাকে দশ লাখ টাকা জমা দিলে তিনি তাকে কুড়ি লাখ টাকার বাঁশ দেবেন কি না? যদি তিনি না দেন তবে অন্য বাঁশের আড়তে বাঁশ কিনবেন। পরমব্রতবাবু ভালো ভাবেই জানতেন যে নারায়নবাবু তার একজন ভালো খদ্দের। আজ পর্যন্ত সে কোন দিন ধারে বাঁশ কিনেন নি। ফলে অন্যান্য বাঁশের আড়তের মালিকরা নারায়নকে অনেক টোপ দিয়েছে নারায়নকে তাদের দোকানে বাঁশ কেনার জন্য। কিন্তু নারায়ন তাদের সেখানে বাঁশতো কিনতেন না। বরং অনেক সময় তাদের সান্নিধ্য পছন্দ করতেন না। ফলে পরমব্রতবাবু নারায়নকে অনেক পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাসও করতেন। তাই নারায়নবাবু যখন দশ লাখ টাকা জমা দিয়ে কুড়ি লাখ টাকার বাঁশ নিতে চাইলেন তখন পরমব্রতবাবু আর না বলতে পারলেন না। দশ আখ টাকা নিয়ে তিনি নারায়নবাবুকে কুড়িলাখ টাকার বাঁশ দিলেন।
এবার নারায়নবাবু গ্রামের বাড়িতে এসে সব বাঁশ বেচে নিজের হাতে বাঁশের লাভ্যাংশ এবং দশ লাখ টাকা আছে। ঐ টাকা নিয়ে নারায়নবাবু ইটের ব্যবসায় নামলেন। নারায়নবাবু আর পরমব্রতবাবুর টাকা দিলেন না। পরমব্রতবাবু টাকার জন্য কোর্টে গেলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই নারায়নবাবুকে কোর্টে দোষী প্রমাণ করতে পারলেন না। ফলে পরমব্রতবাবুর দশ লাখ টাকা বাঁশ গেলো।এই ভাবে বিশ্বাসের দায়ে পরমব্রতবাবুর বাঁশ গেলো।
এবার আমি ছাত্রদের বললাম- পরমব্রতবাবুর উচিত ছিল সবকিছু বিবেচনা করে নারায়নকে ধারে মাল দেওয়ার বিষয়টি। কিন্তু তিনি কেবলমাত্র বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে দশ লাখ টাকার বাঁশ ধারে দিয়ে দিলেন। এটাই হলো অতিরিক্ত বিশ্বাসের খারাপ দিক। তাই আমার উপদেশ কাউকে বিশ্বাস করো ঠিক আছে। কিন্তু চরম বিশ্বাসের আগে এক'শ বার ভেবে দেখো। না হলে যে কোন সময় বাঁশ যাবে ঠিক পরমব্রতবাবুর মতো।
এবার অনির্বাণ দাঁড়িয়ে বললো- একটি কথা বলবো স্যার।
-বলো।
- বলছিলাম কি, যতই ভাবনা চিন্তা করুন না কেন কোন লাভ নেই। কপালে থাকলে বাঁশ আপনার ঠিক যাবেই। কপালে না থাকলে কারুর কখনো বাঁশ যায় না।
এরপর আমার আর কথা বলার ইচ্ছা রইলো না। বিরক্ত হয়ে আমি ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।

কপিরাইট @তারাপদ মাঝি
দেবনগর-নামখানা
৭ই সেপ্টেম্বর,২০১৯

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.