#হিন্দু _না_ওরা_মুসলিম? ঐ_জিজ্ঞাসে_কোন_জন?


সুন্দর গল্প ও কবিতা

#হিন্দু _না_ওরা_মুসলিম? ঐ_জিজ্ঞাসে_কোন_জন?

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। স্কুলের হোষ্টেলে থাকতে হবে স্কলারশিপ পরীক্ষার বিশেষ প্রস্তুতির জন্য। আমাকে একটি বড় খাটে থাকতে দেওয়া হলো।খাটটি এতো বড় যে অনায়াসে অন্তত তিনজন ঘুমানো যেতে পারে। তা আমি আমার বিছানাপত্র নিয়ে বেশ জমিয়ে জায়গা নিলাম। দিন দুয়েক পরে আমার খাটেই আর একজন ছাত্রকে থাকতে দেওয়া হলো। স্যার বললেন- এতো বড় খাট তোমার একার জন্য নয় বাবু। হোষ্টেলের প্রত্যেক খাটে যাতে দুইজন করে থাকতে পারে সেই রকম ভাবে তৈরী করা হয়েছে। অগত্যা আমার আর কিছুই করার ছিল না। একটু কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু স্যারের বিরুদ্ধে তো আর বিদ্রোহ করা যায় না? তাই বাধ্য হয়ে মেনে নিলাম।
যে ছেলেটি আমার সঙ্গে থাকতে এলো বা আমি যার সঙ্গে এক বিছানায় থাকবো তার নাম জিজ্ঞাসা করায় সে জানালো যে তার নাম -সেক আহাসান উল্লা। আমি নাম শুনে একেবারে অবাক। আমি তো ঐ বয়সে এই রকম নাম শুনিনি। আমি বললাম- ভাই তোর এ কিরকম নাম? এ রকম নাম আবার হয় নাকি?
সে বললো- হয় না মানে? মুসলিম হলে এ রকম নামই হয়।
-মুসলিম, সে আবার কি?

সে আমাকে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। তারপর ঐ নিয়ে আর আমাদের মধ্যে কোন আলোচনা হতো না।তারপর আমরা এমন বন্ধু হয়ে গেলাম যে দুজনে এক লেপের তলায়, এমন কি এক থালায় পর্যন্ত খেয়েছি। ওর বাড়ি ছিল সাগর দ্বীপে। প্রতি মাসে আহাসানের বাবা হোষ্টেলে এলেই ছেলের সঙ্গে এবং আমার সঙ্গে দেখা না করে যেতেন না। আমরা একে অপরের পরিপুরক হয়ে গেলাম।ক্লাস এইটের শেষের দিকে আমাদের ইতিহাসের পাঠ্য পুস্তকে হযরত(র) মহম্মদ এবং তার প্রচারিত ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে জানলাম।তারপরে জানলাম ইসলাম ধর্ম গ্রহনকারী মানুষদের মুসলমান বলা হয়। তখনই বুঝলাম আমার বন্ধুটি বংশ পরম্পরায় ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
একসঙ্গে থাকতে থাকতে আমরা যখন ক্লাস টেনে উঠলাম, ভারতের ইতিহাস আমার মনে একটি বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করলো।ইতিহাস পড়তে পড়তে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটি ধারনা হয়ে গিয়েছিল।তারপর যখন পলাশী যুদ্ধের ইতিহাস পড়লাম তখন আমার অন্যান্য বন্ধুরা আহাসানের সঙ্গে কোনকিছু নিয়ে ঝগড়া হলেই ওকে “মিরজাফরের”জাত বলে ক্ষ্যাপাতো। আমি আমার বন্ধুর সাহায্যে এগিয়ে গিয়ে বলতাম- আহাসান যদি “মিরজাফরের জাত” হয় তাহলে তুই হলি “উমি চাঁদের জাত”। কারণ উমিচাঁদের বিশ্বাস ঘাতকতা মিরিজাফরের তুলনায় কম ছিল না।
আজ পঞ্চাশ বসন্ত পেরিয়ে এসে ভারতের অর্থনীতি, রাজনীতি,সামাজিক নীতিবোধ ইত্যাদি বিষয়ে সম্যক ধারণা হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে হিন্দু, মুসলমান,খ্রীষ্টান,বৌদ্ধ, জৈন্য, শিখ ইত্যাদি জাতি সহাবস্থান করছি। প্রত্যেক জাতি একে অপরের প্রতি সহানুভুতিশীল হলেও কিছু কিছু হিন্দু মুসলমানেদের যেমন সহ্য করতে পারে না, তেমনি কিছু মুসলিমও হিন্দুদের সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমার মনে হয় এরকমটা হওয়া আদৌ বাঞ্ছনীয় নয়। এতে কারুরই কোন উপকার হবে না। বরং পরষ্পর পরষ্পরের সঙ্গে লড়াই করে প্রানহানি আর অহেতুক রক্তক্ষয় ছাড়া কিছুই হবে না।নিজেদের মধ্যে বিরাজ করবে চির অশান্তি।

বর্তমানে পৃথিবীর ঘটনা পরম্পরা বিশ্লেষন করে দেখা যায় যে যেখানে যে জাতি সংখ্যা লঘু, সেখানে সংখ্যা লঘু জাতির উপর সংখ্যাগুরু জাতীর অত্যাচার মানব জাতিকে তার সুসভ্যতার মেকি মুখোসকে চোখে আগুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার, বাংলাদেশে এবং পাকিস্থানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার, কাশ্মীরে কাশ্মীরী পন্ডিতদের উপর অত্যাচার,ইহুদীদের উপর অত্যাচার ইত্যাদি ঘটনা পর্যবেক্ষন করে আমাদের দেশের অনেক হিন্দুরা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষে অবতীর্ন হতে উদ্যত হয়েছেন যাকে সংবাদের শিরোনামে “অসহিষ্ণুতা” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন এরকম করে লাভ কি? আমাদের দেশকে কি হিন্দুরা মুসলিম মুক্ত দেশে পরিনত করতে পারবেন? পারবেন কি ভারতকে পাকিস্থানের মতো (মাত্র ১.৮৫% হিন্দু) সংখ্যা লঘু মুসলমান রাষ্ট্রে পরিনত করতে? কিংবা পারবেন কি ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পরিবর্তে হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে? হিন্দুত্ববাদীরা (আমিও একজন হিন্দুত্ববাদী হিসাবে মনে করি) বাস্তবটা বোঝার চেষ্টা করুন। বাস্তবটা হলো এই যে ভারতকে কখনোই হিন্দু রাষ্ট্র বা ইসলামিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষনা করা সম্ভব নয়। তাহলে হিন্দু আর মুসলমান পরষ্পরের মধ্যে বিরোধ করে কেন অবিমিশ্রকারীর মতো কাজ করছেন উভয়েই?
এবার আমি পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করবো যে হিন্দু মুসলমান পরষ্পরের মধ্যে বিরোধ করা কতটা হাস্যাষ্পদের বিষয়। ২০১১ আদমসুমারী অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যা হলো ১৩৩৯২০০০০০ জন এর মতো যার মধ্যে ১৫% মুসলমান। প্রায় ৭৯% হিন্দু। বাকী অন্যান্য সম্প্রদায়। হিন্দুরা হয়তো ভাবতে পারেন যে এই ১৫% মুসলমানকে নিপিড়ন আর অত্যাচারের মাধ্যমে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে বা সংখ্যাটিকে ৪-৫ শতাংশে কমিয়ে আনতে পারলে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়। কিন্তু বন্ধু এবার একটু অংকের খেলায় যাওয়া যাক। তাহলে মুসলিম বিদ্বেষীদের চোখ কপালে উঠবে।ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৫% হলো ২০০৮৮০০০০ জন। পারবেন এই পরিমান মানুষকে খুন করে বা অত্যাচার করে দেশছাড়া করতে! বর্তমানে পাকিস্থানের লোক সংখ্যা প্রায় ১৯০৭০০০০০ জন অর্থাৎ পাকিস্থানে যে পরিমান মুসলমান আছে তার চেয়েও বেশী মুসলমান আছে ভারতে। কোন মতেই একটি দেশের সমতুল জনসাধারণকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার বাসনা একেবারে আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র নয় কি? তাহলে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ করে, হিংসা করে কিংবা ঘৃনা করে যে কোন লাভ নেই এই বোধটি প্রত্যেকটি হিন্দু কিংবা মুসলমানের বোঝা উচিত।
ভারতের প্রত্যেকটি জাতীর সামগ্রিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বিশ্লেষন করে দেখা গেছে এক বিশেষ তথ্য।তাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে একজন দম্পত্তি তার জীবনকালে যে পরিমান সন্তান উৎপাদন করে তাতে প্রথম স্থানে রয়েছে ইসলামীরা(২.৬১ জন প্রতি দম্পত্তি)দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন হিন্দুরা(২.১৩ জন প্রতি দম্পত্তি)তৃতীয় স্থানে রয়েছে খ্রীষ্টানরা(১.৯৯ জন প্রতি দম্পত্তি) এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে শিখরা(১.৫৮ জন প্রতি দম্পত্তি)[তথ্যসুত্রঃTIMES OF INDIA, DATE-12 JANUARY 2018] এই তথ্যানুযায়ী কোন কোন ইসলামী ভাই যদি মনে করেন যে আমাদের জন্মহার বাড়িয়ে হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে একদিন হিন্দু জনসংখ্যা থেকে গরিষ্ঠ হয়ে ভারতের শাসন দন্ড হাতে পাবো এবং তারপর ভারত থেকে হিন্দুদের নির্জাতন, অত্যাচার, নিপিড়ন এবং বিতাড়ন করে ভারতকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিনত করা হবে, তাহলে সেই ধারনাও অবাস্তব। যারা একটু অংক বোঝেন তারা আমার দেওয়া এই তথ্য নিয়ে অংকের খেলায় নামুন। তাহলে আপনাদের কাছে সম্পুর্ন চিত্রটি একেবারে পরিস্কার ফুটে উঠবে। আর মুসলমান ভাইয়েরা যদি হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরুও যদি করেন তাহলে, হিন্দুরাও ছেড়ে কথা বলবে না। কারণ বাংলাদেশের আর পাকিস্থানের হিন্দুদের পালিয়ে আসার জায়গা ছিল ভারত। কিন্তু ভারতের হিন্দুদের পালিয়ে যাওয়ার জায়গা কোথায়? তখন হিন্দুরা নিজেদের অস্তীত্ব রক্ষার জন্য জীবনপন লড়াই করবে। তাতে অবশ্য কে জিতবে বলা মুসকিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধে যে উভয় পক্ষের বিশাল ক্ষতি হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকবে না। কিন্তু সবাই যদি আমরা মিলে মিশে একে অপরের বন্ধু হয়ে সমাজে বসবাস করি, তাহলে এই অবক্ষয় কোনদিন আমাদের দেখতে হবে না। তাই হিন্দু মুসলমান বিদ্বেশ নয়, বিভেদ নয়, পরষ্পর পরষ্পরকে ঘৃনা নয়। পরষ্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁচা উচিত।
এবার আমি অতীতে ভারতে সংঘটিত সাম্পরদায়িক দাঙ্গাগুলোর উদাহরন দিচ্ছি। ১৯৬১ সালে জব্বলপুরের দাঙ্গা, ১৯৬৯ সালে আমেদাবাদের দাঙ্গা, ১৯৭৯ সালে জামসেদপুরের দাঙ্গা, ১৯৮০ সালের মোরাদাবাদের দাঙ্গা, ১৯৮৯ সালে ভাগলপুরের দাঙ্গা, ১৯৯২ সালে বোব্বাইয়ের দাঙ্গা, ২০০২ সালের গোধরার দাঙ্গা, ২০০৭ সালের কলকাতার দাঙ্গা, ২০১০ সালে কর্নাটকের দাঙ্গা, ২০১৩ সালে ক্যানিং এবং মুজফরনগরের দাঙ্গা, ২০১৭ সালের বসির হাটের বাদুড়িয়া এবং ধুলাগড়ের দাঙ্গা।[ তথ্যসুত্রঃ-B.B.C BENGALI NEWS. DATE-19/07/2017 REPORTER-SUBHRAJYATI GHOSH, EBELA. IN DATE-15/01/2017 AND BANGLADESH PRATIDIN DATE-13/07/2017, WRITER- TASLIME NASRINE-BANGLADESH] এই সমস্ত দাঙ্গাগুলি ভারতের স্বাধীনতার পর হিন্দু এবং মুসমানের মধ্যে হওয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গাগুলি থেকে আমাদের কি লাভ হয়েছে? এই দাঙ্গাগুলি থেকে হিন্দু মুসলমান পরষ্পরের থেকে আরও দূরে সরে গেছে, পরষ্পরের প্রতি সৌহার্দ্য কমেছে, তিক্ততা বেড়েছে। আর এইসব যন্ত্রনা নিয়ে আমরা এক দেশে, এক রাজ্যে, এক জেলায়,এক গ্রামে বা এক শহরে বাস করছি।এই বসবাস পরষ্পরের কাছে খুবই যন্ত্রনার। আমরা যদি পরষ্পরকে ভাতৃভাবে নিতাম তাহলে অতীতের এই দাঙ্গাগুলো হতো না এবং নিজের আত্মীয়দের হারাতাম না। আসুন আমরা হিন্দু মুসলমান ভাইয়েরা একে অপরের হাতধরে এগিয়ে চলি এবং ভবিষ্যতে যাতে কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যাতে না হয় তা সুনিশ্চিত করে দেশকে আরও সুন্দরভাবে গঠন করি।
বিস্তীর্ন জলরাশির মধ্যে কোন একবিন্দুতে আঘাত করলে যে জলতরঙ্গ উৎপন্ন হয় এবং সেই তরঙ্গ যেভাবে সমগ্র জলরাশিতে বিস্তারলাভ করে, ঠিক তেমনি দেশের কোন এক জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে তা সমগ্র দেশে বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। কোন কোন সময় তা দেশের সীমান্ত পার হয়ে বিদেশেও বিস্তারলাভ করে। ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলিরমধ্যে নেপাল ছাড়া বাকি দেশগুলিতে হিন্দুরা সংখ্যা লঘু। একবার তথ্যের দিকে নজর দেওয়া যাকঃ-(১)চিনঃ মোট জনসংখ্যা-১৩৮৬৪০০০০০, মুসলমান-০.৪৫%, হিন্দু-১.০% বা ১৩৭৩৫৪১৩জন। (২) মায়ানমারঃ মোট জনসংখ্যা-৫৩৪০০০০০০, মুসলমান-৪.২%, হিন্দু-০.৫% বা ২৬৭০০০ জন। (৩) থাইল্যান্ডঃ মোট জনসংখ্যা-৬০৯০০০০০, মুসলমান-৪.২৯%, হিন্দু-০.০৩% বা ১৮২৭০ জ। (৪) নেপালঃ মোট জনসংখ্যা-২৯৩০০০০০, মুসলমান-৪.৪%, হিন্দু-৮১.৩% বা ২৩৮২০৯০০ জন। পাকিস্থানঃ মোট জিনসংখ্যা-১৯০৭০০০০০, মুসলমান-৯৮.৫%, হিন্দু- ১.৮৫% বা ৩৫২৭৯৫০ জন। বাংলাদেশঃ মোটজনসংখ্যা-১৬৪৭০০০০০, মুসলমান-৯০.৩৯%, হিন্দু-৮.৫৪% বা ১৪০৬৫৩৮০ জন।[তথ্যসুত্রঃ উইকিপিডিয়া, ভিন্ন ভিন সালের আদমসুমারী অনুযায়ী] উপরের দেওয়া তথ্য সুত্র দেখলে সহজেই অনুমান করা যাবে যে ভারতে সংখ্যা লঘু মুসলমানের উপর দুর্ব্যাবহার করলে প্রতিবেশী দেশগুলির সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর কি রকম অত্যাচার হতে পারে। সুতরাং স্বজাতিকে অত্যাচার থেকে বাঁচাতে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ নয়, ভাতৃভাব গড়ে তুলি।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৯
নামখানা-দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.