#অতৃপ্ত_আত্মা

এবার প্রধান সুশান্তবাবু বেশ ভালো করে বালিশে ঠেশ দিয়ে বসলেন। একেবারে জমিদারি স্টাইলে। তারপর সবাইকে উদ্যেশ্য করে বললেন- দেখুন এখন যে গল্প বলতে যাচ্ছি, সেটা নিছকই গল্প নয়। একটা সত্যি কাহিনী। এতদিন এই কাহিনী কেউ জানত না। আজ আপনারা প্রথম জানবেন। যতদিন বাবা বেঁচেছিলেন, ততদিন এই গল্প কাউকে বলিনি। বাবা আজ কয়েক বছর মারা গেছেন। এখন আর বলতে আপত্তি নেই। তাছাড়া এই গল্পের যিনি অপরাধী, তিনি যখন মারা গেছেন বহু বছর আগে তখন এই কাহিনী আপনারা জানলে কোন আসুবিধা নাই।
এবার সুশান্তবাবু একটু যেন দম নিলেন। কিংবা এখনও ভাবছেন গল্পটা বলা ঠিক হবে কিনা। কিংবা ভাবছেন কতটা বাদ সাদ দিয়ে বলা যায়। রমাপদবাবুর যেন মনে হলো যে সুশান্তবাবু কিছুতেই পুরো কাহিনী বলবেন না। যতটুকু না বললে নয়, ঠিক ততটুকুই বলবেন। যাইহোক শেষ পর্যন্ত সুশান্তবাবু গল্পটা বলতে শুরু করলেন।
সুশান্তবাবু বললেন-রহস্যময়ী রমনীর কথা বলতে গেলে আমার পরিবারের পূর্ব ইতিহাস আপনাদের শুনতে হবে। তা না হলে এই গল্পটা সম্পুর্ণ হৃয়ঙ্গম হবে না।আজ থেকে অনেক দিন আগেকার কথা। সময়টা ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দের পরবর্তী সময় হবে। নবাব মিরজাফর তখন বাঙলার নবাব। তিনি নবাব হওয়ার পর কলকাতা ও কলকাতা থেকে দক্ষিনে কুল্পী ও তার দক্ষিন পর্যন্ত- আকবরপুর/ আমীরপুর/ আজিমবাদ/ বালিয়া/ বাদির হাট/ বসনধারি/ কলিকাতা/ দক্ষিন সাগর/ গড়/ হাতিয়াগড়/ ইখতিয়ারপুর/ খাড়িজুড়ি/ খাসপুর/ মদনমল্ল/ মাগুরা/ মানপুর/ ময়দা/ মুড়াগাছা/ পাইকান/ পেচাকুলি/ সাতল/ শাহনগর/ শাহপুর/ উত্তর পরগনা ইত্যাদি মোট চব্বিশটি পরগনা লর্ড ক্লাইভকে উপহার বাবদ জমিদারি সত্ব দান করেন।এই চব্বিশ পরগনার দক্ষিনে চিল সিক্ত বিনাঞ্চল যা ম্যাংগ্রোভ অরণ্য আর বাদাবন যেটি সুন্দরবন নামে খ্যাত।পুর্বে একে অনেকেই ভাটিদেশও বলত। এই ভাটিদেশ বা সুন্দরবন ছিল বাঘ, কুমীর, সাপ আর অন্যান্য শ্বাপদ জন্তুতে পরিপুর্ন।
কর্ণওয়ালিশের সময় মহারাজা নন্দকুমারকে বর্ধমান,হুগলি আর নদীয়ার রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়া হয়। কোম্পানীর চাহিদা মেটাতে মহারাজা নন্দকুমার ছোট বড় সব জমিদারের উপর রাজস্ব আদায়ে বিশেষ চাপ সৃষ্টি করেন। অনেকে রাজস্ব না দিতে পারায় জমিদারি নিলামে উঠে। হুগলিতে আমাদের একটি ছোট্ট দুইশত বিঘার জমিদারি ছিল। কাঙখিত রাজস্ব দিতে না পারায় আমাদের জমিদারি নিলামে উঠে এবং তা হাতছাড়া হয়।এই অবস্থায় আমার পূর্ব পুরুষরা ভাগ্যান্বেশনে প্রথমে তমলুক ও পরে ডায়মন্ডহারবারে চলে আসেন। উদ্দেশ্য আবার কোন প্রকারে ছোট খাটো একটা জমিদারি গড়ে তোলা।
প্রায় আঠার’শ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ কোম্পানীর কাছ থেকে বারুইপুরের জমিদার রাজবল্লভ চৌধুরী চব্বিশ পরগনার জমিদারি ইজারা পান। কারণ লর্ড ক্লাইভ ততদিনে মারা যাওয়ায় চব্বিশ পরগনা কোম্পানীর দখলে যায় এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারা দেওয়া হয়। তখন চব্বিস পরগনার দক্ষিনের অংশ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। জমিদার রাজবল্লভ চৌধুরী তখন মেদিনীপুরের অনেক ব্যক্তিকে লাট কাটাইয়ের মাধ্যমে লাটদারি বা ছোট জমিদারীর স্বত্ব দিচ্ছিলেন। তখন আমার পূর্ব পুরুষরা রাজা রাজবল্লভ রায়চৌধুরীদের( ততদিনে জমিদার রাজবল্লভ “রাজা” এবং “রায়চৌধুরী” উপাধী পেয়েছেন ইংরেজদের নিকট থেকে) নিকট থেকে এই দেউড়ি দ্বীপের কয়েক হাজার বিঘার লাট কাটাই করে তাতে জমিদারি করার এবং নিয়মিতভাবে রাজবল্লভ রায়চৌধুরীকে খাজনা দেওয়ার শর্তে ভোগ দখল করার অনুমতি পেয়ে থাকেন।
অনেক কষ্টে লাট কাটাই করে আমার পূর্ব পুরুষরা জমিদারি শুরু করলেন। আস্তে আস্তে আমাদের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। এই সময় আমাদের পূর্ব পুরুষরা লাট কাটাইয়ের খরচ তোলার জন্য একটি জলদস্যু দল গড়ে তোলেন। এই দস্যু দলে ছিল সাতখানি ডিঙা এবং পয়ত্রিশ চল্লিশ জন মানুষ যারা ছিল বিশেষ অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী। এই জলদস্যুরা মুলত ইংরেজ, ফিরিঙ্গীদের লুন্ঠন করে অর্থ সংগ্রহ করতো। লুটপাটের অর্ধেক পেত আমার পুর্ব পুরুষরা। আর অর্ধেক পেত দস্যুরা। বিনিময়ে আমার পূর্ব পুরুষকে লুটের মাল বিক্রির দায়িত্ব নিতে হতো।
আমাদের বংশ তালিকা হল এইরকম।আমার পিতা হলেন স্বর্গীয় অসিতবরণ মাইতি। অসিতবরনের পিতা হলেন স্বর্গীয় অসীমবরণ মাইতি। অসিমবরণ মাইতির পিতা হলেন স্বর্গীয় অনাদিবরণ মাইতি। অনাদিবরণ মাইতির পিতা হলেন স্বর্গীয় অজাতশত্রু মাইতি।অজাতশত্রুর পিতা হলেন স্বর্গীয় অশান্তচরণ মাইতি। এই অজাতশত্রুর পুত্র অনাদিবরণ ছাড়া এক কন্যা ছিল। বংশ মর্যাদার স্বার্থে আমি তার নাম বলছি না। ধরে নিন তার নাম কুসুমকুমারী মাইতি। কুসুমকুমারী ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। শুধু তাই নয় কুসুমকুমারী ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতিও।
আমাদের জলদস্যু দলের মধ্যে সেই সময় দলের সর্দার ছিলেন দুধকুমার মুর্মু যিনি ছিলেন জাতিতে সাঁওতাল। সে ছিল দীর্ঘ সুঠামদেহী আর চিতাবাঘের মত ক্ষীপ্র। তিনি ছিলেন বলশালী এবং প্রত্যুতপন্নমতি সম্পন্য। তার প্রত্যেকটি কাজ ছিল নিখুঁত। একদিন সেই দুধকুমার কুসুমকুমারীকে নিয়ে ময়দার কালীমন্দিরে পূজো দিতে নিয়ে যান। কুসুমকুমারী যেমন দুধকুমারকে দেখে মুগ্ধ হন, তেমনি দুধকুমারও কুসুমকুমারীকে দেখে বড়ই মুগ্ধ হন। দুধকুমারের আমাদের পরিবারে আসার অধিকার ছিল এবং দস্যুদলের একমাত্র সেই আসতে পারত আমাদের বাড়িতে। আস্তে আস্তে দুধকুমারের সঙ্গে কুসুমকুমারীর প্রনয় গড়ে উঠে। অবশেষে দুধকুমার বললো কুসুমকুমারীকে- শুনছো, এ রকম করে আর কতদিন আমাদের ভাকোবাসা চলবে? এদিকে তোমার বাবা জানতে পারলে আমার কিন্তু ধড়ে মুন্ডু রাখবে না।
-তুমি একদম ভয় পেয়ো না। আমার বাবা আমাকে খুব ভালো বাসেন। আশাকরি তিনি আমার অনুরোধ ফেলতে পারবে না।
-তুমি তোমার বাবাকে চেন না। তিনি কিছুতেই একটি সাঁওতাল আর অধীনস্ত কর্মচারীকে জামাই বলে স্বীকার করবেন না।
-আমার বাবার সম্পর্কে তোমার ধারণা ভুল। আমি সেটা তোমাকে প্রমান করিয়ে দেব।
-না, কুসুম তুমি একাজ করো না। এতে আমাদের বিপদ হবে। তার চাইতে চলো আমরা একখানা ডিঙা নিয়ে পালিয়ে যাই। তাতে আমরা অন্য কোথাও গিয়ে সংসার করতে পারবো।
-পালিয়ে যাবে কোথায়?
-কেন? মুর্শিদাবাদ বা মুঙ্গের। সেখানে আমরা অনেক নিরাপদে থাকবো।
-তুমি বড় ভীতু। তুমি আমার বাবার কাছে গিয়ে আমাকে ভিক্ষে চাইতে পারবে না! তুমি নাকি দস্যু দলের সর্দার! এই তোমার সাহস!
-ঠিক আছে।কাল বুধবার।শুভ দিন। কাল আমি তোমার বাবার কাছে আসছি। তুমি তৈরী থেকো। তোমার জন্য যদি আমার প্রান যায় তাতে আমার কোন দুঃখ থাকবে না। অন্তত এ টুকু তো প্রমান হবে যে আমি ভিরু নই।
বুধবারদিন অজাতশত্রু দুপুরে বসে বসে জমিদারির হিসাব মেলাচ্ছিলেন। মাসের শেষে রাজার কাছে খাজনা পাঠাতে হবে। তাই বিশেষ মনযোগ ছিল। এমন সময় দুধকুমার এলো। দুধকুমারকে দেখে অজাতশত্রু বললেন- কি খবর কালু? দস্যুগিরিতে দুধকুমার ছিল সাক্ষাৎ কালন্তক যম।তাই অজাতশত্রু তাকে কালূ বলে ডাকে।
-আজ্ঞে কোন খবর নাই বাবু।
-তাহলে এই দুপুর বেলা এলি যে!
-আজ্ঞে আপনার কাছে আমার একটি আর্জি আছে?
-আর্জি? কি আর্জি কালু?
-আজ্ঞে আমি আপনার মেয়ে কুসুমকে বিয়ে করতে চাই। তাকে আমি ভালোবাসি এবং সেও আমাকে ভাকোবাসে।
- অজাতশত্রু কিছুক্ষন দুধকুমারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনুমানে মাপতে চাইলেন দুধকুমারের ষ্পর্ধা। এমন সময় কুসুমকুমারী বেরিয়ে এলেন অন্দর মহল থেকে। তিনিও বোধ হয় অনুমানে বুঝতে পেরেছিলেন বাবার অভিপ্রায়। কিন্তু প্রেমে অন্ধ কুসুমকুমারী বাবাকে বললেন-বাবা, আমি দুধকুমারকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়া হোক। আমি এতেই সুখে থাকবো।
অজাতশত্রু কিছুক্ষন মাথা নিচু করে রইলেন। তার পর কুসুমকুমারীর দিকে চেয়ে বললেন-মা কুসুম, তুমি যখন দুধকুমারকে বিয়ে করে সুখী হবে বলছো তখন আমার আর আপত্তি নাই। তবে দুধকুমারের সঙ্গে আমার একটি কথা আছে। সেটা আমি তার সঙ্গে একান্তে বলতে চাই। আগামী ফাল্গুন মাসে আমি তোমাদের বিয়ে দেব কথা দিচ্ছি।
কুসুমকুমারী খুবই বুদ্ধিমতি সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু দু’টি জায়গায় তিনি ছিলেন একেবারে নির্বোধ। প্রথমত তিনি তার বাবাকে অত্যন্ত ভালো বাসতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে তার বাবা তাকে ভালোবেসে তার কাঙখিত সকল আবদারও পূরণ করবেন। কিন্তু সংসারে বংশ মর্যাদা এবং আত্মগরিমা বলে যে একটি বিশেষ গুন রয়েছে এবং তার জন্য যে কোন কিছু সহজে করা যায় না, তা ঐ অষ্টাদশী কুসুমকুমারী বুঝতে পারেন নি। দ্বিতীয়ত তাদের জমিদারির সপ্তডিঙা সম্পর্কে এই ধারণা ছিল যে সপ্তডিঙা তাদের নৌ সেনা যার দ্বারা তার বাবা তাদের জমিদারিকে দস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করেন। সেই নৌ বাহিনীর সেনাপতি হলো দুধকুমার। তাহলে দুধকুমারকে বিয়ে করতে আপত্তি কোথায়? কিন্তু তার বাবা যে দস্যু বৃত্তির জন্য নৌসেনা গঠন করেছেন এবং তা যে বহির্জগতে মানুষের ত্রাস হয়ে উঠেছে তা কুসুমকুমারীর ধারণার বাইরে ছিল।
কুসুমকুমারী অন্তরালে যাবার পর অজাতশত্রু দুধকুমারকে বললেন-আমার খুব ভালো লাগছে যে অচিরেই তুমি আমার জামাতা হবে।তবে এর আগে তোমাকে যে একটা কাজ করতে হবে বাবা।
-কি কাজ বলুন? আমি সব কাজ করতে প্রস্তুত।
-কাজটা খুব ঝুঁকিপূর্ন। তবে করতে পারলে আমাদের আর দস্যুবৃত্তি করতে হবে না। তাছাড়া তুমি আমার জামাই হলে আর আমি দস্যুবৃত্তি করবো না। সপ্তডিঙা বন্ধ করে দেব। কিন্তু এই কাজটা কি করা যাবে?
- কাজটা কি আগে শুনি বাবু?
- আজ থেকে সাতদিন পর চন্দন নগর থেকে ফরাসীরা প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে দেশে যাবে। ওতে সারা বছরের খাজনার টাকা থাকবে।আমাদের দল যদি কুলপীর নিকট ফরাসি জাহাজ আক্রমন করা যায় এবং সমস্ত সম্পদ যদি লুট করা যায়, তাহলে বুঝতে পারছো আমাদের অর্থের পরিমান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! আর এই কাজ করার পর সপ্তডিঙা একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
-এই কাজ আমরা নিশ্চয়ই করতে পারবো বাবু।আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ফিরিঙ্গীদের সব সম্পদ আমাদের হবে। এই বলে দুধকুমার বেরিয়ে যায়।
বাস্তবে চন্দন নগর থেকে ফরাসীদের এরকম কোন জাহাজ যাওয়ার কথা ছিল না। অজাতশত্রু মিথ্যা কথা বলে তার সপ্তডিঙা সহ দুধকুমারকে গঙ্গার শাখা নদী দিয়ে কুল্পীতে নিয়ে যায়। এদিকে অজাতশত্রু বারুইপুরে জমিদারী খাজনা মিটিয়ে ডায়মন্ডহারবার ইংরেজ সেনা ঘাটিতে যান এবং সপ্তডিঙার বিবরণ ও অবস্থান জানিয়ে তাকে ধ্বংস করার জন্য ইন্ধন যোগান।ইংরেজরা সপ্তডিঙার সর্দার কালু সর্দারের উপর খুব ক্ষুব্ধ ছিল। তার সন্ধ্যান পাওয়ার তাকে ধ্বংস করার জন্য প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কুল্পীর দিকে অগ্রসর হয়।
প্রকৃত পক্ষে কালু সর্দারের দৌরাত্ব বেশ বেড়েছিল। সে ফরাসী এবং ইংরেজ কাউওকে ছাড়তো না। ক্রমে কালু সর্দার হয়ে উঠেছিল সুন্দরবনের বিভিষিকা। সেই কালু সর্দারের হদিস পেয়ে ইংরেজরা খুব খুশি হলেন এবং সঠিক সময়ে ও সঠিক জায়গায় কালু সর্দারের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই হল। লড়াইতে সপ্তডিঙা সহ কালু সর্দার প্রান হারালেন। দস্যুদলের প্রায় অনেকেই প্রান হারালেন। যারা বেঁচে দেউড়িতে ফিরেছিল, তাদেরকে অজাতশত্রু গুপ্ত হত্যা করে কালু সর্দার আর তার সপ্তডিঙা সমাপ্তিকে নিশ্চিত করেন।
এই ঘটনার পর কুসুমকুমারী জানতে পারেন যে কালু সর্দার আসলে দুধকুমার এবং সপ্তডিঙা কোন নৌবহর নয়। তার বাবার দস্যুবৃত্তির নৌবহর। কুসুমকুমারী এটাও বুঝতে পারেন যে দুধকুমারের সঙ্গে তার বিয়ে না দেওয়ার জন্য দুধকুমারকে তার বাবা ইচ্ছা করেই এমন ঝুঁকিপূর্ন কাজে পাঠিয়েছেন যাতে দুধকুমারের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। ফলে তার বাবার উপর কুসুমকুমারীর ক্ষোভ হয় এবং তিনি ঘৃনায় বাবার সঙ্গে আর কোন দিন বাক্যালাপ করেন নি। কিন্তু অজাতশত্রু ওসব নিয়ে ভাবলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি ঠিক করলেন যে বহড়ুর জমিদারের সঙ্গে কুসুমের বিয়ে দেবেন।আস্তে আস্তে বিয়ের দিন এগিয়ে এলো।
এই পর্যন্ত বলে সুশান্তবাবু থামলেন। একটু জিরিয়ে নিলেন।রমাপদবাবু সহ অন্যান্যরা রোমহর্ষক এই গল্প অধীর আগ্রহে শুনছিলেন। সবাই কুসুমকুমারীর অন্তিম ঘটনা শোনার জন্য গভীরভাবে অপেক্ষা করছেন। আবার সুশান্তবাবু বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন- কুসুমকুমারী মনে মনে দুধকুমারকে বিয়ে করেছিলেন। তাই বহড়ুর জমিদারকে কিছুতেই স্বামী হিসাবে মানতে পারলেন না। তাই তিনি বিয়ের তিনদিন আগে গভীর রাতে বিয়ের জন্য আনা লাল ঢাকাই মসলিন পরে ফাঁসির দড়িতে আত্মহত্যা করেন।
কুসুমকুমারীর মৃত্যুর পর তার শ্রাদ্ধ শান্তি করানো হয়। কিন্তু ব্রাম্ভন ঠাকুর বলেন যে কুসুমকুমারী প্রেতাত্মা হয়ে এ-ই গৃহেই আছে। যদি কোন যুবককে তার দুধকুমার বলে মনে হয় এবং সেই যুবক যদি কুসুমকুমারীর প্রেতাত্মাকে বিয়ে করতে রাজি হয়, তাহলে সেই অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি হবে। অজাতশত্রু এবং তার পুত্র অনাদিবরন মাইতি চেষ্টা করেছিলেন এই রকম কোন ছেলে পাওয়া যায় কি না যাতে কুসুমকুমারীর আত্মার মুক্তি ঘটানো যায়। তার পর আর কেউ ঐ নিয়ে ভাবতেন না। কালক্রমে সে কথা বংশ পরম্পরায় শুনে এসেছি এবং গল্প কথা হয়ে থেকে গেছে।শুধু তাই নয় আমাদের বাড়িতে কাউকে কোনদিন কুসুমকুমারীর আত্মা ভর করে নি। কিন্তু ঐ দিন রমাপদবাবুর উপর কেন যে ঐ অশরীরি আত্মা ভর করলো তা ভেবেই কুল পেলাম না।
আমাদের বাড়িটা তো প্রায় আড়াই’শ বছরের পুরানো। সময়ের সঙ্গে পুরানো বাড়িকে ঠিক রাখার জন্য মেরামত করতে হয়েছে। ফলে বাড়ির আদল আধুনিকের মতো হলেও নক্সার তো কোন পরিবর্তন হয় নি।যে ঘরটাতে রমাপদবাবুকে থাকতে দেওয়া হয়েছিল সেটি ছিল কুসুমকুমারীর ঘর। বর্তমানে ওটি এখন আমাদের গেষ্ট রুম হয়েছে।কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে এত বছর পর কুসুমকুমারীর অতৃপ্ত আত্মা তার প্রিয় দুধকুমারকে খুঁজে পেল রমাপদবাবুর মধ্যে।সুশান্তবাবু এবার হাসতে হাসতে বললেন- আমার পারিবারিক বর্ননা অনুযায়ী রমাপদবাবুর শরীরের সঙ্গে দুধকুমারের শরীরের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়।
তখন ফরেষ্ট অফিসার চ্যাটার্জীবাবু বললেন-তাহলে রমাপদবাবুর সঙ্গে এখন কুসুমকুমারীর বিয়ে দিয়ে তার আত্মার মুক্তি ঘটানো হোক। আর রমাপদবাবুকে আপনার পরিবারের আত্মীয় করে নেওয়া হোক।
-রমাপদবাবু বললেন-আমার কোন আপত্তি নাই। তবে জামাই হিসাবে আমি কত বিঘা জমি পাবো, সেটা আগে বলা হোক। রমাপদবাবুর কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলেন।
-সুশান্তবাবু বললেন- ওসব আত্মা ফাত্মা ছাড়ুন। আমার পরিবারে আর জমি বিলোবার মতো জমি নেই। সব জমি বামফ্রন্ট সরকার গ্রামের ওই ভাগ চাষীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। এখন যা আছে তাতে আমাদের নিজেদের চলে না। তাছাড়া আজ কালকার দিনে এসব নিয়ে ভাবলে লোকে পাগল ছাড়া আর কি বলবে বলুন!
তখন রমাপদবাবু বললেন- দুধকুমারের সঙ্গে কুসুমকুমারীর বিয়েটা হলে মন্দ হতো না। কিন্তু জমিদার অজাতশত্রুর এতটা কঠোর আর একগুঁয়ে না হলেই পারতেন।
তখন সুশান্তবাবু বললেন- দুধকুমার সাঁওতাল বলে যে তার সঙ্গে কুসুমকুমারীর বিয়ে দিলেন না এটা কিন্তু আসল কারন না।আসল কারন শুনলে আপনাদের চোখ কপালে উঠবে।
-তাহলে আসল কারণ কি? প্রায় সবাই সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন। তখন সুশান্তবাবু বললেন-আজ আর বলতে পারবো না। আবার যদি কোন দিন সময় হয়, মনে করিয়ে দেবেন। তখন দেখবো বলা যায় কি না। হাজার হোক এ তো আর গল্প নয়, আমার পারিবারিক কেচ্ছা কেলেংকারি। কার বা বলতে ভালো লাগবে বলুন। তবু আপনারা যখন শুনতে চাইছেন তখন বলবো এখন কোন একদিন। কথা দিলাম কোন একদিন সুসময় দেখে স্মরণ করিয়ে দেবেন। বলে দেব গল্পটা।
গল্প শুনতে শুনতে কখন যে রাত ন’টা হয়ে গেছে বোঝাই যায় নি। এবার সবাই রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শুধু বুনো মুরগীর মাংস আর রুটি। এই হলো শুক্রবারের রাতের খাওয়ার। এদিকে রমাপদবাবু ভাবছেন সুশান্তবাবুর কথা। এই ব্যক্তি জমিদার বাড়ির সন্তান।তার শিরায় শিরায় বইছে হিংস্র জমিদারদের পূর্ব পুরুষের রক্ত। অথচ এই লোক এতো শান্ত এবং সৎ ব্যক্তি হন কি করে? এই ব্যক্তির মধ্যে কুটিলতার বিন্দু মাত্র কি নিহিত নেই! সত্যি কি এই ব্যক্তি ধোয়া তুলসীপাতা! নাকি বাইরেরটা এরকম, আর ভিতরে জীবন্ত শয়তান! এবার রমাপদবাবু ঠিক করলেন যে এই ব্যক্তির সঙ্গে খুব সতর্কতার সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.