#জলদস্যুর_পিছু_ধাওয়া

রুটি মাংস খাওয়ার পর সবাই শোবার ব্যবস্থা করতে লাগলো। এমন সময় ফরেষ্ট অফিসের একজন এসে রমাপদবাবুদের ঘরের দেওয়ালের গোড়ায় মেঝেতে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে দিল যাতে কোন সাপ, কীটপতঙ্গ কিছুতেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে না পারে। এটা দেখে রমাপদবাবু অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন সাপের ভয় থেকে। এবার তিনি শুতে যাবেন এমন সময় আবার ফরেষ্ট অফিসার আমাদের ঘরে এলেন। তারপর প্রধান সাহেবকে বললেন- প্রধান সাহেব আমরা আবার আপনার নৌকাটি নিয়ে টহল দিতে যাবো। রাত তিনটের আগে পৌছে যাবো। এই সময় রমাপদবাবু ভাবলেন এই সময় যদি সাহেবের সঙ্গে টহলে যাওয়া যায় তাহলে রাতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখা যাবে এবং একটি আলাদা স্বাদও পাওয়া যাবে। যেই ভাবা অমনি তিনি ফরেষ্ট অফিসারকে তার মনের কথা জানালেন। ফরেষ্ট অফিসার রাজিও হয়ে গেলেন।
রমাপদবাবু ফরেষ্ট অফিসার ও অন্যান্যদের সঙ্গে নৌকায় এসে উঠলেন। রমাপদবাবুকে নিয়ে নৌকায় আছেন মোট সাত জন। রাতে সুন্দরবনকে যে এতটা সুন্দর লাগে তা তিনি ভাবতেই পারেন নি। সেদিনটা ছিল শুক্লা ষষ্ঠী। চাঁদ অনেক আগেই ডুবে গেছে। রাতের কালো আঁধার আলকাতরার মতো সারা চরাচরকে আবৃত করেছে। তারই মাঝে এখানে ওখানে প্রায় জোনাকির মতো লন্ঠনের আলো মিট মিট করে জ্বলছে। কৌতুহল না চেপে রমাপদবাবু ঐ আলোগুলি কিসের আলো জানতে চাওয়ায় ফরেষ্ট অফিসার জানালেন যে ওগুলি বেঁউদি জালের আলো। বেঁউদিজাল হলো একরকম থলে জাল যা স্রোতের মুখে বড় হাঁ করে বসানো আছে। ওর পেটে যে ঢুকবে তার নিস্তার নাই।আর ঐ খানে যে জাল বসানো আছে তা জানিয়ে দেওয়ার জন্য একটি লণ্ঠন জ্বালিয়ে সংকেত দেওয়া আছে।
খুব আস্তে আস্তে নৌকা চলেছে।মৃদু শব্দ তুলে নৌকা উত্তর দিকে ধাবমান। নৌকার পিছন দিকে যেন জ্বলন্ত আগুন বেরিয়ে যাচ্ছে। রমাপদবাবু বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ফরেষ্ট অফিসারকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন -সমুদ্রের লবনাক্ত জলে ফসফরাসের পরিমান অনেক বেশী। এই জল নাড়া দিলে জলের ফসফরাস বায়ুর সংষ্পর্শে এলে জ্বলে উঠে এবং তখন চক চক করে ঠিক জোনাকি পোকার মতো। রাতের সমুদ্র একেবারে মোহময় কিংবা ভয়ংকর বিভিষিকা। একটু মাঝের দিকে গেলে দিক হারিয়ে ফেললে বোধহয় ডাঙায় ফেরা বা নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থলে ফেরা সত্যিই কঠিন কাজ। তখন রমাপদবাবুর মনে হল যে সত্যি নাবিকদের কাজ কি সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের। সাধে কি সবাই কলম্বাস হতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমাদের শব্দ পেয়ে রাতের পাখীরা বিকট ভাবে চিৎকার করতে করতে উড়ে চলে যায়। রমাপদবাবু যখন বের হন, তখন জোয়ারের জলে একেবারে থই থই অবস্থা। জলের ঢেউয়ের তালে বেঁউদি জালের বাতিগুলো ক্রমাগত নেচেই চলেছে। রমাপদবাবু দেখলেন যে চ্যাটার্জীবাবু তার কলিগদের সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বলছেন। এমন সময় নৌকাখানি হঠাৎ বাঁক নিয়ে জঙ্গলের একটি নদীর ভিতর ঢুকে গেল। এবার নৌকাখানি ফুল স্পীডে ছুটতে লাগলো। মিনিট কয়েক পর দেখা গেল আর একটি নৌকা রমাপদবাবুর সামনে প্রবল বেগে ছূটে চলেছে। তাকে তাড়া করে চললো রমাপদবাবুর নৌকা। প্রায় আধা ঘন্টা পর রমাপদবাবুরা নৌকা তাড়া করে অপর পাশের সমুদ্রে পৌছে গেলন। কিন্তু কিছুতেই অপর নৌকাটিকে ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু চ্যাটার্জীবাবুও ছাড়ার পাত্র নন। এমাসে অনেক কেশ কম গেছে। উপর ওয়ালার চাপ আছে। তাই এই নৌকাটিকে ধরে বড় একখানা কেশ দিতে হবে।
নৌকাটির যখন বেশ কাছাকাছি প্রায় সাড়ে তিন’শ চার’শ ফুটের মধ্যে হয়েছে, এমন সময় ধাওয়া করা নৌকা থেকে গুলি ছুটতে লাগলো। চ্যাটার্জীবাবু বোধহয় এতটা আশা করেন নি। তিনি ভেবেছিলেন নৌকাটি সাধারণ জেলে নৌকা। কিন্তু নৌকা থেকে গুলি আসতেই বুঝতে পারলেন যে এটা সাধারণ নৌকা নয়। তিনি আর এগোলেন না।এগোলে বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই তিনি নৌকা নিয়ে ফিরলেন। তারপর এদিক ওদিক ঘোরা হল। কিন্তু আর কিছু পাওয়া গেল না। শুধু মাত্র একটি জেলের কাছ থেকে কিছু ভালো পারসে আর বড় বড় ট্যাংরা মাছ নিলেন।তারপর যখন অফিসে ফিরলেন তখন রমাপদবাবু দেখলেন রাত প্রায় সাড়ে তিনটে। অর্থাৎ সকাল হতে আর বেশী বাকী নেই। তবুও রমাপদবাবু বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন এবং বলা বাহুল্য যে কিছু ক্ষনের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন।
সকালে প্রধান সাহেবের ডাকে রমাপদবাবুর ঘুম ভাঙে। তিনি উঠে দেখলেন যে তখন সকাল আটটা। হাত মুখ ধুতেই টিফিন এলো রুটি এবং কাকড়ার ঝাল। সে তো টিফিন নয়, একেবারে উদর পুর্তি করে খাওয়া। প্রধান সাহেব জানালেন -আমাদের আর এখানে থাকা হবে না। কাল একটি নৌকা ধাওয়া করতে গুলি ছুঁড়েছিল ওরা। চ্যাটার্জীবাবুর অনুমান ওরা হয় জলদস্যু, নয় তো চোরা শিকারী। তাই লালবাজারে ফোর্স চেয়ে পাঠিয়েছেন। তারা সন্ধ্যের আগে পৌছে যাবেন। তাই আমাদের আর এখানে থাকা হবে না। চলুন আমরা ফিরে যাই। আমাদের আর বকখালি বা হেনরি আইল্যান্ডে যাওয়া হবে না। আজ থেকে এই এলাকা ফরেষ্ট অফিসের লঞ্চ এবং কোষ্ট গার্ডের ফোর্স লঞ্চ ভর্তি হয়ে যাবে। তল্লাশী চলবে অন্তত সাতদিন। আজই সব ট্রলারকে এবং কোন ফিসিং নৌকাকে আগামী সাতদিন এই এলাকায় আসতে দেওয়া হবে না। ফলে আমরা বকখালিতে আজ গেলে যেতে পারি। কিন্তু বাড়ি ফিরতে পারব না। তাই অনিচ্ছা সত্বেও বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।
রমাপদবাবুর খুব দুঃখ হচ্ছে। কাল রাতের বড় বড় পারসে আর ট্যাংরা মাছগুলো চ্যাটার্জীবাবুরা সাবাড় করে দেবে! আমাদের দু চারটা দেবেন না! এমন সময় চ্যাটার্জীবাবু এলেন। তিনি আমাদের বললেন- আমি আপনাদের প্ল্যান আর আনন্দ মাটি করলাম। কিন্তু কিছু করার নেই। মনে হচ্ছে কাল যাদের তাড়া করেছিলাম, তারা বাংলাদেশী জলদস্যু। অন্তত আমার অনুমান তাই।এতো বড় জঙ্গলের ভিতর ওদের কোন গোপন আস্তানা নেই তো! এই আসঙ্কায় ফোর্স চেয়েছি। আগে জঙ্গল তল্লাশি হবে দিনে। রাতে তল্লাশি করা হবে সমুদ্র।দেখা যাক কিছু ধরা পড়ে কিনা।এবার তিনি একটি টিনে পারসে মাছ, ট্যাংরা মাছ আর বেশ কিছু কাঁকড়া আমাদের দিলেন। বললেন-আজ অফিসে গিয়ে এই দিয়ে ফিষ্ট করুন। পরের বার এলে পুষিয়ে দেব।রমাপদবাবুর আর কোন দুঃখই রইল না।
বাড়ি ফেরার সময় বলতে গেলে ফরেষ্ট অফিসার প্রধান সাহেবদের নৌকা ঘাটে পৌছে দিলেন।তারপরে অফিসে পৌছে হই হুল্লোড় করে পিকনিকের মেজাজে সবাই মেতে উঠল।প্রধান সাহেব বললেন যে তিনি আজ সমস্ত তরকারি রান্না করবেন। এবং তিনি কোমর বেঁধে লেগেও গেলেন।সত্যি এই প্রধান সাহেব যেন তাঁর পূর্ব পুরুষদের থেকে আলাদা।
এবারে সবাই প্রধান সাহেবকে ধরে সুরা পানের ব্যবস্থা করলেন। কাঁকড়ার ভাজা দিয়ে হুইসকি যে না খেয়েছে তার জীবনই বৃথা।সুরার আড্ডায় প্রধান সাহেব সেক্রেটারীকে বললেন- সেক্রেটারীবাবু আপনার স্টাফেদের ইচ্ছানুযায়ী আমি আপনাকে একটি অনুরোধ করছি।আমার এই অনুরোধটি ন্যায় না হলে আপনি খারিজ করবেন।রমাপদবাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন- কি অনুরোধ প্রধান সাহেব?
-এই যে পিকনিকে খরচ হচ্ছে, বা আপনারা যে অফিসের মেসে থেকে খরচ করছেন, সেই টাকাগুলো অফিসের ফান্ড থেকে খরচ করা হোক, এটাই আপনার সব স্টাফেরা চাইছেন।
- রমাপদবাবু বললেন- এই সমুহ খরচ কিছুতেই অফিস ফান্ড থেকে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ জনগনের উন্নয়নের টাকা এভাবে নিজেদের স্বার্থে খরচ করা ঠিক হবে না।তাছাড়া এই সমস্ত খরচ কেন অফিসের টাকা থেকে খরচ হবে শুনি?আমরা কেউই কম বেতন পাই না।এখানকার জিনিষপত্র বেশ সস্তা।মাসে প্রত্যেকের দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ হবে। এই টাকা বেতন থেকে খরচ করতে অসুবিধা কোথায় আমি তো বুঝি না।
-এমন সময় নির্বাহী সহায়ক বললেন-আপনার মশাই টাকার অভাব নাই। নিজের বেতন, উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত অর্থ কোন কিছুর অভাব নেই। কিন্তু আমাদের বড় সংসার। প্রত্যেকের সংসারে অভাব আছে। তাই এই খরচ অফিস থেকে না করলে আমাদের যে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে। এমন সময় নির্মান সহায়ক বললেন- এইভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে তো কোন লাভ নেই। সেক্রেটারীবাবু না চাইলে নিজেদের পকেট থেকে খরচ করা উচিত। তবে আমি জানিয়ে রাখি যে আমি আগামী মাস থেকে এখানে একটি বাড়ি ভাড়া পেয়েছি। সেখানে উঠে যাবো।
-ও, তুমি তাহলে তোমার ব্যবস্থা করে নিয়েছো। তাহলে আমি আর এখানে থাকি কেন? আমি তাহলে বেয়াই বাড়িতে উঠবো। কিছুটা হলেও খরচ বাঁচবে।
-সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুই সহায়ক বললো-আমরা তাহলে এখানের রামকৃষ্ণ আশ্রমে চলে যাবো। ওরা হাজার টাকায় খাওয়া দাওয়া এবং থাকা ফি। শুধু সকালে উঠে প্রার্থনায় বসতে হবে। শুধু এই টুকু কষ্ট করলে ল্যাটা শেষ।
-রমাপদবাবু বুঝতে পারলেন যে তাকে একাকী অফিস মেসে ফেলে সবাই যে যার মতো পালিয়ে তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন। তখন একা অফিসে না থাকতে পেরে রমাপদবাবু যাতে স্টাফেদের আবদার মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু রমাপদবাবু অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি স্টাফেদের কথা মানলেন না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন -যে কেউ যেখানে খুশি যেতে পারেন। আমার কিছু বলার নেই।তবে আমি আমার আদর্শ থেকে কিছুতেই নড়ব না।
প্রধান সাহেব বুঝেছিলেন যে রমাপদবাবু স্টাফেদের এই প্রস্তাবে রাজি হবেন না। কারণ এত দিনে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তিনি রমাপদবাবুর বৈশিষ্ট্য বুঝে ফেলেছিলেন।ফলে তিনি চুপ করে রইলেন।দেউড়ী গ্রাম পঞ্চায়েত শহর থেকে অনেক দূরে বলে কোন স্টাফ এখানে থাকতে চায় না। তাদের অফিসে থাকতে দিয়ে অফিসের টাকায় চব্য চোষ্য করে খাওয়াতে হয়।স্টাফের খাওয়াতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যেত।এই প্রথম কোন সেক্রেটারী পঞ্চায়েতের এই খরচ বাঁচালেন।শেষ পর্যন্ত কি হয় দেখা যাক।
এই ঘটনার পর সেদিনের সুরা পান আর ভোজন সব কিছু রমাপদবাবুর স্টাফেদের কাছে বিস্বাদ লাগছিল।যেন কোন কিছুই তাদের গলা দিয়ে নামতেই চাইছিল না। একমাত্র রমাপদবাবু আর গ্রুপ ডি কর্মচারী জয়ন্ত গায়েন এই দু’জনেই তৃপ্তি সহ খেয়েছিলেন।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.