#এটা_ভাববেন_না_যে_শিশুর_সেন্টিমেন্ট_নেই।

প্রতিদিন অফিস ফেরার সময় আমি কোন না কোন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ি। যে ঘটনাগুলো আমার কোমল মনের কোমল পাথরে দাগ রেখে যায়। এক একটা দাগ এমন হয় যে অনেক দিন ধরে তার রেশ বয়ে বেড়াতে হয়। একবার একটি চার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে আমার কোলে উঠে আমার গালে দু’তিনটে কিস করেছিল। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। অবাক হয়েছিলাম এই জন্য যে আমার মতো একজন কিম্ভুতকিমাকার ব্যক্তির গালে এক দেব শিশু চুমু খাবে! এ যে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু পরে মেয়েটির মা আমাকে জানিয়েছিল যে আমি নাকি ওর বাবার মতো দেখতে যে মাস ছয়েক আগে বাইক অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আমাকে বাবা মনে করে আমার কোলে উঠে আদর করে দু’ তিনটে কিস করে দিয়েছিল।আজ থেকে বছর বার আগের ঘটনা এখনও স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে।কিন্তু সেই ঘটনা ছিল মধুর,এক সোনালী স্বপ্নের মতো বা সাহিত্যের ভাষায় বলতে গেলে রূপকথার মতো।কিন্তু আজ যে ঘটনা হলো তা অত্যন্ত বেদনা দায়ক।এই ঘটনাও আমি আমৃত্যু মনে রাখব।
আজ বিকালে ঠিক পাঁচটার সময় আমার কলিগ ভাতৃপ্রতিম সুব্রত’র বাইকে চড়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।দু’জনে অনেক গল্প করতে করতে আসছিলাম। আমার এমনিতে শরীর খারাপ। কিডনীর সমস্যায় ভুগছি। রিসেন্টলি কিডনী অপারেশন করিয়েছি। আমার অফিস যেখানে সেখানে যাওয়া সহজ। কিন্তু ফিরতে খুব কষ্ট হয়।তাই কয়েকদিন দেখছি সুব্রত বাইকে বাড়ি ফেরার সময় আমাকে লিফট দেওয়ার চেষ্টা করে। আমি খুব অসুস্থ এবং এই অবস্থায় ফিরতে কষ্ট হবে ভেবেই হয়তো আমাকে ও লিফটের অফার দেয় এবং আমি সেই অফার ডিজার্ভ করি।যেমন আজ করলাম। ও আমাকে ১১৭ নং জাতীয় সড়কের পাঁচ নম্বর হাটে নামিয়ে দেয়।
আমি ওখানে মিনিট দশেক অপেক্ষা করি।তারপর নামখানা বকখালি বাস আসে এবং ওখানে প্রায় জনা পঞ্চাশেক যাত্রী নেমে যাওয়ায় বাস একেবারে খালি হয়ে যায়। আমি মহানন্দে গেটের একেবারে সামনে থ্রি সিটের জানালার ধারে বসি। আমার সামনে বসে আছে এক মহিলা যাত্রী। কোলে একটি পাঁচ ছয় বছরের ছেলে। ছেলেটি জানালার ধারে বসেছে। জানালা খোলা।গাড়ি প্রায় তিন চার কিলোমিটার আসার পর ছেলেটি হক হক করে ভোমিটিং করে দিল। আর যেহেতু গাড়ি রানিং ছিল,সমস্ত উদ্গিরণ পদার্থগুলো জানালা দিয়ে উড়ে এসে আমাকে নাইয়ে দিল।রক্ত তখন আমার মাথায় উঠে গেছে। আমি ক্রধোম্মত্ত হয়ে বিষ্ফারিত নেত্রে ছেলেটিকে বকুনি দিলাম।
আমার বকুনি শোনার পর ছেলেটি চুপ করে গেল। কিন্তু ছেলেটি যে ভিতরে ভিতরে ডিপ্রেশানে ভুগছিল, আমি কিছুতেই বুঝতে পারি নি। হঠাৎ ছেলেটি চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পালাতে যায়। কোন এক ঐশ্বরিক ক্ষমতায় আমি তার মোটিভ বুঝে ফেলি এবং তাকে বাস থেকে নেমে পালিয়ে যেতে বাধা প্রদানে অগ্রসর হই। কিন্তু বয়সের করাল গ্রাসে আমি জর্জরিত। শরীরের ক্ষিপ্রতা যৌবনের মতো নেই। তাই ছেলেটিকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে আমি আমার সর্ব শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। হঠাৎ উঠে বের হতে গিয়ে সিটে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। পেটের যেখানে অপারেশন হয়েছিল, সেখানে লাগলো। কিন্তু সেদিকে আমার কোন হুঁশ নেই। আমি ছেলেটির হাত ধরতে গেলাম। কিন্তু আমার হাত তার নাগাল পেল না।আমি পড়ে গিয়ে ছেলেটির পা ধরলাম। ছেলেটির পা আমার হাতে আর ওর মাথা গাড়ির চেকারের হাতে। সে এক বিচ্ছিরি কান্ড। ছেলেটি বেঁচে গেল। কিন্তু সমস্যা মিটে গেলে নিজের দিকে খেয়াল হলো এবং তখনই পেটের যন্ত্রনা অনুভুত হলো। আস্তে আস্তে যন্ত্রনা বেড়ে গেল এবং সেদিন সারারাত যন্ত্রনায় কাতরাতে লাগলাম। দু’দিন অফিস বন্ধ করে রেষ্ট নিতে এবং ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেতেই আমি সুস্থ হলাম।
সুস্থ হওয়ার পর এই ঘটনার ময়না তদন্ত করলাম। তদন্তে প্রমানীত হলো যে এই ঘটনার জন্য সম্পুর্নভাবে দায়ী আমি নিজে। কারণ ছেলেটি খুব ছোট। কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়, সেই রকম বোধ বুদ্ধির এখন বিকাশ হয় নি। তাই তাকে বকুনি দেওয়া আমার একেবারে অপরাধ জনক কাজ হয়েছে। তাছাড়া আমার বোঝা উচিত ছিল যে ছেলেটি ছোট্ট হলেও তার সেন্টিমেন্ট একেবারে ভরপুর।কারণ এখনকার প্রজন্ম অনেকটা এগিয়ে।সে গাড়ির অন্যান্য লোকের সম্মুখে বকুনি শুনবে কেন? তাই আত্মহত্যাই শ্রেয়।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
১১ই মার্চ,২০২০
নামখানা।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.