#রাতে_অফিসে_একা

লথিয়ান দ্বীপ ঘুরে শনিবার ফেরার পর দুপুরে অফিসে খাওয়া হলো এবং খাওয়ার খরচ নিয়ে রমাপদবাবুর সঙ্গে অন্যান্য স্টাফেদের ঝগড়া হওয়ার পর এক নিমেষে যেন পরষ্পরের মধ্যে থেকে সম্প্রীতির সূতোটা ছিঁড়ে গেল। অফিসটা যেন একেবারে হাওয়া বাতাসহীন গুমোট পরিবেশ হয়ে গেল।কিন্তু এতে রমাপদবাবুর কিছু আসে যায় না। রমাপদবাবু দিব্যি খাওয়ার পর টানা ঘুম দিলেন।
রমাপদবাবুর ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যে ছ’টার দিকে। ঘুম থেকে উঠে দেখলেন কেউ কোথাও নেই। তিনি তাড়াতাড়ি প্যান্ট জামা পরে অফিসের বাইরে এলেন এবং পরে অফিসে তালা দিয়ে অফিসের একটু দূরে চায়ের দোকানে গেলেন। চায়ের অর্ডার দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন-আচ্ছা আমাদের অফিসের লোকেদের দেখেছেন?
-হ্যা দেখলাম তো। উনারা আমার দোকানে চা খেয়ে চারটের দিকে বের হয়েছেন। অফিসে নাকি থাকা নিয়ে গন্ডগোল হচ্ছে। তাই সবাই ঘর খুঁজে গেছে। আবার কেউ রামকৃষ্ণ আশ্রমে গেছে। আপনি কোথায় যাবেন দাদা? চা দোকানী রমেশ শিকারী জিজ্ঞাসা করে।
-আমি এই অফিসে থাকবো ভাই।
-সে কি! এত বড় অফিসে একা থাকা যায় নাকি?
-হয় তো যায় না। কিন্তু উপায় কি? সকলের এখানে কোন না কোন আত্মীয় আছে। কিন্তু আমার তো এখানে কেউ নেই। তাই না চাইলেও আমাকে এখানে থাকতে হবে।
-থাকবেন, সে না হয় বুঝলাম। খাবেন কোথায়?
- কেন নিজের জন্য যা হোক কিছু রান্না করে নিলেই হলো।
- রাঁধতে জানেন? ভাতের ফেন গালতে পারেন?
- শিখে নিতে হবে।জন্মের পর সবাই এসব শেখে এবং তাও একটা নির্দিষ্ট বয়সে।কেউ মায়ের পেট থেকে শিখে আসে না।
- তা অবশ্য আপনি ঠিক বলেছেন। দেখুন সাবধানে থাকবেন।
চা খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। এমন সময় দেখা গেল নির্বাহী সহায়ক মৃত্যুঞ্জয় সরকার দ্রুত পায়ে অফিসের দিকে হেঁটে আসছেন। রমাপদবাবুকে দেখে তিনি থমকে গেলেন। তারপর রমাপদবাবুর উদ্দেশ্য বললেন-এই যে সেক্রেটারীবাবু, ঘুম ভেঙেছে তা হলে। আমরা অনেকক্ষন আপনাকে ডেকেছিলাম। কিন্তু আপনার সাড়া পাই নি। তাই আপবাকে রেখেই আমি বাড়ি খুঁজতে গেছিলাম।
-বেশ করেছেন গেছেন।কিন্তু আপনি যে বললেন আপনি নাকি আপনার বেয়াই বাড়িতে থাকবেন!তাহলে আবার বাড়ি খোঁজার কি আছে?
-আজ্ঞে অনেক ভেবে দেখলাম আমার বোধ হয় বেয়াই বাড়িতে থাকা ঠিক হবে না। তাই অন্য ঘর দেখতে গিয়েছিলাম। পেয়েও গেছি। প্রায় সুলভ মুল্যে বলতে পারেন।
ইতিমধ্যে রমাপদবাবুর চা খাওয়া শেষ হতেই মৃত্যুঞ্জয়বাবুর সঙ্গে অফিসে এসে ঢুকলেন।রমাপদবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কিছুতেই মাথা নিচু করবেন না।যা হয় হোক। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
রবিবারদিন বিকেলে দেখা গেল দুই সহায়ক, নির্মান সহায়ক এবং নির্বাহী সহায়ক নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। অফিসে পড়ে রইলেন একা রমাপদবাবু।রমাপদবাবু বড্ড বিপদে পড়লেন।তিনি বুঝতে পারলেন যে তাকে শায়েস্তা করার জন্য তার কলিগরা এমন ভাবে বাঁশ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু তাতেও বিচলিত হলেন না।দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।
বিকালে রমাপদবাবুর পক্ষে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়ে একাই অফিসে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু রাতে খাবেন কি? রাতে না হয় মুড়ি বাতাসা খেয়ে থেকে যাওয়া যাবে। কিন্তু তার পরের দিন দুপুরে কোথায় খাবেন।যতই মিখে বড়াই করুক না কেন রমাপদবাবুর নিজের পক্ষে রান্না করা সম্ভব নয়।কিন্তু পরক্ষনেই রমাপদবাবু শক্ত হয়ে গেলেন। কিছুতেই হার মানা যাবে না। আগে মুড়ি বাতাসা খেয়ে রাত টুকু কাটানো যাক। তার পরে ভাবা যাবে।
সন্ধ্যে ছ’টার দিকে রমাপদবাবু চায়ের দোকানে চা খেতে গেলেন।কথায় কথায় চা দোকানি বললেন-আপনি তাহলে একাই অফিসে থেকে যাচ্ছেন!
-কি আর করা যাবে বলো। আমার যে যাওয়ার জায়গা নেই।
-আজ রাতে কি খাবেন?
-তুমি আমাকে শ’দুয়েক মুড়ি আর শ’খানিক বাতাসা দাও। ঐ খেয়ে রাতটা কাটিয়ে দেই। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে।
-আমি একটি কথা বলবো দাদা?
-কি কথা?
-বলছি কি আপনি আমাদের বাড়িতে আজ রাতে খাবেন কি?
-অসুবিধা কোথায়! কিন্তু টাকা নিতে হবে।
-সে কি হয় দাদা!আপনি বিপদে পড়েছেন।আপনার কাছ থেকে টাকা নিলে সেটা অমানবিক হবে।
-আমি যতদিন থাকবো আমাকে কি বিনি পয়সায় খাওয়াবে?
-মানে?
-মানে খুব সহজ। তুমি এক কাজ কর, যতদিন আমি এখানে চাকরি করবো তুমি আমার খাওয়ার দায়িত্ব নাও। তোমরা যা খাবে আমিও তাই খাবো। তোমরা রুটি,ভাত,পান্তা,পোষ্টি ভাত যা খাবে আমিও তাই খাবো।আমার জন্য স্পেশাল কিছু করতে হবে না। এখন রাজি কিনা বল।
-চা দোকানি কিছুক্ষন চুপ করে রইল। তার পর বললো- আচ্ছা দাদা, বাড়িতে কথা বলে জানাব।
-ঠিক আছে। এই বলে রমাপদবাবু দোকান থেকে উঠে এলেন।
রাত ন’টার সময় চা দোকানি রমেশ শিকারি রাতের খাবার খেতে ডাকতে এলো। রমেশের বাড়ি থেকে বোয়াল মাছের ঝাল দিয়ে বেশ তৃপ্তিসহ খেয়ে অফিসে ফিরে এলেন রমাপদবাবু।এবার ভালো করে বিছানা পেতে শোয়ার প্রস্তুতি নিলেন।-সে কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কখনো ঘুমান নি রমাপদবাবু। তাই তিনি ল্যাপটপ খুলে বসলেন। তিনি অফিসের কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে চান। হঠাৎ রমাপদবাবুর মনে হল যেন কেউ রুমের পাশের বারান্দায় হাঁটা চলা করছে। তিনি পরীক্ষা করার জন্য বাইরে এসে দেখলেন। না, কাউকে তিনি দেখতে পেলেন না।
ঘরে এসে রমাপদবাবুর প্রথম দিনের কথা আবার মনে দানা বাঁধতে লাগল। আজ অফিসে একা পেয়ে ঐ ভূত না পেত্নী তাকে তাড়া করবে না তো! রমাপদবাবু এ কথা চিন্তা করতেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এবার রমাপদবাবু বিছানা ছেড়ে উঠলেন। তিনি রুমের দরজায় চাবি দিয়ে সেই চাবি বিছানার তলায় ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর ঘরের দু’টো সোলার লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। তারপর খুঁজে খুঁজে একখানা ভালো শক্ত দড়ি বের করলেন। সেই দড়ির এক প্রান্ত খাটের পায়ে শক্ত করে বাঁধলেন এবং অপর প্রান্ত নিজের ডান পায়ে এমন শক্ত করে বাঁধলেন যে পায়ে যেন একদম না লাগে। এইবার বিছানার উপর কয়েকটা বই নিয়ে বালিসে হেলান দিয়ে শুলেন। উদ্দেশ্য যতটা সম্ভব রাতটা জেগে কাটিয়ে দেওয়া।
বই পড়তে পড়তে রমাপদবাবু রাত দু’টো পর্যন্ত কাটিয়ে দিলেন। তার পর আস্তে আস্তে তার ঝিমুনি আসতে লাগলো। রমাপদবাবু অনেক কষ্টে ঘুম সামলে সামলে চললেন। কিন্তু এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। আস্তে আস্তে একটি সুগন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করতে লাগলো। সেই গন্ধে রমাপদবাবু বিহ্বল হয়ে পড়লেন। তার পর আবির্ভূত হলেন সেই মোহময়ী রমনী। সেই লাস্যময়ী হাসি। সেই মন মাতানো নূপূরের ধ্বনি। সেই খিলখিলিয়ে হাঁসি।আস্তে আস্তে হাসি হাসি মুখ নিয়ে রমনী এসে বসলেন রমাপদবাবুর বিছানায়।আস্তে আস্তে রমাপদবাবুর পাশে এসে বসলো রমনী। তার পর মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে রমাপদবাবুর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। ধীরে ধীরে অজগর সাপের মতো রমাপদবাবুকে কুসুমকুমারী গ্রাস করতে লাগলেন। উলঙ্গ কুসুমকুমারী রমাপদবাবুর বুকের উপর যেন খেলা করতে লাগলেন। রমাপদবাবু এক ভীষণ ভালো লাগার আনন্দে অভিভূত হলেন। তিনি আর থাকতে পারলেন না।তিনিও আস্তে আস্তে কুসুমকুমারীকে আদর করতে লাগলেন। সেই আদরে কুসুমকুমারী একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। এবার রমাপদবাবু উত্তেজনায় উঠে কুসুমকুমারীকে বিশেষভাবে আদর করতে চাইলেন। আর তখনই ঘটল সেই ঘটনা। রমাপদবাবু উঠতে যেতেই তার পায়ে বাঁধা দড়িতে পড়লো প্রবল হ্যাঁচকা টান। সেই টানে তার পা খানি যন্ত্রনায় টন্ টন্ করে উঠলো। আর তখনই তিনি বাস্তব জগতে ফিরলেন। তিনি দেখলেন খাটের উপর তিনি একেবারে উলঙ্গ হয়ে বসে আছেন। এক অসম্ভব ভালোলাগা তাকে এতক্ষন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। আর এখন তিনি দেখছেন ঘরের মধ্যে এক মাতাল হাওয়া খেলা করছে। এবার তিনি ভয় পেতে শুরু করেছেন। এক সময় মাতাল হাওয়া একটি জানালার পাল্লা খুলে বেরিয়ে গেল। রমাপদবাবুর শরীর দিয়ে ঘামের স্রোত বইতে লাগলো।তার হৃদপিন্ডটা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
কিছুক্ষন পর রমাপদবাবু কিছুটা ধাতস্থ হলেন। তিনি আস্তে আস্তে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন।তিনি দেখলেন যে তার বিছানা একেবারে লন্ড ভন্ড হয়ে গেছে। বইগুলি মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ঘড়িতে দেখলেন যে তখন পৌনে চারটে বাজে। অর্থাৎ সকাল হতে বেশি দেরি নেই। তিনি পায়ের দড়ি খুললেন।বিছানা ঠিক করলেন।সাড়ে চারটার দিকে ভোরের আলো ফুটতেই রমাপদবাবু অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন।
ব্রাশ করে চোখে মুখে জল দিয়ে রমাপদবাবু কিছুটা ফ্রেশ হলেন। এবার অফিসের ছাদে উঠে ভোরের ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে পায়চারি করতে লাগলেন। এবার রমাপদবাবু ভাবলেন যে সত্যিই কি তিনি পূর্ব জন্মে জলদস্যু দুধকুমার ছিলেন। এবার রমাপদবাবু নিজেকে বকুনি লাগালেন। দূর কি সব ভুল ভাল সে ভাবছে! আবার ভাবছেন যে ভুল ভাল কেন হবে? দুই বারই একই মেয়ের স্বপ্ন সে কেনই দেখবে? প্রত্যেকবারই মেয়েটি তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চায়! কিছু একটা ব্যাপার তো আছে। এখন ভূতের ভয়ে কি চাকরি ছেড়ে পালাবেন? সে মরে গেলেও রমাপদবাবুর পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? রমাপদবাবু মনে মনে কিছু একটা ভাবলেন।
পায়চারি করতে করতে আর রাতের স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে এবং কখন যে রমেশ শিকারী তার দোকানের আঁচে চা বসিয়েছেন তা খেয়াল করেন নি। খেয়াল হল তখন যখন রমেশ চা খাওয়ার জন্য রমাপদবাবুকে ডাকলেন।রমাপদবাবু সকালের গরম চা খেতে তার শরীর থেকে ক্লান্তি ভাব চলে গিয়ে একেবারে তরজাতা হয়ে গেলেন। এমন সময় অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে রমেশ বললেন- দাদা, শুনছেন?
-বলুন। শুনছি।
-আপনার খাওয়ার দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না।
-কেন?
-আজ্ঞে তাতে আমার বেশ লোকসান হয়ে যাবে।
- কেন আমি তো টাকা দেব!
-দাদা আপনি টাকা দেবেন জানি। কিন্তু তাতেও আমাদের লস হবে।
-কি রকম একটু বুঝিয়ে বলবে?
-আজ্ঞে আপনি যখন খাবেন তখন আমরা বাড়ির যা হোক কিছু জোগাড় করে রান্না করলে হবে না। আপনার জন্য মানবিকতার খাতিরে কিছু ভালো আনাজ পাতি, ইত্যাদি ভালো দেখেই কিনতে হবে। আমরা বাড়িতে যা হোক কিছু রান্না করে খেলে হয়ে যাবে। কিন্তু আপনি থাকলে সেটা সম্ভব হবে না। ফলে সকলের খাবারের গুনমান অনেক বৃদ্ধি করতে হবে। তাতে আমাদের অনেকটা খরচ বেড়ে যাবে। আমাদের তো দাদা রোজগার পাতি খুব একটা ভালো নয়। তাই কি করি বলুন। আপনি বরং গ্রামে একটি ঘর খুঁজে উঠে যান। সেটাই ভালো হবে।আর যতদিন না পাচ্ছেন, ততদিন আমরা না হয় খাওয়াব।
রমেশের কথা খুব একটা খারাপ লাগে নি। তাই রমাপদবাবু কিছু বললেন না। শুধু বললেন- আচ্ছা দেখি কোথাও বাড়ি পাই কি না। রমেশের দোকানে একেবারে চা টিফিন খেয়ে অফিসে ফিরলেন। এবার শুধু তিনি প্রধানের আসার অপেক্ষায় রইলেন।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.