#করোনা_ভাইরাস


আমি একজন গৃহ শিক্ষক। জনা পনের ছাত্র ঠেঙিয়ে মাসে যা আসে,তাতে আমার মতো ব্যাচেলার মানুষের দিব্যি চলে যায়। এক দিদি ছাড়া এই জন্মে আমার আর কেউ নেই। দিদি অনেকবার আমার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি ওই ঝামেলায় যেতে চাই নি। তার চেয়ে এই একা মানুষ ঝাড়া হাত পা হয়ে বেশ ভালো আছি।
বাবা আমার নাম দিয়েছেন ভীস্মদেব চট্টোপাধ্যায়।কান্য কুব্জের বামুন আমরা। তাই উপবীত ধারণ করার পর ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী জপের কাজও প্রতিদিন নিয়ম মেনে করি। কিন্তু সংসার ধর্ম ছেড়ে একেবারে মহাভারতের পিতামহ ভীস্ম হয়ে যাবো এ কথা আমার অতি প্রিয় জনেরাও বুঝতে পারেন নি। এই পঞ্চাশ বছর বয়সে অকৃতদার হয়ে আমি বেশ বহাল তবিয়তে আছি মশাই।
যাক ধান ভাঙতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই। এখন সরাসরি আমার বক্তব্যে আশা যাক। চীন দেশে এক দুরারোগ্য ভাইরাস জনিত ব্যধির উপদ্রব হয়েছে। ভাইরাসের নাম কেউ বলছে ‘নোবেল করোনা ভাইরাস’। আবার কেউ বলছে ‘কোভিড-১৯'। এই ভাইরাস জনিত রোগের কোন প্রতিষেধক এখনো আবিস্কার হয় নি। এর মারণ ক্ষমতা কম হলেও শিশু আর বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত বিপদ জনক। আবার এই রোগে আক্রান্তরা যদি সুগার, হাইপারটেনশান বা ফুসফুস জনিত কোন ক্রনিক রোগ থাকে, তাহলে তো তাকে রীতিমতো যমের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। চীন, ইতালী, ষ্পেন এবং ইংলন্ড কাঁপিয়ে সেই ভাইরাস সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়েছে আমাদের ভারতে। তাহলে আমরা বাঁচবো কিভাবে?
দেশের প্রধান মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী সবাই বসলেন বৈঠকে। দীর্ঘ আলোচনার পর সবাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে করোনা ভাইরাস খুব ছোঁয়াচে। কিন্তু বায়ু দ্বারা পরিবাহিত হয় না। কেবল মাত্র এক মানুষ অপর মানুষকে পরিবাহিত করতে পারে। তাই যে সমস্ত দেশে করোনা ভাইরাসের দৌরাত্ম বেড়েছে সেখান থেকে সেই ভাইরাস মানুষ বয়ে নিয়ে আসবে বা এসেছে। সুতরাং সেই মানুষগুলোকে এবং নিজেদেরকে যদি চৌদ্দ দিন ঘরবন্দী করে রাখা যায় তাহলে এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে বিদেশ থেকে যাতায়াত চৌদ্দদিন বন্ধ করে রাখতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী মশাই সারা দেশে বোকাবাস্কের মাধ্যমে ঘোষণা করে দিলেন যে দেশ আগামী ২৫শে মার্চ থেকে চৌদ্দ দিনের জন্য লক ডাউন হয়ে গেল। এই লকডাউনের সময় কেউ বাড়ির বাইরে বেরোবেন না। বেরোলেই পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। মাছ, আনাজপাতি,মুদিবাজার সবই পাওয়া যাবে। তবে ভীড় করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখলাম সবাই বেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে কাজে। এই প্রথম দেখলাম ভারতের নাগরিককে এক সাথে মিলিত হয়ে দৃঢ সংগ্রামে লিপ্ত হতে। আমি বেশ আনন্দ পেলাম
আমি কাকদ্বীপে থাকি। ছোট্ট শহর। সকালে চা খাওয়ার অভ্যাস মতো বাড়ির পাশে সুরেশ কাকুর দোকানে পৌছলাম। আমাকে এক কাপ চা আর একখানা বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে বললেন- চা নিয়ে বাড়ি পালাও। নইলে পুলিশ তাড়া করবে।
-কেন! আমি আতঙ্কে জিজ্ঞাসা করলাম।
-আরে বাবা, দেশ এখন চাবি তালায় বন্দী যে। ঘরের বাইরে বের হওয়া বা চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া যাবে না যে। সুরেশকাকু মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন।
আমার লকডাউনের কথা মনে পড়ে গেল। আমি আর দেরী করলাম না। শুধু একখানা রুটি নিলাম। আমি প্রতিদিন চা খেতে গেলে এক পাগল রোজ আমার কাছ থেকে একখানা রুটি সকালে আর বিকালে একখানা চপ দিয়ে পঞ্চাশ মুড়ি পায়। আজও সে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রুটিখানা তাকে দেওয়ার জন্য তাকে ডেকেছি, এমন সময় ষন্ডামার্কা এক পুলিশ অফিসার আমার কাছে এসে বললেন- শালা, নিজেও মরবি আর দেশটাকেও মারবি। তারপর গলা চড়িয়ে বাজখাই গলায় বললেন- শালা এখানে কি মৌজ করতে আসা হয়েছে? এটা কি বাপের জমিদারী?

ততক্ষনে আমি চা খেয়ে ভাঁড় ফেলে দিয়েছি। হাতে শুধু একখানা রুটি। আমারও মেজাজ গেল বিগড়ে। আমিও শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে বললাম- ভদ্রভাবে কথা বলুন স্যার। আপনার হাতে ক্ষমতা আছে বলে আপনি এরকম কথা বলতে পারেন না। দেশ লকডাউন হয়েছে জানি। খুব ভালো উদ্দোগ। কিন্তু এই পাগলগুলো কি খেয়ে বাঁচবে! ভিক্ষুকদেরও কিভাবে দিন অতিবাহিত হবে! গরীব মানুষ যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কথা ভেবেছেন কোন দিন? সরকারও কি এদের নিয়ে ভেবেচে? জানি কোটি কোটি সোনা হিরের মাঝে নুড়ি আর কাদার কোন মূল্য নেই। সামান্য ইট পাথরকেই ভাবতে হবে কাদার কথা। তাই সকালে একজন কাদার বরাদ্দ রুটি খানা তাকে দিতে এসেছি। এটাকে আপনি যদি মৌজ বলেন, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। এই বলে আমি রুটিখানা সামনে দাঁড়ানো পাগলটাকে দিলাম।
ইতি মধ্যে কয়েকজন পথচারী নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার কথা শুনছিল। দারোগা সাহেব তাদের সামনেই আমার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন। তারপর আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললেন- বাঃ দারুণ ভেবেছেন আপনি। আমি বিষয়টি উর্ধতন কতৃপক্ষের নজরে আনবো। এরপর দারোগা সাহেব তার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমিও গুটি গুটি পায়ে বাড়ির দিকে এগোলাম।
সরকার কখনো সবদিক বাঁচিয়ে আইন লাগু করতে পারেন না। কোন কালে কোন প্রশাসকের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সর্বোত্তম লাভ দেখে আইন বানিয়ে লাগু করতে হয়। বাকি যতটুকু অসম্পুর্নতা থাকবে সেটা দেশের দায়িত্ববান নাগরিককে এগিয়ে এসে সম্পুর্ন করতে হবে। তাই লকডাউনের অসম্পুর্নতা দায়িত্ববান দেশের নাগরিককে বহন করাই উচিত।
কপিরাইট@কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
নামখানা
২৬শে মার্চ,২০২০।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.