#জীবনের_শুরু_কালনাগিনীর_দ্বীপে

পাথর ব্লকে দূর্বাচটি গ্রামে আমার দিদির বাড়ি। আমি যখন বারো বছর বয়স পার করেছি, তখন আমার দিদির বিয়ে হয়ে যায়। তারপরে অনেকবার দিদির বাড়ি গেছি। দিদির বাড়ি ছিল আমার সেকেন্ড হোম। প্রত্যেকটি বাৎসরিক পরীক্ষার শেষে যে একমাস ছুটি পেতাম, সেই একমাস দিদির বাড়িতে কাটাতাম। কি আনন্দটাই না হতো। গ্রামটিকে ঘিরে রয়েছে কালনাগিনী নদী এবং তার শাখা নদী। দিদির বাড়ি গিয়ে শুরু হতো আমার দূরন্তপনা। জাল নিয়ে চলে যেতাম নদীতে মাছ ধরতে। তখন আমার সঙ্গী ছিল আমার থেকে দু’বছরের ছোট ভাগ্নে অনিল আর পাড়াতুতো ছোট্ট বোন তুলসী। তিন জনে মিলে ছাকনি জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করতাম। ওই বয়সে মাছ ধরা কিছুই হতো না। কেবলমাত্র জল কাদা মেখে একসা হয়ে বাড়ি ফিরতাম। বাড়ি ফিরলে তুলসী খুব মার খেত। ভাগ্নেকেও দিদি বকুনি দিত। কিন্তু দিদি আমাকে খুব আদর করে চান করিয়ে দিত।যেন আমার মৃত মা আমার দিদি হয়ে আমাকে আমার প্রাপ্য মাতৃস্নেহ ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
দেখেছেন, কথায় কথায় আমার পরিচয় দিতে ভুলে গেছি! আমার নাম জয়ন্ত গিরি। বাড়ি নামখানা।আমি আমার পিতা লালমোহন গিরির তৃতীয় এবং শেষ সন্তান। আমার বয়স যখন মাত্র চার বছর, তখন আমার মা মারা যান।তারপর প্রথমে দিদি এবং পরে বৌদির আদর যত্নে মানুষ হয়েছি। এঁরা আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি।
দিদির বাড়ি যেতে যেতে আমার তুলসীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি, তখন আমি তুলসীকে ভালোবাসতে শুরু করি। তুলসী আমার কাছে তখন ছিল এক অজানা রমাঞ্চকর নারী। আমি প্রায়ই তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। অবশেষ দিদি কি মনে ভেবে আমাকে পূজার ছুটি শেষ হবার আগেই নামখানা ফেরত পাঠালেন।তারপর আর কোন দিন আমাকে দিদির দূর্বাচটি পাঠাতেন না।
এরপর আমি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ক্যামিষ্ট্রিতে বি.এস.সি করার পর যাদবপুর থেকে একসঙ্গে বি.টেক এবং এম.টেক করে ব্যাঙ্গালোরে একটি কোম্পানীতে চাকুরি করতে শুরু করলাম। শুরু হলো আমার নতুন জীবন। আমি একেবারে কর্পোরেট লাইফে প্রবেশ করলাম। শুর হলো নাইট ক্লাবে যাওয়া, পার্টিতে আড্ডা দেওয়া, সারারাত মদে চুর হয়ে থাকা। সকাল ন’টা পর্যন্ত ঘুমানো। তারপর ১০ টার পর একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে অফিস যাওয়া। ফ্রেন্ড এর চেয়ে গার্ল ফ্রেন্ড এর সংখ্যা বেশী। সেখানে ভালোবাসার কোন জায়গা নেই। মন দেওয়া নেওয়ার কোন ব্যাপার নেই। দু’জনে সহমত হলে অঢেল সহবাসে মত্ত হতে কোন বাধা নেই। সংসার গড়ার কোন সুযোগ নেই। যারা সংসার গড়েছে তাদের সংসারে কোন শৃঙখলা নেই। বেশ কয়েক বছর আনন্দে কাটানোর পর আমার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম- এই কি জীবন! এর কি কোন প্রয়োজন আছে? এই ভাবে কি জীবন কাটানো যায়! বাড়ি থেকে অনেকবার বিবাহের জন্য পীড়াপীড়ি করছিল। কিন্তু সাময়িক সুখের আনন্দে সে সব গুরুত্ব দেই নি। খুব সুচতুরভাবে দাদার দেওয়া প্রস্তাব এড়িয়ে গেছি।দাদা হয়তো ভেবেছিলেন যে ভাইয়ের হয়তো নিজস্ব কোন পছন্দের মেয়ে আছে, তার অপেক্ষায় বসে আছে। কিন্তু আমার বয়স যখন প্রায় চল্লিশ ছুই ছুই তখন দাদা বৌদি কেঁদে কেটে একসা হলেন। ততদিনে বিয়ে এবং সংসার সম্পর্কে বিতৃষ্ণা জন্মেছে। আমি ঠিক করলাম যে আর জীবনে বিয়ে করবো না। দাদা বৌদি সবারই অনুরোধ হেলায় অগ্রাহ্য করলাম। আমি এখন সংসার থেকে বৈরাগ্য নিয়ে সম্পুর্ন সন্যাসী।
আমি ব্যাঙ্গালোর থেকে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে এসেছি। আমার ব্যাঙ্গালোর কোম্পানীর একটি শাখা কলকাতায় খুলেছে। আমি তার হেড অফ দি ইনচার্জ হয়ে চলে এসেছি। রিটায়ার্ড পর্যন্ত আশাকরি এখানে কেটে যাবে। এখানে এসেই প্রথমে নিজের কোয়াটারে উঠলাম। প্রথমে অফিস ডেকরেটিং করতে হবে। আমি ডেকরেটারদের সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গ্রামের বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। অফিস ডেকরেটিং করতে মিনিমাম মাস খানিক লাগবে। এই সময়টা গ্রামের বাড়ি, দিদির বাড়ি জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। তাছাড়া আসছে পৌষ সংক্রন্তিতে সাগর মেলাতে যাওয়ারও প্ল্যান রয়েছে। যাইহোক পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে অফিসের গাড়ি নিয়ে নামখানার পথ ধরলাম।
দাদা বৌদি সব জেনে খুব খুশি হলেন। বৌদি তো বেজায় খুশি। তিনি আমার জন্য কত কি রান্না করে খাওয়াতে লাগলেন। দু’ তিন দিন বেশ আনন্দে কাটলো। এবার দিদির বাড়ি যাবো। এখন আর গাড়ি নিলাম না। কারণ দিদির বাড়ি যেতে হলে দুটি জলপথ আছে যেখানে গাড়ি অচল।
একদিন খুব সকালে বাড়ি থেকে বের হলাম। প্রথমে বাসে এবং পরে ভ্যানে করে গিয়ে দূর্গানগরে নদীপাড়ে উঠলাম। কাছেই খেয়া ঘাট। আগে ভালো ঘাট ছিল না। সিড়ি ছিল গরান কাঠ দিয়ে। এখন সুন্দর কংক্রীটের সিড়ি হয়েছে। আগে নৌকা বৈঠা বেয়ে চালানো হত। এখন ইঞ্জিন বসানো নৌকা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সব কিছু বদলেছে। আগে এখানে নৌকা চালাতো আমার ছোট বেলার মাছ ধরার সাথী, খেলার সাথী তুলসীর বাবা গনেশ দুলে। এখন কে চালায় কে জানে?
খেয়া ঘাটে পৌছে দেখি ঘাটে একটিও লোক নেই। আর থাকবেই বা কি করে! বিশ্ব চরাচর যে ঘন কুয়াশায় ঢাকা! তিন চার ফুট দুরের বস্তুকেও দেখা যায় না। এই অবস্থায় নৌকা চালনা করা যায় না। তার উপর এখানে যাতায়াতের লোক সংখ্যাও কম হয়। এখন জন পিছু ভাড়া দশ টাকা। ন্যুনতম পাঁচজন না হলে নৌকা ছাড়বে না। খেয়াঘাট জনমানব শূন্য। কেবলমাত্র ঘাটের কাছে একটি দোকান আছে। সেই দোকানে দেখলাম চা, পান, বিড়ি, খৈনী, গুটকা, মুড়ি চানাচুর এই সমস্ত কিছু পাওয়া যায়। দোকানদার একটি চৌত্রিশ পয়ত্রিশ বছরের মহিলা। আমি বললাম-আপনার দোকানে গোল্ড ফ্লেক হবে?
-আজ্ঞে না, শুধু ফ্লেক হবে।
-আচ্ছা তাই দিন।
সিগারেট ধরিয়ে একটি সুখটান দিয়ে বললাম- খেয়া কখন ছাড়বে? নৌকার মাঝি কোথায়?
-আজ্ঞে জনা পাঁচেক লোক হলে নৌকা ছাড়বে। এখন নৌকা মেসিনে চলে। তেলের খরচ আছে। পঞ্চাশ টাকা না হলে ঠিক পোষায় না।
-পঞ্চাশ টাকা কেন, এক’শ টাকা দিতেও আমি রাজি। কিন্তু নৌকার মাঝি না থাকলে নৌকা চালাবে কে?
-আজ্ঞে আমি নৌকার মাঝি। মহিলা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন।
-আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
-আজ্ঞে না, আমি রসিকতা করছি না। আমিই নৌকার মাঝি। মহিলা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন।
-আপনি নৌকার মাঝি হলে এই দোকান চালাবে কে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
-পাঁচজন লোক হতে প্রায় ঘন্টা খানিক সময় লাগে। ততক্ষন কি আর করি এই দোকানে বসলাম। তাতে যাত্রীরা একটু বিশ্রামের জায়গা পায় আর আমারও দু’চার পয়সা কেনা কাটা হয়। তারপর নৌকা নিয়ে গেলে দোকানের ঝাঁপ ফেলে দরজায় তালা দিলেই হলো।
- বেশ তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু পেসেঞ্জার আসতে এখন অনেক দেরী হবে আমার তাড়া আছে। আমায় কি একটু পার করে দেওয়া যাবে?
-পার করে দিতে অসুবিধা নাই। কিন্তু এত কুয়াসা যে নৌকা ওপারে নিয়ে যাওয়াটাই সমস্যা।
-মহিলা ঠিকই বলছেন। এই কুয়াসায় নৌকা চালানো সত্যি সমস্যার। তার কারণও আছে। কালনাগিনী নদী খুব খরস্রোতা। তাছাড়া তার বুকে জেগে উঠেছে প্রায় হাজার বিঘার জঙ্গলাকীর্ণ চর। নৌকা নিয়ে প্রথমে অর্ধেক কালনাগিনী নদী পার করে দ্বীপে পৌছতে প্রায় মিনিট দশেক সময় লাগবে। তারপর নৌকা দ্বীপের মধ্যে একটি খালে প্রবেশ করবে। দ্বীপ পার হতে সময় লাগবে প্রায় পাঁচ মিনিট। কপাল ভালো হলে এই সময় আপনি হরিন, শুয়ার বা শেয়ালেরও দেখা পেতে পারেন। সমস্ত বনভুমি ম্যানগ্রোভ জাতীয় এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার দ্বারা সংরক্ষিত। তারপর আবার বাকি অর্ধেক কালনাগিনী নদী পার হতে সময় লাগবে প্রায় মিনিট দুয়েক। সুতরাং এই ঘন কুয়াসায় সতের মিনিটের জায়গায় দু’ঘন্টা সময় লাগাও বিচিত্র কিছু নয়।
-আপনি ওপারে কাদের বাড়ি যাবেন? মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।
-ঐ বিকাশ মাইতির বাড়ি। চেনেন উনাকে?
-চিনি তো। কিন্তু উনি আপনার কে হন? মহিলা আমাকে যেন জেরা করতে লাগলেন।
-আমি কিছু মনে না করে বললাম-উনি আমার জামাইবাবু।
-ও তাই! তাহলে চলুন আপনাকে পার করে দেই।
-এই যে বললে এই কুয়াসায় নৌকা চালানো যাবে না!
-নৌকা চালানো যাবে না বলিনি। বলেছি নৌকা চালাতে কষ্ট হয়। অনেক বেশী সময় লাগবে। ফলে খরচ বাড়বে। কিন্তু আপনি যখন এক’শ টাকা দেবেন বলছেন, তখন আমার যেতে অসুবিধা নেই।
-কথা বলতে বলতে মহিলা, দোকান বন্ধ করে দিলেন। আমি দোকানের বাইরে পাতা বেঞ্চে বসেছিলাম। আমিও উঠলাম। দু’জনে গিয়ে নৌকায় উঠলাম। আমি নৌকার মাঝখানে গিয়ে বসলাম। কুয়াসা যেন আরও ঘন হতে লাগলো। অথচ বেলা এখন সাতটা!
মহিলা নৌকার ইঞ্জিন চালু করলেন। বেশ অবলীলায় হ্যান্ডেল লাগিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন। নৌকা তীর বেগে ছুটে চললো। মিনিট পাঁচেক যাবার পর আমি জিজ্ঞাসা করলাম-আচ্ছা, এই নৌকা এক সময় চালাতো গনেশ দুলে। তাকে কি চেনেন? তিনি কি বেঁচে আছেন? যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে কেমন আছেন?
-আপনি গনেশ দুলেকে চিনতেন? মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।
-চিনবো না! তাদের বাড়ি যে আমার দিদির বাড়ির পাশেই। তাছাড়া উনার একটি মেয়ে ছিল। তার নাম ছিল তুলসী। সে ছিল আমার খেলার সাথী, মাছ ধরার সঙ্গী। আপনি তুলসীকে কি চেনেন? তুলসীর বিয়ে হয়েছে নিশ্চয়? ছেলে মেয়ে কয়টি?
-দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান। এত্তো প্রশ্ন একসঙ্গে করলে উত্তর কি দেওয়া যায়? আপনার প্রশ্ন শুনবো না নৌকা সামলাবো?
ইতি মধ্যে দেখি নৌকা ঠিক দ্বীপের খালের ভিতর প্রবেশ করেছে। কিন্তু নৌকা মাত্র বিশ তিরিশ ফুট গিয়ে আটকে গেল।মহিলা বললেন- সব্বনাশ হল মশাই। এই খালের নাব্যতা কমে গেছে।ফলে নৌকা আটকে গেল।জোয়ার শুরু হয়েছে। মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করলে যাওয়া যাবে।
আমি একেবারে ভয়ে আঁতকে উঠলাম। এ যে মহা বিপদ। একে ঘন কুয়াশা। তার উপর একাকী মহিলার সঙ্গে কুয়াসাচ্ছন্ন জঙ্গলাবৃত দ্বীপে আবদ্ধ হয়ে সমাজের কুৎসা অর্জন করতে হবে নাকি! আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লাম। এমন সময় মহিলা বললেন- চিন্তার কিছু কারণ নেই। একটু সবুর করুন। ঠিক আপনাকে পৌছে দেব। ততক্ষনে আমি আপনার করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
গনেশ দুলে মারা গেছেন। তুলসীর বয়স যখন সতের বছর তখন তার বাবা মারা যান।তুলসীর দু’টি ছোট ভাই ছিল। তাদের মানুষ করতে গিয়ে তুলসীর আর বিয়ে হয় নি। দুই ভাইকে মানুষ করে তাদের বিয়ে দিলেন। কিন্তু নতুন বউরা এসে ননদকে তাদের সংসারে মানিয়ে নিতে পারলো না। ফলে এখন তুলসী একা থাকে।
-তাহলে তুলসীর এখন চলে কিভাবে?
-নৌকা চালিয়ে যা রোজগার হয় তাতেই চলে যায় তুলসীর।
-তুলসী নৌকা চালায়!
-হ্যা।নৌকা চালিয়েই তো ভাইদের মানুষ করেছে।
-তুলসী এখন কোথায়?
-আপনার সম্মুখে বসে আছে।
- আ-প-নি….. মানে তুমি তুলসী!
-হ্যা, জয়ন্তদা। আমিই তুলসী।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।যার সঙ্গে অতীতে খেলাধুলা করেছি, নদীর জলে অবগাহন করেছি, ছোট্ট বেলায় খুনসুটি খেলেছি, সেই শিশু এখন আমার সম্মুখে রমণী হয়ে উপস্থিত! সেই চোখ, সেই অবিন্যস্ত ঘনকালো চিকুর,সেই ভূবন ভোলানো হাসি দেখলে মনপ্রান উথাল পাথাল করে উঠে।
-জয়ন্তদা, তুমি একা কেন? বৌদি আসে নি?
-আমার চিন্তার জট কাটলো। আমি বললাম- না আসে নি।
-কেন? নদী বুঝি ওর ভালো লাগে না?
-দূর পাগলি, বৌদি হলে তো আসবে?
-মানে?
-মানে খুব সোজা। আমি এখনো বিয়ে করি নি।
-ও মা সে কি গো! আবার কবে বিয়ে করবে? আর বিয়েই বা করনি কেন?
-মনের মতো পাত্রী পাই নি বলে।
-ও মা, সে কথা! তোমার আবার পাত্রীর অভাব?
-হ্যা রে পাত্রীর সত্যি অভাব। আমি যা খুঁজি তা পাই নি। আমি এমন পাত্রী চাই, যে তার স্বামীকে ভালোবাসবে, নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবে,নিজের মতো করে সংসার চালাবে। কিন্তু যত মেয়ে আসে সবাই মেকী সুন্দরী, সবাই ঝি এর দ্বারা রান্নাবান্না করাতে চায় বা ঝি এর দ্বারা সন্তানের লালন পালন করাতে চায়। সবাই বারে বা ডিস্কোতে যেতে চায়।
-বার বা ডিস্কো কি দাদা?
-সে তুমি বুঝবে না। কিন্তু বিয়ের কথা যখন বললে তখন আমি একটি কথা বলবো রাখবে?
-বলো দাদা, বলো। আমি কি তোমার কথা ফেলতে পারি?
-তুমি আমায় বিয়ে করবে?
-সে কি জয়ন্তদা! তুমি আমায় বিয়ে করতে চাও! আমি কি তোমার উপযুক্ত! তুলসীর হৃদয় সমুদ্রে আজ হাজার লহরীর সহস্র কলতানে উদ্বেল হয়ে উঠেছে। পয়ত্রিশ চৈত্রের জমানো জলীয় বাষ্প আজ অশ্রুবিন্দু হয়ে আঁখি পল্লব থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে। বাষ্প বেরিয়ে যাবার ঝাকুনিতে বক্ষের উত্থান পতন হচ্ছে। নৌকার উপর দুই হাঁটু উচু করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদছিল তুলসী। হঠাৎ জয়ন্তের হাতের ষ্পর্শে চমকে ওঠে তুলসী। দেখে তার সম্মুখে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে নৌকার দেবী মা গঙ্গার সিঁথির সিঁদুরে চর্চিত করে দাঁড়িয়ে আছে জয়ন্ত। এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে সেই সিঁদুরে রাঙিয়ে দিলে তুলসীর সিথি। তুলসী হাউ হাউ করে কেঁদে বললে- একি করলে জয়ন্তদা! আমি যে বাগদি ঘরের মেয়ে। আর তুমি মাহিষ্য, উচু জাতের মানুষ। আমাকে কি তোমার বাড়ির লোকেরা মেনে নেবে!
-জাত বিচারের বজ্জাতির দিন শেষ হয়েছে তুলসী। আমাদের এক কবি অনেক দিন আগে বলেছেন-”সবার উপরে মানুষ সত্য”। মানুষকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। তুমি মানুষ। আমি তোমার বিচার করে আমার সহধর্মিনী করেছি। আর আমার বাড়ির লোকেরা না মানলে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আর নাবালক নই। আমি পরের উপর নির্ভরশীলও নই। আমি স্বছন্দে তোমাকে নিয়ে সংসার করতে পারি। কিন্তু এ সব কথা বাদ দাও। তুমি আগে বলতো-তুমি কি আমায় ভালো বাসতে না?
এবার তুলসী আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। সে জয়ন্তের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দুহাতে স্বজোরে জড়িয়ে ধরলো। আর কাঁদতে কাঁদতে বললো-তোমাকে যদি না ভালোবাসবো, তাহলে এতো বছর আমি একা থাকবো কেন! ওগো তুমি আমাকে আর ছেড়ে যেও না।
আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে গঙ্গার এমনই এক দ্বীপে মহামুনি পরাশর এমনই নৌকার উপর মৎসগন্ধা সত্যবতীর সঙ্গে মিলনে মেতেছিলেন। আজকের মতো সেদিনও ছিল ঘন কুজ্ঝটিকা। ফারাক শুধু একটাই। তাঁরা ছিলেন দেবতুল্য। আর এরা সামান্য নরনারী। সেখানে ছিল শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র যমুনা। এখানে গঙ্গার শাখানদী কালনাগিনী।
কিছুক্ষন পরে জোয়ারের প্রবল স্রোতে চলাৎ চলাৎ করে জল ঢুকতে লাগলো। তার তালে তালে নৌকাও দুলতে লাগলো। ধীরে ধীরে কুয়াসার মধ্যদিয়ে সূর্য্যদেবকে রাতের চাঁদের মতো দেখতে লাগলো। জনশূন্য সেই দ্বীপের অভ্যন্তরে দুই নরনারী দুই লতার মতো একে অপরকে আলিঙ্গন করে পড়ে রইলো।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
৮ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০
দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.