#ভূতুড়ে_মাফলার

#ভূতের গল্প

আমি তখন নিশ্চিন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করি। খুব ভালো পঞ্চায়েত। আমি প্রধানসহ সকল মেম্বার আর পাবলিকের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলাম। প্রধান বিভাস বসু অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আজ সেই বিভাসবাবুর গল্পই আপনাদের শোনাবো।
বিভাসবাবুর বাড়ি নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। গৌরবর্ন এবং প্রায় ছ’ফুট দৈর্ঘ্যের বিভাসবাবু ছিলেন অত্যন্ত রসিক মানুষ।আনুমানিক বয়স পঞ্চান্ন সাতান্ন বছর হলেও মনটা ছিল অত্যন্ত শিশুর মতো সরল আর সাদাসিধে।তিনি প্রত্যেকটা মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। পঞ্চায়েত অফিসে প্রায়ই কাজ করতে করতে খেয়াল থাকে না যে কখন বেলা পাঁচটা গড়িয়ে সাতটা বেজে যায়। পেটে ছুঁচোর ডন দিলে তখন বুজতে পারি। এরকম দেরি প্রায়ই হয়। তো একদিন শীতের সিজিনে কাজ করতে করতে সন্ধ্যে আটটা বেজে যায়। বেজায় শীত পড়েছে। আমি আবার সেদিন মাফলার নিতে ভুলে গেছি। কাছে শয়টার আছে ঠিকই, কিন্তু মাফলার না থাকার জন্য উত্তুরে হাওয়ায় দাঁতে দাঁত লাগিয়ে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছি। তাই দেখে প্রধান বিভাসবাবু নিজের মাফলার খুলে আমার গলায় জড়িয়ে দিলে।আমি বললাম- স্যার, এ কি করলেন। আপনার মাফলারটা আমায় দিলেন?!
-আমার থেকে আপনার বেশী প্রয়োজন। আমার কাছাকাছি বাড়ি। বাড়ি পৌছে গেলে আমার আর কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু অনেকটা পথ পেরিয়ে আপনার বাড়ি পৌছাতে বেশ অসুবিধা হবে। তাই আমার মাফলারটি আপনাকে দিলাম।এই বলে তিনি উনার সাদা রঙের উপর হাল্কা ছাই রঙের কাজ করা উলের মাফলারটি আমার গলায় জড়িয়ে দিলেন।

বাস্তবিক ভাবে আমার ঠান্ডায় বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মাফলারটি পেয়ে আমার যার পর নাই সুবিধা হলো এবং আমি উনার মাফলার নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। পরেরদিন অফিসে গিয়ে উনার মাফলারটি ফেরত দিতে গেলে উনি বললেন- যদিও আমি ওঠা ব্যবহার করেছি, তবুও আমি ওটা আপনাকে রাখতে দিলাম। যখন আমি থাকবো না, তখন আমার স্মৃতি আপনাকে মনে করাবে। আমি বললাম- যদি আমি আপনার আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেই, তাহলে কি হবে? তখন উনি বললেন- তাহলে আপনি আপনার মাফলারটি আমায় দিন। তাহলে কেউ কাউকে ভুলবো না। তাই করা হলো।
এরপর আমার বেশ কয়েকটি রুটিন ট্রান্সফার হলো। ৪নং ট্রান্সফারে বহড়ু গ্রাম পঞ্চায়েতে ট্রান্সফার হলাম। বাড়ি থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করি।আমার বাড়ি নামখানা ব্লকের নারায়নপুরে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা হাঁটলে নামখানা স্টেশন। সুতরাং যাতায়াতের কোন অসুবিধা নাই।
একদিন ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে হবে। তখন বেশ শীত পড়েছে। সেদিন ছিল শুক্রবার।বি ডি ও অফিসে ইলেকশান সেলে ভোটার লিষ্টের সংশোধনীর অনেক কাজ ছিল। কাজগুলো ওইদিন শেষ করতেই হবে। ফলে রাত ন’টা পর্যন্ত কাজ করতে হলো। যখন কাজ শেষ করে বের হলাম, তখন বি ডি ও সাহেব অনুরোধ করলেন যে আমরা যেন সাহেবের গেষ্টরুমে রাতটুকু কাটাই। আমরা মোট জনা দশেক ছিলাম। ওরা ন’জনে থেকে গেলেও আমি থাকলাম না। কারণ আমার বাড়ি ফেরার জন্য এখনো ৯.৪৫ এর এবং ১০.৩০ এর ডাউন নামখানা লোকাল আছে। আমার ফিরতে কোন অসুবিধা নাই বলে তাড়াতাড়ি স্টেশনে চলে এলাম। খুব সহজেই ৯.৪৫ এর ডাউন নামখানা লোকাল পেয়ে গেলাম।
আমি আগে কোন দিন এত রাতের ট্রেনে বাড়ি ফিরিনি। ভাবছিলাম এত রাতের ট্রেনে নিশ্চয়ই ভিড় কম হবে। কিন্তু কোথায় ভিড় কম! সেই থিক্ থিকে ভিড়ে ঠাসা ট্রেন। মনটা আনন্দে ভরে গেল। যাক বাবা, খালি ট্রেন নয়। খালি ট্রেনে যেতে ভয় লাগে। এমন সময় ট্রেন লক্ষ্মীকান্তপুরে পৌছালো।যত পেসেঞ্জার ছিল সবাই নেমে গিয়ে ট্রেন একেবারে খালি! আমার কম্পার্টমেন্টে আমি ছাড়া আর কেউ নেই! এক ঘন্টার রাস্তা যাবো কি করে! ভয়ে যে বুক দুরু দুরু করতে লাগলো! ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগের মূহুর্তে নিশ্চিন্তপুরের প্রাক্তন প্রধান তথা বিভাস বসু আমার বগিতে উঠলেন এবং উঠেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মধ্যেও পুরানো প্রেম জেগে উঠলো। ফলে আমিও উনাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
বিভাসবাবুকে জড়িয়ে ধরতেই আমার বুকটা কেমন ছেঁদ করে উঠলো। আমি ভয়ে দু’ পা পিছিয়ে গেলাম। এত ঠান্ডা শরীর! হাতগুলো যেন বরফের মতো ঠান্ডা। একেবারে মৃত মানুষের মতো! আমি বললাম- আপনার হাত বা শরীর এতো ঠান্ডা কেন?
-হবে না! ছ’টা থেকে একজনের জন্য প্লাট ফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছি।তাই এই ঠান্ডায় জমে বরফের মতো হয়ে গেছে। যাইহোক আমরা মুখোমুখি বসলাম।গল্প করতে করতে আসতে লাগলাম। তারপর এক সময় আমার মাফলারটির দিকে তাকিয়ে বললেন- এটা সেই আমার মাফলার না?
-হ্যা। আমি মুচকি হেঁসে জবাব দিলাম।
- যাক, আমার স্মৃতিটি যে সযত্নে রেখেছেন, সেই জন্য আমি কৃতার্থ হয়েছি। তারপর নিশ্চিন্তপুর সংক্রান্ত আরও অনেক আলোচনা হলো।অবশেষে নিশ্চিন্তপুর স্টেশান এলে উনি নেমে যান। এবার আমি একা কামরার মধ্যে।

সাড়ে এগারটার সময় বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরেই ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিয়ে গান্ডে পিন্ডে দু’টো গিলে বিছানায় লেপের তলায় আশ্রয় নিলাম। এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখি আমার নিশ্চিন্তপুরের মেম্বার আব্দুল কাইউম মন্ডল এর নাম। অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা ধরলাম। বললাম-হ্যা,কায়ুমদা বলো।
-তুমি এখনো ঘুমাও নি!
- আমরা কি তাড়াতাড়ি ঘুমাই? আমরা হলাম গে নিশাচর প্রানী।বেশী রাত না হলে আমাদের ঘুম আসে না। তা যাইহোক এত রাতে ফোন করলে কেন?
-আরে খবর শুনেছো?
-কিসের খবর?
- আরে আমাদের প্রধান বিভাস বসুর খবর?
- আজ যে বিভাসবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সেকথা চেপে গিয়ে বললাম- না, কোন খবর পাই নি তো! উনার আবার কিসের খবর?
-আরে আমাদের বিভাসবাবু আজ সকালে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
- আমি চমকে উঠলাম। বললাম-বলছো কি! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম।
-ওপার থেকে কায়ুমদার গলা ভেসে এলো। উনি বলছেন-বিশ্বাস না হয় তুমি আজকের পেপারগুলো দেখবে। তারপর আমি কিছু না বলে ফোন কেটে দিলাম।

আমার ঘুম গেল ছুটে। বাড়ির কাউকে কিছু বললাম না। সবাই ঘুমালে উনার দেওয়া মাফলারটি আমি বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। উদ্দেশ্য কাল সকালে উঠে মাফলারটি বাড়ির কাছাকাছি শ্মশানে ফেলে দেবো। মাফলারের ঝামেলা আর রাখবো না।
রাতে কিছুতেই ঘুম এলো না।ভোরের দিকে একটু সামান্য তন্দ্রা মতো এসেছিল। কিন্তু সে ক্ষনিকের জন্য। সবার ঘুম ভাঙার আগে আমারই তন্দ্রা গেছে ছুটে। বাইরের দিকে তাকালাম। দেখলাম সকাল হয়ে গেছে। আমি বিছানা ছাড়ার আগে আমার মিসেস আগে উঠলো। আমি তাড়াতাড়ি বাইরের দরজা খুলে বাইরে তাকালাম।সে কি মাফলার গেল কোথায়? যাক বাবা, কেউ মনে হয় নিয়ে পালিয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে। আমাকে আর কষ্ট করে শ্মশানে যেতে হবে না।
মর্নিং ওয়াকে যাওয়ার জন্য আমার নিজের মাফলারটি খুজতে গিয়ে দেখি বিভাসবাবুর মাফলারটি তার পাশে রয়েছে।মাফলারটিতে এখনো ধুলো ময়লা লেগে রয়েছে। আমার মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি অচৈতন্য হয়ে মেজে পড়ে গেলাম। আমার মিসেস না ধরলে আমার মাথা ফেটে যেত। ও আমাকে ধরে ফেলায় কোন রকমে রক্ষা পেয়ে গেছি।
আমি সুস্থ হবার পর গিন্নিকে সব ঘটনা খুলে বললাম। ও সব শুনে বললে- তুমি আগে এটাকে শ্মশানে ফেলে এসো। তারপর কি হয় দেখে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। গিন্নির কথা মতো তাই করলাম। সেদিন শনিবার। আস্তে আস্তে দিন শেষ হয়ে রাত এলো। আমরা খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ছেলে মেয়েরা এসব কিচ্ছু জানে না। তাদের ভয়ের কোন কারন নেই। শুধু আমরা ভয়ে ভয়ে জেগে রইলাম। আমরা ঘরের দরজা খুলে রেখেছি। আমার ঘরের জানালা দিয়ে ঘরের প্রধান দরজা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। রাত প্রায় বারোটার দিকে হঠাৎ দেখলাম যেন দেওয়াল ভেদ করে বিভাসবাবুর প্রেতাত্মা ঘরে ঢুকলো। তারপর এদিক ওদিক তাকালো। এবার রান্না ঘরের দিকে গেল। তারপর রান্না ঘরে খুটখাট শব্দ শুনতে পেলাম। তিন চার মিনিট পর আমার ঘরে এলো। আমরা ঘুমের ভান করে নিশ্চলভাবে পড়ে আছি। তারপর দেখলাম বিভাসবাবুর প্রেতাত্মা আবার মাফলার হয়ে আমার আলনায় ঝুলে পড়লো।
রাতটুকু কিভাবে কেটেছে বলতে পারবো না। সকালে উঠে ছুটলাম ঝন্টু গুনিনের কাছে।তাঁকে সব বললাম। তিনি সব শুনে বললেন- ভয়ের কিছু নেই।আমি এখান থেকে তোমাদের সকলের শরীর বন্ধ করে দিচ্ছি।তোমাদের কাউকে ওই প্রেতাত্মা ছুঁতেও পারবে না। তারপর আমি রাতে তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি।
রাত বারোটা পর্যন্ত কোন ক্রমে কাটলো।বারোটার পর ঝন্টু গুনিন এলো। দেখলাম তার হাতে একটি কালো হাঁস। ব্যাগে কিছু জিনিষপত্র ভর্তি করে এনেছে। কিছুক্ষন পর দেখলাম মেঝেতে ঝন্টু গুনিন একটি পূজোর মতো আয়োজন সাজিয়েছেন। এবার তিনি পুকুর থেকে ঘট তুলে আনলেন। তারপর পুজোয় বসলেন। পুজো শেষ করার পর তিনি সেই মাফলারটি চাইলেন। আমি মাফলারটি দিলে তিনি সেটি মেঝের উপর রাখলেন। তারপর কি সব মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন। এক সময় থেমে বললেন- আয় বেটা, তোর মাফলারে গিয়ে ঢোক। এমন সময় মাফলারটি যেন নড়ে উঠলো।তখন ঝন্টু গুনিন হেসে বললে- এই তো লক্ষ্মী ছেলে।তোর ঘাড়ে চড়ে যে যায় তাদের আমি শায়েস্তা করি।আর তুই কোন ছার। এই বলে তিনি মাফলয়ারের চারিদিকে একটি কাল্পনিক গন্ডি কেটে দিলেন।
এবার ঝন্টু গুনিন গন্ডীর ভিতর কালো হাঁসটি দিয়ে বললে- নে এটা খেয়ে নিয়ে তুমি বিদায় নাও বাছা। এরা ছেলে বউ নিয়ে সংসার করুক। মুহুর্তের মধ্যে মাফলারটি বিভাসবাবুর রূপ ধারণ করলে।একটি ছায়া মূর্তি। সেই মূর্তি মুহুর্তের মধ্যে হাঁসটিকে খেয়ে ফেললো। পালকগুলোও বাদ দিল না। আমরা ভয়ে স্থবির হয়ে গেলাম। আমার গিন্নি তো গোঁ গোঁ করতে করতে মূর্ছা গেল।ভাগ্যিস ছেলে মেয়েদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দরজা ভিজিয়ে দিয়েছিলাম। গিন্নিকে কোন ক্রমে সামলে যখন ঝন্টু গুনিনের দিকে তাকালাম,তখন দেখি তিনি একটি প্লাসটিকের বোতলের মুখ খুলে বিভাসবাবুকে বোতলের মধ্যে ঢুকতে বলছেন।দেখলাম বিভাসবাবু সুড়সুড় করে বোতলের মধ্যে ঢুকে গেল। এবার ঝন্টু গুনিন বিড় বিড় করে মন্ত্র বলতে বলতে ছিপি দিয়ে বোতলের মুখ বন্ধ করলেন।
এবার সবকিছু গুড়িয়ে তিনি ব্যাগে পুরলেন। হাঁসের রক্ত পর্যন্ত ভালো করে মুছে নিলেন। এমনকি সাবান দিয়ে ভালো করে মেঝে পরিস্কার করে দিলেন।দেখলাম ভোরের সুর্য উদিত হয়েছে। সবকিছু গুড়িয়ে ঝন্টু গুনিন বললে- বাবা আমার ছ’হাজার টাকা বিদায় দিলে আমি বিদায় হই। আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে টাকাটা দিয়ে দিলাম।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমার ভূতের প্রতি বা প্রেতাত্মায় বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু নিজের জীবনে এই ঘটনার পর সেই দম্ভ আমার ভেঙ্গে গেল। আমার এই বোধ থাকা উচিত ছিল যে পৃথিবীতে যখন ভূত, প্রেত শব্দের অবস্থান রয়েছে, তখন বাস্তবে এদের অস্তিত্ব থাকাই স্বাভাবিক।
কপিরাইট@কৃষ্ণদ্বৈপায়ন
নামখানা
৩১শা মার্চ,২০২০।

(দেখলাম আমার পরিচিত বন্ধুরা এই গল্পের মূল চরিত্রের সঙ্গে বাস্তবের একটি মানুষের মিল খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে গল্পের কোন চরিত্রই বা ঘটনা আসল নয়, সবই কাল্পনিক। তাই বন্ধুদের জানাই যে বাস্তবের সঙ্গে যদি এই গল্পের কোন চরিত্রের মিল খুঁজে পান তাহলে তা নিতান্ত কাকতালীয়। গল্পের কোন চরিত্র বাস্তবে অস্তীত্ব নেই)

1 টি মন্তব্য:

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.