#কেন_আপনি_এই_গল্পটি_পড়বেন?

সুশান্ত জানা অত্যন্ত শান্ত ধীর স্থীর গো-বেচারা ধরনের মানুষ। জীবনে অনেক সংগ্রাম করে আজ একটি সমাজের সম্মান জনক অবস্থানে পৌছেছেন। এই নিয়ে সুশান্তবাবুর গর্বের শেষ নেই। তিনি প্রায়ই তার জৈষ্ঠ্য পুত্র গোপালকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন-শোন বাবু, জীবনে মানুষ হতে গেলে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়। সব কিছু সহে লড়াই চালিয়ে যেতে পারলেই তবে জীবনে সাফল্য আসে। নেতাজী, গান্ধীজী, মেন্ডেলা, কেনেডি এঁরা জীবনে কত না…….। সুশান্তবাবুর কথা ফুরোবার আগেই গোপাল উধাও হয়ে গেছে। কারণ সে জানতো যে এর পর তার পরম পূজনীয় পিতৃদেব যে জ্ঞানের সুনামী বইয়ে দেবেন তার বিধ্বংসী আঘাত সে সহ্য করতে পারবে না। সুশান্তবাবু কিছুক্ষন নিজের মনে গজ গজ করতে করতে নিজের কাজে ডুবে যেতেন, তা সে কাজ সব্জী বাগান বানানো হোক বা অফিসের কোন কাজ।
সুশান্তবাবু একেবারে বাস্তববাদী মানুষ। কখনো কল্পনার রাজ্যে বাস করতেন না। তাই গোপালের কবিতা, গল্প লেখাকে তিনি পন্ডশ্রম কাজ বলে মনে করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন-কবিতা গল্প লেখা এক ধরনের বিলাসিতা। এতে কখনো উপার্জন করে পেট চালানো যায় না। যে কাজে জীবনের স্বাচ্ছন্দ আসে না, বউয়ের আবদার মেটানো যায় না, সন্তানের ভালো মন্দ দেখা যায় না, সেই কাজ পন্ডশ্রম ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে? কবিতা গল্প লেখা তাদের মানায় যাদের অন্তত না খেয়ে মরার কোন চান্স নেই। বঙ্কিম চন্দ্রের কালেকটারীর পয়সা ছিল, রবীন্দ্রনাথের জমিদারী ছিল, বনফুলের ডাক্তারী ছিল তাই তাঁরা গল্প কবিতা লিখে সাহিত্য চর্চা করেছেন। কিন্তু অনেক লেখকের গ্রাসাচ্ছাদনের কোন উপায় ছিল না। সাহিত্য চর্চা করে তারা না খেতে পেয়ে মরেছেন। তাদের মধ্যে শরৎবাবু, শিবরাম এবং আরও অনেক সাহিত্যিক।
সুশান্তবাবুর মতে জীবনে সাফল্য পেতে হলে সঠিকভাবে জীবন চর্চা, সঠিক চলার পথ নির্বাচন, সঠিক সময় নির্বাচন,সঠিক জ্ঞান অর্জন,সঠিক বন্ধু নির্বাচন এবং সব শেষে সঠিক জীবন সঙ্গীনী নির্বাচন।এই সব ভাগ গুলিতে একটু আধটু এদিক ওদিক হলে চলে, কিন্তু জীবন সঙ্গীনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সামান্যতম ভুল হলে জীবন একেবারে বরবাদ হয়ে যাবে।
তা এ হেন নীতিবাগীশ বাস্তববাদী সুশান্তবাবু চাকুরী জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। তিনি কিছুতেই হাঁটা চলা করতে পারেন না। হাঁটতে গেলেই মাথা ঘোরায়, শরীর টলমল করে, বুক ধড়পড় করে। সামান্য উত্তেজনাতে প্রান যায় যায় অবস্থা হয়। সুশান্তবাবু বিছানা নিলেন।জৈয়ষ্ঠ ছেলে গোপাল বাবাকে নিয়ে কলকাতার নার্সিং হোমে চিকিৎসা করালেন। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কঠিন ব্যাধি ধরা পড়লো। প্রেসার অত্যন্ত বেশী, লিপিড প্রোফাইলের সবগুলি বিভাগ অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এবং সব শেষে যেটা দুশ্চিন্তার বিষয় তা হলো হৃদয়ের কপাটিকার কার্যক্ষমতা ক্রমাগত লোপ পাওয়ার প্রবনতা। শল্য চিকিৎসার দ্বারা কৃত্রিম কপাটিকা না লাগালে অচিরেই জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
অজাতশত্রু সুশান্তবাবুর এই ব্যাধির কথা গ্রামে খুব তাড়াতাড়ি আলোর গতিতে রাষ্ট্র হয়ে গেল। শল্যচিকিৎসার অর্থাভাবে তা না করিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসার জন্য সুশান্তবাবু মনস্থ করলেন। ডাক্তার নিদান দিয়েছেন যে এখন ঔষধ সেবনের দ্বারা দুই তিন মাস থাকা যায়। কিন্তু তার পরে শল্য চিকিৎসা অত্যাবশ্যক। সুশান্তবাবু যেই না বাড়ি ফিরলেন অমনি গ্রামসুদ্ধ লোক বাড়িতে যাতায়াত করতে লাগলো।আত্মীয় স্বজনের আসা যাওয়াও অতি মাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হলো।বিশেষ করে সুশান্তবাবুর জ্যেষ্ঠা ভগিনী চারুলতাদেবী এমন করে সুশান্তবাবুর পায়ে এসে পড়লেন যে যেন আর কিছুক্ষনের মধ্যে সুশান্তবাবুর ভবলীলা সাঙ্গ হবে। অনেক কষ্টে চারুলতাকে সামলানো গেলেও কনিষ্ঠা ভগিনী অনসূয়াকে সামলানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠলো। অনসূয়ার কান্না দেখে চারুলতাদেবী পুনরায় কান্না জুড়লো। দুই বোনে মিলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো যে প্রতিবেশীরা মনে করলো যেন সুশান্তবাবু বোধহয় ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন। দিনের পর দিন সুশান্তবাবুর আত্মীয়দের আনাগোনা এত বাড়ল যে তাদের আপ্যায়ন করতে গিয়ে অর্থাভাবী সুশান্তবাবু ভবিষ্যতের সঞ্চয় ক্রমাগত কমতে লাগলো।
এবার শুরু হলো প্রতিবেশী আর বন্ধু বান্ধবদের উপদেশ বা পরামর্শ দেবার পালা।এখন সুশান্তবাবুর কি করা উচিত, কি করা উচিত নয় তার বিরাট ফর্দ বাতলাতে লাগলেন। যেমন সুশান্তবাবুর ঘনিষ্টতম বন্ধু অখিলবাবু বললেন-ভাই সুশান্ত, তুমি ভাই কলকাতার ডাক্তারদের একেবারে বিশ্বাস করবে না। ওরা ডাক্তার নয়, একেবারে ডাকাত। তোমাকে ধনে মেরে ফেলার পর প্রানে মেরে ফেলতে ওরা ওস্তাদ।তুমি বরং ভেল্লোর বা ব্যাঙ্গালোর ঘুরে এসো। সুধু যাতায়াতের কষ্ট হবে একটু। কিন্তু চিকিৎসা পাবে আমেরিকার মতো। যদি ইচ্ছা থাকে তো বলো। তাহলে আমার বড় ছেলেকে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলি। আর তুমি তো জানো ভাই, আমার বড় ছেলে আলাদা হয়ে গেছে আমার থেকে। এখন ও রাজমিস্ত্রির কাজ করে।রোজ ছ’শ টাকা মজুরী পায়। যে ক’দিন ও তোমার সঙ্গে থাকবে তুমি না হয় ওকে থাকা খাওয়া ছাড়া পাঁচ’শ টাকা করে দিও। এবার সুশান্তবাবু বললেন- সে তো বুঝলাম অখিলদা। কিন্তু আমার কাছে এখন টাকা কোথায় যে ব্যাঙ্গালোর যাবো! টাকার যে বড় অভাব ভাই! এবার অখিলবাবু বললেন-সে চিন্তা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি তোমার কথা ভেবে না হয় লাখ দু’য়েক টাকা ধার দিচ্ছি। বেশী সুদ দিতে হবে না।তুমি আমাকে মাসে শতকরা তিন টাকা করে সুদ দিলে হবে। শেষে সুশান্তবাবু বললেন-দেখি ছেলে বউয়ের সঙ্গে আলোচনা করে। তারপর, ]যা ঠিক হবে তাই করবো।
অখিলবাবু যাবার ঘন্টা দু’য়েক পর এলো অবিনাশবাবু। তিনি সুশান্তবাবুকে দেখে বললেন-একেবারে শরীরটা ভেঙ্গে গেছে দেখছি সুশান্ত। আমি তোমার ছেলের কাছে সব শুনেছি।সব শুনে অনেক চিন্তা করে দেখলাম যে তোমার এই রোগ এলোপ্যাথিতে সারবে না। তুমি বরং হোমিওপ্যাথিতে চিকিৎসা করাও।দিন কয়েক হয়তো কষ্ট হবে।কিন্তু একেবারে রোগের লেশ মেরে সুস্থ করে তুলবে। তুমি যদি বলো তো আমার জামাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি। ও এককজন হোমিওপ্যাথির গোল্ডমেডালিষ্ট হোমিও ডাক্তার। আমি ডাকলে ও নিশ্চয় তোমাকে দেখে যাবে ভাই। তা আমি কি আমার জামাইকে ডাকবো? সুশান্তবাবু শুয়েছিলেন। এবার পাশ ফিরে অবিনাশবাবুর উলটো দিকে মুখ ফিরে শুলেন।তারপর বললেন- ভাই অবিনাশ, তুমি এখন এসো। আমি বাড়িতে ছেলে বউয়ের সঙ্গে আলোচনা করে দেখি। যদি হোমিওপ্যাথি করাই, তাহলে তোমাকে খবর দেবো। এ কথা শোনার পর অবিনাশাবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন-”নিয়তি কেন বাধ্যতে” বলে উঠে পড়লেন।
সুশান্তবাবু সবে মাত্র জল খাবার সেরে উঠেছেন। এমন সময় এলেন পাড়ার মামাতুতো ভাই সুকুমারবাবু। তিনি সুশান্তবাবুকে দেখে বলে ফেললেন- একি শরীরের হাল হয়েছে সুশান্ত। আমি তোর বিষয়ে সব শুনে এখুনি ছুটে এসেছি।তোকে তো ভাই এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে যেতে দেওয়া হবে না। আমি যখন এসে গেছি তখন তোর কোন চিন্তা নেই। শোন সুশান্ত, আমি একটি এখন আমেরিকান সাপ্লিমেন্টারী ফুড এজেন্সিতে কাজ করছি।এইবার সুকুমারবাবু একেবারে ডাক্তারী বিদ্যায় প্রবেশ করে রোগাক্রান্ত সুশান্তবাবুকে অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজিতে জ্ঞান প্রদান করতে লাগলেন এবং এই বিদ্যার দ্বারা তিনি প্রমান করলেন যে কেবল আমাত্র সাপ্লিমেন্টারী ফুডের সাহায্যে মানুষের সব রকম ব্যাধি নিরাময় করা সম্ভব এবং তা তিনি সুশান্তবাবুর উপর প্রয়োগ করে প্রমান করে ছাড়বেন। তিনি এবার সুশান্তবাবুকে বললেন-ফুডের দাম একটু বেশী, কিন্তু তার অত্যাশ্চর্য গুনের কাছে তা কিছুই নয়।সব শুনে সুশান্তবাবু বললেন- সুকুমারদা, তোমার কথা হয়তো ঠিক। কিন্তু আমি তো এখন একটি ডাক্তারের কাছে ট্রিটমেন্টে আছি। তাই এখন তোমায় কিছু বলতে পারছি না। আমি বাড়িতে আলোচনা করে তোমায় জানাবো। এবার সুকুমারবাবু উঠলেন।যেতে যেতে সুকুমারবাবু বললেন, এমনিতে খুব দেরি হয়ে গেছে ভাই। আর দেরি করলে আমার কিছু করার থাকবে না। তখন কিন্তু আমায় দোষ দিও না। চলি তা হলে - বলে সুকুমারবাবু বিদায় হলেন।
অবশেষে সুশান্তবাবু হৃদয়ের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে নিজের সঞ্চিত অর্থ নিঃশেষ করে এবং একমাত্র কন্যার বিবাহ স্থগিত করে শল্য চিকিৎসা করে ব্যাধিমুক্ত হলেন।এখন সাত মাস অতিক্রান্ত হবার পর ডাক্তার সুশান্তবাবুকে অফিস যাবার ছাড়পত্র দিয়েছেন। এখন একমাত্র কন্যা বনানীকে অতি সত্বর অর্থ সংগ্রহ করে সুপাত্রস্থ করাই তার লক্ষ্য।
অফিসের পথে বের হয়ে আলোকিত নভমন্ডলের তেজ বিন্দুর দিকে তাকিয়ে কর যোড়ে বললেন-হে দিবাবকর, জীবনে কোন দিন সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে আসি নি। আমাকে আপনি আপনার শক্তির কিয়দংশ দান করুন যাত আমি আমার শেষ কর্তব্য কর্মগুলো সমাপন করতে পারি। তারপর ধীর অথচ বলিষ্ট পদক্ষেপে নতুন পথ চলা শুরু করলেন।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.