#সর্বং_সহা_হে_নারী_তোমায়_প্রনাম।

আমাদের অফিসের মাসি আজ দেখলাম ঝাঁট দিতে আসে নি। ব্যাপারটা এ রকম হওয়ার কথা নয়। উনি খুব দায়িত্ব জ্ঞান সম্পুর্ন মহিলা। উনি যেদিন আসতে পারবেন না, আগে থেকে আমাদের জানিয়ে দেন। কিন্তু কাল তিনি এরকম কিছু জানিয়ে যান নি। তাহলে এলেন না কেন? তাহলে কি অসুস্থ হলেন? নাকি বাড়ির অন্য কেউ অসুস্থ! কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন ঝাড়ুদার একদিন অফিসে না এলে এমন হয়তো কিছু এসে যায় না। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট চিন্তার কারন ছিল। উনি না এলে টেবিলে জল পাওয়া যায় না। সারাদিন প্রায় বিনা জলপানে দিন কাটাতে হয়। তাছাড়া আমাদের আরও অনেক ফাই ফরমাস খেটে দেন।ফলে অফিসের ঝাড়ু মাসি না এলে আমাদের চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে বই কি?
মাসির নাম সীতা। খুবই সহজ সরল সাদা মাটা মহিলা। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছর হবে। কথা বার্তায় শালীনতা বজায় রাখেন। স্বাভাবিকভাবেই খুবই গরীব বাড়ির মহিলা। স্বামী ভালো সাইকেল ভ্যানের মেকানিক। আগে ভালোই রোজগার করতেন। কিন্তু সর্বনাশা মদের নেশা আর জুয়া খেলার চক্করে সব কিছু খুইয়েছেন। এমন কি দোকানটিকেও খুইয়ে বসে আছেন। সংসার আর কিছুতেই যখন চলে না, তখন বাধ্য হয়ে সীতাদেবী বাইরে কাজে বেরিয়েছেন। কত দিন আর আধপেটা খেয়ে দিন কাটাবেন। যে স্বামী অগ্নিসাক্ষী করে শপথ করেছিলেন যে তিনি সর্বদা সহধর্মিনীর অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চিত ব্যবস্থা করবেন।কিন্তু তিনি যখন সে কাজে অকৃতকার্য হলেন,তখন নিজেকেই নিজের দায়িত্ব নেওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
তারপর থেকে সীতা মাসি পাড়ায় দু’খানা বাড়িতে বাসন মাজা ও জল দেওয়ার কাজ বেছে নিয়েছেন। সেই কাজগুলি শেষ হবার পর প্রায় দশটার সময় আসেন আমাদের অফিসে। আমাদের অফিসে কাজ সেরে প্রায় বারোটার সময় বাড়ি ফিরে গিয়ে নিজের বাড়ির কাজ কর্ম রান্না বান্না এবং খাওয়া দাওয়া সারেন। তারপর শুরু করেন বিড়ি বাঁধার কাজ।
ঈশ্বর যে নারীকে কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন তা বিধাতা নিজেই জানেন। এই পৃথিবীতে নারী সর্বদা সর্বং সহা। সে যতই বিদ্রোহীনি হোক না কেন, যতই স্বামী বিরোধী হোক না কেন স্বামী সেবায়, সংসার সেবায় এবং সন্তান পালনে তার আন্তরিক নিষ্ঠার অভাব থাকে না। আবার সে যতই দশভূজার মতো দশ হাত দিয়ে সংসার সামলান না কেন, কিছুতেই তার গরিমা পুরুষ অপেক্ষা বেশী গুরুত্ব পায় না। এখনও সমাজ তাকে ভোগ্য পন্য হিসাবে কু-নজরে দেখে।
প্রিয় পাঠকগন নিশ্চয় অতিষ্ঠ হচ্ছেন যে সীতা মাসির গল্প মাঝ পথে রেখে আমি কেনই বা নারীর মহিমা কীর্তন করতে অবতীর্ন হয়েছি। তার কারন এই যে সীতা মাসির স্বামী সংসার নামক গাড়ীকে টানতে তো পারেই না, উল্টে মাসির রোজগারের কিছু অর্থ মদের নেশায় উড়িয়ে দেয়। মাসি বুক পেতে তাও সহ্য করেন, কিন্তু স্বামীকে কিছুই বলেন না। কারন তিনি যে সর্বং সহা!
গতকাল ছিল ২৩শে পৌষ। একেবারে কনকনে ঠান্ডা। মাসি প্রতিদিনের মতো আজও তার স্বামী আসার অপেক্ষায় বাড়ির তক্তাপোষে বসে বিড়ি বাঁধছেন। স্বামী সুরাপান করে বাড়ি ফিরলে তাকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে তবেই শুতে যাবেন। কোন কোন দিন স্বামী ফিরতে দেরী করলে, না খেয়েই শুয়ে পড়েন। দেখা যায় পরের দিন সকালে স্বামীদেবতা বাড়িতে ফেরেন। সেই রকম ভাবে সেদিনও বারটা বেজে যাবার পরও যখন স্বামীদেবতা বাড়ি ফিরলেন না, তখন সীতা মাসি শুয়ে পড়লেন।
পরের দিন তিনি সকালে উঠে, পুকুরে এঁটো বাসন ধুতে গিয়ে মাসীর আত্মা খাঁচাছাড়া হলো। পুকুরে উপুড় হয়ে জলে ভাসছে কে? এ যে স্বামীদেবতা! সীতা মাসি হাউ মাউ করে কান্না জুড়লেন। প্রতিবেশীদের ডাকলেন। পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রায়ান্ধকার প্রাতঃকালে সীতা মাসির পোড়া কপাল দেখে প্রতিবেশীরা যারপর নাই মর্মাহত হলেন।
অফিসে সীতা মাসির না আসার কারণ জানার পর আমরাও কিছুক্ষন জড়ভরত হয়ে বসেছিলাম। আমি ঈশ্বরের কাছে মনে মনে প্রার্থনা করলাম- “হে ঈশ্বর যে নারীকে তুমি সর্বং সহা করে গড়ে তুলেছো, তাকে তোমার করুনা আর মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করো না”।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
৬ই ফেব্রুয়ারী,২০২০
দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.