#লে হালুয়া

শুক্রবার অফিস সেরে বাড়ির পথে। ১১৭নং জাতীয় সড়কের উপর বাস ধরবো। দাঁড়িয়েছি কামার হাটে। যাবো মদনগঞ্জ। প্রায় ১৯ কিলোমিটার পথ। চারদিন ছুটি আছে বলে অফিসের ল্যাপটপখানা নিয়েছি। কাছে দুটো ব্যাগ। একটি আমার দৈনিক ব্যবহারের।আর একটি ল্যাপটপের।
এখন নামখানার ব্রীজ হয়ে যাওয়ায় সরাসরি বকখালি যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। তিন রকম বাস পাওয়া যায়। অর্ডিনারি লাক্সারী বাস, অর্ডিনারী রাজ্য সরকারী বাস, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাজ্য সরকারী বাস। অনেকদিন ধরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চড়ার শখ ছিল। আজ সৌভাগ্যক্রমে সেই বাসটি পেয়ে গেলাম। দু’টো ব্যাগ নিয়ে লটর পটর করে উঠতে গেলাম। এমন সময় কন্ডাকটর বাবু জানালেন-”দাদা, দাঁড়িয়ে যেতে হবে। সিট নেই কিন্তু।” এক মূহুর্ত থমকে গেলাম। বেটা বলে কি! বাঙালী চাকুরীজীবি কবে বাবুয়ানি করে অফিসে গেছে বা বাড়িতে ফিরেছে! আমি উনার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। সকালে এক পশলা বৃষ্টির পরে চড়া রোদ হওয়ায় বিকালে বেশ গরম পড়েছিল। সারা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার। বাসের মধ্যে উঠে বেশ আরাম পেলাম। ব্যাগ দু’টো বাঙ্কে তুলে দিয়ে শ্রীগৌরাঙ্গ ভঙ্গীমায় দাঁড়ালাম।
এবার আমি বাসের যাত্রীদের দিকে তাকাতে লাগলাম। দেখলাম প্রায় বেশীর ভাগই বকখালির ভ্রমণ পিয়াসী। বাকি কিছু করোনা ভাইরাসের ভয়ে বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন। বাকি দু’চারজন স্থানীয় ব্যবসায়ী যাদেরকে আমি চিনি। বাসে আমি ছাড়া আর একজন দাঁড়িয়ে আছেন। বাকি সবাই কলকাতা থেকে সিট রিজার্ভ করে এসেছেন। এই সব দেখতে দেখতে কাকদ্বীপ পৌছে গেলাম। কাকদ্বীপ আসতেই জনা পাঁচেক উঠলেন। আমার মতো তাদেরও জানিয়ে দেওয়া হলো বাসে বসার সিট নেই। স্টেন্ডে অনেক লোক আছে, কিন্তু কেউই এ বাসে উঠলেন না। কিন্তু যারা উঠলেন এইমাত্র তাদের এই বাসে ওঠার মতো সামর্থ্য নেই। সে যাক গরীবেরও একদিন বিরিয়ানি খেতে ইচ্ছা হয়।
বাস কাকদ্বীপ ছেড়ে দিল। বাস যখন কালীমন্দির পেরিয়েছে, ঠিক তখনই নাকে একটি দুর্গন্ধ এসে ঠেকল। প্রথমে মনে হয়েছিল মাছ বাজারের মাছের গন্ধ। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারলাম এ গন্ধ উদরের প্রকুপিত বিক্ষুব্ধ দুর্গন্ধ বায়ুর গন্ধ। ততক্ষনে গন্ধ বাসের সকল যাত্রীকে আক্রান্ত করে তুলেছে। দেখলাম প্রায় সবাই নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বিকৃত মুখভঙ্গিতে কুঞ্চিত সন্দিগ্ধ চোখে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখের অভিব্যক্তি ক্রধোন্মোত্ত ঋষি দূর্বাসার মতো। আমি মরমে মরে যাচ্ছি। কিছু বলতেও পারছি না। তবু যদি শুধু আমাকে সন্দেহ করে আমার দিকে তাকালে আমি না হয় সহ্য করতাম। কিন্তু উনারা আমার গ্রামের চাষাভুষা মানুষগুলোকে সন্দেহ করছেন! আমি সব সইতে পারি। কিন্তু মাতৃভূমি,মাতৃ-দেশ এবং জন্মদাত্রীর অপমান সইতে পারি না। শহরের মানুষের চর্ম শ্বেত বর্ণের হওয়ায়, উদরে চপকাটলেট, চিকেনরোল, ফিসফ্রাই, চিলি চিকেন, বিরিয়ানি, চাউমিন ইত্যাদি খাবার পড়ে বলে উদরে দূষিত দূর্গন্ধ বায়ু উৎপাদিত কি হয় না? আর গ্রামের চাষাভুষা মানুষগুলোর চর্ম কালো আর পেটে শাক ভাত, রুটি এবং পান্তা পড়ে বলে ওখানে দুনিয়ার সবচেয়ে দূষিত দূগর্ন্ধ বায়ু উৎপাদিত হয়! এমন বিচার যে অন্যায়!
এমন সময় কন্ডাকটার বললেন- “ভাড়া দেন দাদা?”
-কাকদ্বীপ থেকে উকিলের হাট কত ভাড়া?
-তিরিশ টাকা।
-অ্যাঁ তিরিশ টাকা কেন? আমরা তো দশ টাকা দিয়ে যাই!
-সেটা সাধারণ বাস দাদা। এটা দেখছেন না এ সি বাস। এর ভাড়া তো বেশী হবেই। এ বাসের সবচেয়ে কম ভাড়া পঞ্চাশ টাকা।
- এবার শুরু হলো কন্ডাকটর আর ওই লোকটির সাথে ঝগড়া। ওরা সংখ্যায় আছে পাঁচজন। সাধারণ বাসে এলে খরচ হয় পঞ্চাশ টাকা। এ বাসে খরচ হবে দেড়’শ টাকা! ক’জন মানুষ আর সহ্য করবে। বেচারী বুঝতেও পারে নি কি বাসে উঠে পড়েছে! শেষে আশি টাকায় রফা হলো। তবে কন্ডাকটার টিকিট দিলেন না।
-ও দাদা, শুনছেন? আমি কন্ডাকটারকে ডাকলাম।
- কন্ডাকটার আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম-গরীব লোকগুলোর টাকা ক’টা দিতে পাঁজরার হাড় খুলে গেছে। কিন্তু আপনার তো একেবারে পোয়াবারো। পুরোটাই লাভ। শহরের উপর ঝাল ঝাড়ার এই এক সুযোগ পেয়েছি। একে নষ্ট করা যাবে না। এই মনে করে আমি যখন কমর বেঁধে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় কন্ডাকটর এসে আমার হাত ধরে বললেন- সবে চাকরী পেয়েছি দাদা। হাতের পয়সায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলে বেতনের আর বিশেষ কিছু থাকে না। তাই শেষের দিকে দু’একটা এমন করতে হয়। আপনি একটু দয়া করুন।
আমি খুব সহজ সরল একেবারে সাদা সিধে গ্রামের মানুষ। রাগ আমার বেশীক্ষন থাকে না। তারপরে কেউ হাতে ধরলে তো গলে একেবারে জল হয়ে যাবো। এক্ষেত্রেও তাই হলো। আমি কিছু বললাম না। ইতি মধ্যে আমার স্টপেজ এসে গেল। আমি কন্ডাকটরকে জিজ্ঞাসা করলাম- কামার হাট থেকে মদনগঞ্জ পর্যন্ত আপনার ভাড়া কত?
-আজ্ঞে সত্তর টাকা।
-আমি উনাকে সত্তর টাকা দিলাম। উনি আমাকে টিকিট দেওয়ার জন্য বিল মেসিন ধরতেই আমি বললাম- থাক টিকিট দিতে হবে না।
-টিকিট নেবেন না!
- একটি অন্যায়কে যখন মেনে নিয়েছি, তখন এটা মানতে অসুবিধা কোথায়?
- ভদ্রলোক কি ভাবলেন, জানি না। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে একটি কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন। তারপর বললেন- আবার আসবেন।
-আমি হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। দেখলাম ভদ্রলোক পাদানিতে নেমে এসে আমার দিকে হাত নাড়ছেন।
তখন রবি অস্তাচলে চলে গেছে। দোকানের বিজলীবাতিগুলি জ্বলে গেছে। হাল্কা অন্ধকার নেমে এসেছে ধরায়। সেই অন্ধকারের সমুদ্রে যন্ত্রদানবের পেটে কতকগুলো শহুরে লোক সমুদ্র দর্শনে অদৃশ্য হলো। হৃদয়ে শুধু একটাই ক্ষেদ থেকে গেল এই জন্য যে শহর আর গ্রামের দ্বন্দ্ব কোন দিন ঘুচলো না। শহর বলে সে বড়। তা সে গ্রামকে ঘৃনা করে। আর গ্রাম বলে যে সে বড়। তাই সে শহরকে অবজ্ঞা করে। বাস্তবে তারা যে একে অপরের পরিপূরক তা তারা কখনো বুঝতেই পারলো না।
কপিরাইট@তারাপদ-মাঝি
দেবনগর
দোলযাত্রা, ৯ই মার্চ ২০২০।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.