#আনাড়ী

জায়গাটির নাম ইশ্বরীপুর। ছোট্ট রুপসা নদীর পাড়ে অবস্থিত ছোট্ট একটি হাট যেখানে প্রতি শনি আর মঙ্গলবার হাট বসে। ইশ্বরীপুরের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ একমাত্র এই ইশ্বরীপুর থেকেই কলকাতা যাওয়া যায়। তাই এখানকার ধনী ব্যবসায়ীরা কলকাতা থেকে প্রচুর পন্য এনে নিজের গুদামে জমা করে রাখে। তারপর সেই পন্য তারা বিক্রয় করে পাশাপাশি নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, বকখালি, মৌসুমি, সাগর, এল প্লট, জি প্লট, রাক্ষসখালী, বুড়াবুড়ির তট, ভাগবতপুর প্রভৃতি দ্বীপ অঞ্চলে। আবার এই ইশ্বরীপুর ঘাটেই আছে সবচেয়ে বড় মৎস বিপনন কেন্দ্র। এখানেই গোটা সুন্দরবনের জেলেরা মাছ বিক্রয় করে। আবার রাক্ষসখালি,পাথর,মৌসুমি,নামখানা প্রভৃতি দ্বীপ অঞ্চলের উৎপাদিত কৃষিজ পন্য এই ইশ্বরীপুরেই পাইকারী বিক্রি হয়। মাছ আর কৃষিজ পন্য ট্রাকভর্তি হয়ে চলে যায় কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য শহরে। ফলে ইশ্বরীপুর একটি বড় পাইকারী এবং খুচরা ব্যবসায়ের পীঠস্থান হয়ে ওঠে। এখানে সবসময় মুটে মজুরের চাহিদা রয়েছে। কাজের সন্ধানে পাশের জায়গা থেকে লোকেরা এখানে মুটের কাজ করতে আসে। তাই সারাদিন সারারাত এখানে লোকজনের সমাগমে পরিপূর্ণ থাকে।
এখানে জনজাতির বিপুল বৈচিত্র দেখা যায়। সুন্দরবনের জঙ্গল কাটাই থেকে মেদিনীপুর, হাওড়া আর হুগলির লোকেরা এখানকার আদি অধিবাসী। তারপর ভারত ভাগ হবার পর বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে মানুষ এসে এখানকার মানুষের স্রোতে মিশে গেছে। তারা বেশীর ভাগই পূর্ববঙ্গীয়। এই পূর্ব বঙ্গীয়দের মধ্যে হিন্দু যেমন আছে, তেমনি মুসলমানও আছে। আস্তে আস্তে ইশ্বরীপুর হিন্দুদের কাছে থেকে মুসলমানদের হাতে চলে যায় অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্র হিন্দুদের হাত থেকে মুসলমানের হাতে চলে যায়। আস্তে আস্তে ইশ্বরীপুর হয়ে ওঠে মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য।
নদীর স্রোতে ভাসমান জঞ্জালের মতো একদিন দুই মেয়ে নিয়ে মেহেরুন্নেসা আর বকরুদ্দিন ভাসতে ভাসতে বাংলাদেশ থেকে ঈশ্বরীপুরে এসে কুলের নাগাল পেল। আস্তে আস্তে তারা নদীর পাড়ে ইরিগেশনের নয়ানজুলিতে মাচান করে তার উপরে পলিথিনের ঘর বেঁধে থাকতে শুরু করে। কাজের অভাব হলো না। মাছের আড়তে কাজ পেয়ে গেল বকরুদ্দিন। মেহেরুন্নেসা বাড়িতেই থাকে। গৃহস্থালীর কাজ কর্ম করে। মাছের আড়তে কাজ করে যা পায় তাতেই তাদের সংসার চলে যায় ভালোভাবে।
মেহেরুন্নেসা ভাবছিল বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসে তারা ভালোই করেছে। বাংলাদেশে রোজগারের কোন রাস্তাই ছিল না। কেবলমাত্র জনমজুরী করে যা পাওয়া যেত, তাতে সংসার চলে না। কতদিন যে আধপেটা করে খেয়ে থাকতে হয়েছে তার সীমা নেই। তাছাড়া তাদের অনেক পারিবারিক সমস্যা ছিল। বকরুদ্দিনের প্রকৃত নাম ছিল বাদল নস্কর। জাতে হিন্দু। কক্সবাজারে তার মাছের দোকান ছিল। তার দোকানে মাছ কিনতে গিয়ে বাদলের প্রেমে পড়ে যায় মেহেরুন্নেসা। বাদলকে ভারি সুন্দর দেখতে। মেহেরুন্নেসাও দেখতে খুব একটা ভালো নয়। তবে তার যৌবনের উদ্দামতা যে কোন পুরুষকে ঘায়েল করতে বেশী সময় লাগে না। শ্যামলা রং, মাথাভর্তি ঘন কালো কেশদাম, প্রায় ছ’ফুটের কাছাকাছি উচ্চতার সুডৌল দেহবল্লরী, পিনোন্নত সুদৃশ্য কুচযুগল, পটলচেরা ঘনকালো চোখ নিয়ে সুন্দরী না হয়েও অপার সৌন্দর্য নিয়ে সে একদিন বাদলকে ধরা দিল। বাদল মেহেরুন্নেসার প্রেমে পাগল। একদিন তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা ভারতে পালিয়ে এসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। কিন্তু সে চেষ্টা করতে গিয়ে তারা দু’জনে মেহেরুন্নেসার বাবা মহম্মদ আবুজেল মোল্লার হাতে ধরা পড়ে যায়। অনেক দাঙ্গা হাঙ্গামার পর বাদল তার পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে এবং নতুন নাম হয় বকরুদ্দিন নস্কর।
বকরুদ্দিনের সঙ্গে মেহেরুন্নেসার বিয়ে হলো বটে, কিন্তু তারা কেউই পিতৃ পক্ষ থেকে কোনরূপ বিষয় সম্পত্তি পেল না। অবশেষ তারা নিজেদের মতো করে নিজেদের গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হলো। চলে এলো মহানগর ঢাকাতে। ঢাকাতে লোকের বাড়িতে কাজ করে বকরুদ্দিন। এতে তাদের কোন রকম দু’জনের সংসার চলে যেত। কিন্তু যখন তাদের দু’টি যমজ কন্যা সন্তান হলো, তখন তাদের সংসার চালানো বেশ কঠিন হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে মেহেরুন্নেসা দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিবেশীর বাড়িতে কাজে যেতে লাগলো। আর তখনই ঘটলো তাদের বিপদ। প্রতিবেশী একজন পুরুষের লোলুপ দৃষ্টিতে আবদ্ধ হলো মেহের। তার শিকার থেকে বাঁচতেই বকরুদ্দিন ভারতে আসার প্ল্যান করে এবং অনেক কষ্টে নদীপথে ভারতে প্রবেশ করে ইশ্বরীপুরে আশ্রয় গ্রহন করে।
ভারতে এসে ঈশ্বরীপুরের মাছের বাজারে কাজ পেয়ে যায় বকরুদ্দিন। বেশ ভালো রোজগার হতে থাকে। ভারতের লোকজন বকরুদ্দিনকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে থাকে। ভারতে এসে বকরুদ্দিন আবার হিন্দুতে ফিরে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু মেহেরুন্নেসা তাতে বাধা দেয়। সে ইসলাম ধর্ম ছেড়ে কিছুতেই কাফের হিন্দুতে রুপান্তরিত হতে চাইলনা। এই নিয়ে বকরুদ্দিনের সঙ্গে মেহেরুন্নেসার গন্ডগোল হতে লাগলো। ঠিক এমন সময় মাছের আড়তদার জমিরুদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে মেহেরুন্নেসার পরিচয় হয়। জমিরুদ্দিনের মেহেরুন্নেসাকে খুব ভালো লাগে। সে আস্তে আস্তে মেহেরুন্নেসার পরিবারের মধ্যে প্রবেশ করে। অবশেষে মেহেরুন্নেসার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এতে বকরুদ্দিন অত্যন্ত রেগে যায়। তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। প্রতিদিন তাদের মধ্যে এতই বাগ বিতন্ডা হতে থাকে যে তাদের জীবন অতীষ্ট হয়ে ওঠে। সংসারের প্রতি এবং মেহেরুন্নেসার প্রতি বকরুদ্দিনের বিতৃষ্ণা বাড়তে থাকে। একদিন বকরুদ্দিনের মৃত দেহ ঈশ্বরীপুরের রুপসা নদীতে ভাসতে থাকে। মেহেরুন্নেসা এই বিদেশে দু’টি নাবালিকা নিয়ে একেবারে একলা হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে মেহেরুন্নেসা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করে। জমিরুদ্দিনের সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক থাকার ফলে জমিরুদ্দিনের থেকে আর্থিক, সামাজিক নিরাপত্তা পেতে থাকে। এখন মেহেরুন্নেসা পুরোদস্তুর সমাজের মহিলা গুন্ডায় পরিনত হয়েছে। তার শরীরের সৌন্দর্য্য হয়তো ছিল না। কিন্তু তার পুরুষ্টু এবং উন্নত কুচযুগল, বলিষ্ঠ চেহারা, লোভনীয় নিতম্ব এবং গভীর আঁখি যুগল যে কোন পুরুষকে কুপোকাত করতে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু শরীরের যত্ন না নিয়ে, মাছের আড়তে কায়িক শ্রম করতে করতে, পাড়ার নির্যাতিতা গৃহ বধূদের পক্ষে বিদ্রোহ করতে সে এখন বিদ্রোহীনি নারীতে পরিনত হয়েছে। তার সুন্দর মেহেরুন্নেসা নাম পালটে হয়ে গেছে “আনাড়ী” মহিলা। এখন কেউ তাকে বলে আনাড়ী পিসি, কেউ বা আনাড়ী মাসী, আবার কেউ বা ডাকে আনাড়ী বৌদি। অর্থাৎ যার যা সম্পর্ক আছে তার পূর্বে “ আনাডী” যুড়ে সম্বন্ধ সৃষ্টি করে।
সময়ের স্রোতে সময় বয়ে যায়। আনাড়ী সমাজে নিজের আধিপত্য আরো জোরদার করেছে। রাজনীতিতে প্রবেশ করে সে এক পরশ পাথর পেয়েছে। পঞ্চায়ের সদস্য হয়ে ঈশ্বরীপুরের ব্যবসাকে এখন আনাড়ী নিয়ন্ত্রন করে। যে জমিরুদ্দিন মেহেরুন্নেসাকে অর্থাৎ আনাড়ীকে শোষন করতো এখন সেই আনাড়ীকে রীতিমতো মাসিক তোলা দিয়ে তাকে মাছের ব্যবসা করতে হয়। এখন টোটো ইউনিয়ানের সেক্রেটারী, মাছের লরী ইউনিয়ানের সেক্রেটারী, মুটে মজদূর ইউনিয়ানের সেক্রটারী প্রভৃতি পদ অলংকৃত করে আনাড়ী অর্থাৎ মেহেরুন্নেসা।
অবশেষ একদিন জীবন সায়াহ্নে পৌছে যায় আনাড়ী। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। জামাইরা সবাই সুশিক্ষিত এবং অর্থশালী। তারা এখন আনাড়ীর আশ্রয়। খুব ভালোবাসে আনাড়ীকে। কিন্তু আনাড়ীর আর কিছুই ভালো লাগে লাগে না। এই জীবন সায়াহ্নে এসে বাদল ওরফে বকরুদ্দিনকে তার খুব মনে পড়ে। তার দিনের অধিকাংশ দিন কাটে রুপসা নদীর তীরে। একদিন সবাই দেখল রুপসা নদীর জলে বকরুদ্দিনের মতো আনাড়ীর নগ্ন শরীরটা ভাসছে।নদী থেকে মেহেরুন্নেসা কুলের কিনারা পেয়েছিল।কিন্তু সেই নদীর জলেই তাদের সমাধী হলো।
কপিরাইট @তারাপদ মাঝি
দেবনগর
৩০শে জানুয়ারী,২০২০।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.