সে বেইমানি করেনি

· 


সে বেইমানি করেনি
আমি তখন ডায়মন্ডহারবারের দিগম্বরপুর পঞ্চায়েতে চাকুরী করি৷ পঞ্চায়েতটি ডায়মন্ডহারবার ব্লকের এবং রাস্তার ধারে অবস্থিত৷ রাস্তা মানে ব্যস্ততম জাতীয় সড়ক৷ সবসময় রাস্তায় বিভিন্ন যানবাহন তীব্র গতিতে যাতায়াত করছে৷ আবার রাত বারোটার পর এই যানবাহনগুলির গতি মারাত্বকরকম বৃদ্ধি পায়৷ সুতরাং এখানে খুব সাবধানে রাস্তা চলাচল করতে হয়৷ একটু ওদিক হলেই দেয়ালে ছবি হয়ে যাবেন৷ যাইহোক এমনই এক রাস্তা থেকে প্রায় শ'ফুট দূরে আমার দিগম্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েত৷ 
তা এমনই এক পঞ্চায়েতে আমি সবেমাত্র সেক্রেটারী হিসাবে নিয়োগ পেয়েছি৷ আমার নাম অশোক দাড়িম্ব, বাড়ি কোচবিহার জেলার কোদালিয়া গ্রামে৷ গ্রামটি একেবারে বাংলাদেশ ঘেঁষা৷ তাই আমার কথায় কিছুটা বাংলাদেশী টান রয়েছে৷ আমি প্রথম যখন পঞ্চায়েতে কাজে যোগ দেই, তখন আমি অনেক চেষ্টা করেও বাড়ি ভাড়া পাই নি৷ ফলে থাকার দুশ্চিন্তায় ছিলাম৷ এমন সময় প্রধান মহাশয় আমার সমস্যার সমাধান করে দিলেন৷ তিনি আমায় জানালেন যে যতদিন না আমি ভাড়া বাড়ি পাচ্ছি, ততদিন আমি অফিসের একটি ঘরে থাকতে পারবো৷ আমি অনেকটা স্বস্তি পেলাম৷ 
এবার পড়লাম আর এক সমস্যায়৷ আমি খাবো কোথায়৷ কারন আমি নিজে রান্না করতে পারি না৷ অন্য কাউকে রাঁধুনি হিসাবে রাখলে আমার যে খরচ হবে তাতে আমার কিছু লাভ হবে না৷ কারন আমি যে বেতন পাবো তাতে আমার এখন খাওয়া খরচ, রাঁধুনি খরচ, বাড়ি যাতায়াত খরচ,হাত খরচ আর আকস্মিক খরচ বাদ দিলে কিছুই থাকবে না৷ তাহলে বাড়িতে সন্তান আর বউ এর কাছে পাঠাবো কি! অফিসে থাকলে তবু বাড়ি ভাড়াটা বাঁচবে৷ যেদিন ভাড়া বাড়িতে উঠে যাবো, সেদিন থেকে বাড়ি ভাড়ার মোটা টাকা খরচ বাড়বে৷ তাহলে হাতে আর থাকবে কি! অফিসে থাকাও কতকগুলো সমস্যা আছে৷ প্রথমত অফিস টাইম ছাড়া অন্য সময়েও প্রধানের ঝক্কি ঝামেলা ঘাড়ে এসে চাপবে৷ তাছাড়া এতবড় অফিসে একা থাকা যথেষ্ট ভয়ের ব্যাপার রয়েছে৷ আমি সে কথা অর্থাৎ ভয়ের কথা প্রধানকে জানালাম৷ প্রধান বললেন- “দাঁড়ান দাড়িম্ব বাবু,আমি আপনার জন্য কি করতে পারি দেখি”৷ এরপর তিনি তাদের নাইটগার্ড বিকাশ কোলেকে বললেন- “ শোন বিকাশ, তুমি আর অশোক দাড়িম্ব মানে আমাদের সেক্রেটারী একসঙ্গে একই ঘরে থাকবে৷ আর তুমি প্রতিদিন তোমার বাড়িতে খেয়ে আসার সময় দাড়িম্ব বাবুর জন্য তোমার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসবে৷ তাহলে তোমারও দুটো পয়সা হবে আর দাড়িম্ববাবুও সমস্যা থেকে বাঁচবেন”৷ 
প্রধানবাবুর কথা শুনে আমিতো আহ্লাদে আটখানা৷ ভাবছিলাম বিকাশ রাজি হবে কি না৷ কিন্তু বিকাশ রাজি হয়ে যাওয়ায় আমার আপাতত কোনো সমস্যা রইলো না৷ তো আমার যখন পঞ্চায়েতে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল, আমি হোটেল ছেড়ে পঞ্চায়েতে বিছানাপত্র নিয়ে হাজির হলাম এবং প্রধানের দেওয়া ঘরে থাকতে শুরু করলাম৷ প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় বিকাশ বাড়ি থেকে খেয়ে আসে আর আমার জন্য খাবার বয়ে আনে৷ 
সেদিন ছিল রবিবার৷ অফিসের প্রচুর কাজের চাপ ছিল৷ তাই এসপ্তাহে আর বাড়ি যাই নি৷ অফিসেই থেকে গেছি৷ ভেবে দেখলাম যদি শনিবার আর রববার অফিসে থেকে গেলে পড়ে থাকা কাজগুলো আমি অনায়াসে সেরে ফেলতে পারবো৷ রবিবারে সন্ধ্যার পর কাজে বসতে বুঝতে পারলাম কাজগুলো সারতে প্রায় এগারোটা বাজবে৷ বিকাশ স্থানীয় ছেলে হওয়ায় সে আমাকে কাজ করতে দেখে দোকানে আড্ডা দিতে চলে গেল৷ যাওয়ার সময় গেটে চাবি দিয়ে বেরিয়ে গেল৷ কারন প্রথমত আমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নাই৷ রাত প্রায় সাড়ে এগারটার সময় বিকাশ অফিসে এলো এবং আমার মিল ক্যারিয়ার নিয়ে বেরিয়ে গেল৷ আমি তখন সবেমাত্র কাজ সেরে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বসেছি৷ 
খাবার না আসা পর্যন্ত আমি টিভি চালিয়ে দিলাম৷ ভালো একখানা ইংলিশ ছবি দেখতে লাগলাম৷ ছবিটা সবেমাত্র শুরু করেছে৷ বেশ ভালো বই৷ আমি সিনেমার নেশায় মগ্ন হলাম৷ ছবিটা যখন শেষ হলো তখন দেখি ঘড়িতে প্রায় সোয়া বারোটা৷ আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো৷ কারন বিকাশ এখনো খাবার নিয়ে এলো না৷ সাধারনত বিকাশ এমন করে না৷ বেশ বিশ্বাসী ছেলে৷ দেরী হলে ফোন করে জানিয়ে দেয়৷ কিন্তু আজ ফোন তো করলো না, উপরন্তু অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলো! 
এবার আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ বাড়িতে কোন অসুবিধা হয় নি তো? বাড়ীর কারো অসুখ বিসুখ করে নি তো? কিন্তু সে হলে তো বিকাশ জানিয়ে দিতোই! তাহলে বিকাশের নিজের কিছু হলো না তো! আমি আর থাকতে না পেরে বিকাশকে ফোনে ধরতে চেষ্টা করলাম৷ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া গেলো না৷ যতবার ফোন করি ততবার জানায় যে ফোন সুইচ অফ আছে!
এদিকে খিদেয় আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাওয়ার অবস্থা৷ অনোন্যপায় হয়ে আমি মুড়ি আর চানাচুর মিশিয়ে খেতে শুরু করলাম৷ প্রায় পৌনে একটার সময় বিকাশ এলো৷ এসে দুঃখ করে বললো-“ স্যার বাড়িতে খুব অসুবিধা হয়ে গেছে৷ তাই আজ রান্না হয় নি৷ আপনি আজ কষ্ট করে একটু মুড়ি খেয়ে নিন৷ কালকে আপনাকে ভালো খাওয়া দেবো৷ দয়াকরে আজকের অসুবিধার জন্য ক্ষমা চাইছি”৷ 
আমি রাগলাম না বা ওকে কিছু বললাম না৷ হয়তো ওর কোনো অসুবিধা হয়েছে যা আমাকে জানাতে পারছে না৷ হয়তো বাড়ির হোম মিনিষ্টার রেগে গেছে৷ কিংবা হোম মিনিষ্টারের সঙ্গে কোনো রকম ঝগড়া হয়েছে৷ বেচারা লজ্জায় আমাকে কিছু বলতে পারছে না৷ আমি শুধু ওকে বললাম –“ আমি কিছু মনে করিনি৷ মনে করার কোনো কারন নেই৷ এরকম এক-আধদিন হতে পারে৷ তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো”৷ এই বলে আমি শুতে শুতে বললাম-“ তুমি চিন্তা করো না ভাই৷ এখন ঘুমিয়ে পড়ো৷ কাল অনেক কাজ আছে৷ তোমায় অনেক ধকল নিতে হবে৷ তাই এখন বিশ্রাম নাও”৷ 
আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আমি জানি না৷ ঘুম যখন ভাঙলো তখন সকাল ছ'টা৷ ঘুম থেকে উঠে দেখি বিকাশ খাটে নেই৷ ভাবলাম আজ ওর অনেক কাজ৷ তাই আগেই কাজে বেরিয়ে গেছে৷ ব্রাশ করতে করতে গ্রিল গেটের কাছে গিয়ে দেখি গেটে বাইরে থেকে চাবি দেওয়া! এরকম তো কখনো হয় না! ও চাবি দিয়ে গেলে আমাকে জানালা দিয়ে চাবি দিয়ে যায়৷ আজকে কেনো দিল না তাই ভাবছি৷ কাল থেকে বিকাশকে বেশ খানিকটা অচেনার মতোই লাগছে৷ কি হয়েছে ভেবে পাচ্ছি না৷ 
সকাল ন'টা বাজলো৷ তখনও বিকাশ এলো না৷ বাধ্য হয়ে আমি তাকে ফোন করলাম৷ কিন্তু কালকের মতোই সুইচ অফ জানাচ্ছে! কি হলো রে বাবা৷ এদিকে দশটার আগে আমাকে সেভ হতে হবে৷ আমি বাধ্য হয়ে প্রধানকে ফোন লাগালাম৷ বললাম – প্রধানসাহেব একটু অফিসে আসবেন?
-কেন? 
-আমি অফিসে শনিবার থেকেই আছি৷ আমার হাতে অনেক কাজ বকেয়া থাকায় এ সপ্তাহে আর বাড়ি যাই নি এবং আপনাকেও জানাই নি৷ কারন আপনি তখন অফিসে এসে বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতেন৷ তখন আমি অফিসের কাজগুলো করতে পারতাম না৷ তাই আপনাকে জানাই নি৷ 
-তা এখন জানাচ্ছেন কেন?
- জানাচ্ছি এই জন্য যে বিকাশ আমায় ভিতরে চাবি দিয়ে সকালে বেরিয়ে গেছে৷ আমি সেভ করাতে যাবো৷ বেরতে পারছি না৷ আপনার কাছে তো একখানা চাবি আছে৷কোনো লোকের দ্বারা চাবিটা যদি পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে দাড়িটা সেভ করতে পারতাম৷ 
-বিকাশ আপনাকে চাবি লাগিয়ে দিয়ে গেছে?
-হ্যা৷ 
-আপনি ঠিক বলছেন যে বিকাশ আপনাকে আজ চাবি লাগিয়ে দিয়ে গেছে!
-আজ্ঞে হ্যা, বিকাশই৷ আমার সঙ্গে যেমন থাকে তেমনই রাতে আমার কাছে ছিল৷ সকালবেলা বেরিয়ে গেছে৷ তবে যাওয়ার সময় আমার সঙ্গে দেখা করে যায় নি৷ 
-আচ্ছা, আমি নিজে আসছি৷
কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রধানসহ বেশ কয়েকজন এলো৷ তাদের সঙ্গে বসে বিকাশ সম্পর্কে অনেক আলোচনা হলো৷ বিকাশের কথা শুনে আমার চোখ কপালে উঠেছে৷ জানলাম যে রবিবার দিন রাত সাড়ে দশটার সময় বিকাশ আমার জন্য খাবার আনতে বেরিয়ে যায়৷ যাওয়ার সময় সে সাইকেলে গিয়েছিল৷ তার বাড়িতে ঢোকার রাস্তার মোড়ে একটি লরি সাইকেল সমেত বিকাশকে পিষে দিয়ে যায়৷ তার মোবাইলটা পর্যন্ত গুঁড়ো হয়ে গেছে৷ এসব কথা শুনে আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার অবস্থা৷ আমাকে সবাই বার বার প্রশ্ন করতে লাগছিল বিকাশ সত্যি সত্যি আমার কাছে রবিবার রাতে শুয়েছিল কিনা৷ আমি জোরের সঙ্গে হ্যা বলায়,সবাই অবাক হয়ে যায়৷ 
আমি প্রধান সাহেবকে তাড়াতাড়ি একখানা ভাড়া বাড়ি খুঁজে দিতে অনুরোধ করলাম৷ অবশেষে ঠিক হলো যতক্ষন না ভাড়াবাড়ি পাওয়া যায় ততদিন প্রধানের বাড়িতে আমি থাকবো৷ 
এই ঘটনার চার বছর পর আমি ঐ পঞ্চায়েত থেকে বদলী হয়ে মৌখালি গ্রাম পঞ্চায়েতে চলে যাই৷ কিন্তু এখনো বিকাশের স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে৷ ছেলেটা মরে গিয়েও তার কর্তব্যে অবহেলা করে নি৷আজ বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে এসে যত এই স্মৃতিগুলো রোমন্থন করি ততই অবাক হয়ে যাই৷ ছেলেটা প্রান যাওয়ার পরেও তার কর্তব্য পালন করলো৷ অথচ তার পেনশানসহ প্রাপ্য টাকাগুলো তার স্ত্রীকে পাইয়ে দিতে দু'বছর লাগলো আর পাঁচ হাজার টাকা পুষ্পাঞ্জলি দিতে হলো৷ ভগবান ওর আত্মাকে তুমি শান্তিতে রাখো৷ 
কপি রাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর
২৩/০৮/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.