দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়ি

দক্ষিনেশ্বর কালীবাড়ি
কলকাতা
১২/০৩/২০১৮
প্রিয়তমাষু কল্যানী,
পত্রে তোমার প্রতি রইলো আমার শুভকামনা। না ভালোবাসা জানালাম না। কারন তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা একেবারে ফুরিয়ে গেছে। এমন কি সন্তানের প্রতি ভালোবাসাও আর নেই। তাই তোমাদের কাছ থেকে আমি এখন শ' কিলোমিটার দুরে। ভেবেছিলাম তোমাদের ছেড়ে আলোকবর্ষ দূরে সরে যাই। কিন্তু পারলাম না। তাই আপাতত তোমাদের সঙ্গ ত্যাগ করলাম।
খুব হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আর পারছিলাম না। প্রতিদিন তোমাদের আবদার মিটাতে গিয়ে আমি আমি নিজেকে শেষ করে দিচ্ছিলাম।কিন্তু বিনিময়ে তোমরা আমাকে কি দিলে তাই হিসেব করতে গিয়ে দেখি পাওয়ার হিসেব শূন্য। আমার পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ভালোবাসা, আমার আশা আকাঙখা, এমনকি আমার ভবিষ্যত তোমাকে আর সন্তানদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলাম। বিনিময়ে চেয়েছিলাম শুধু একটু ভালোবাসা। কিন্তু পেয়েছি শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা।দিনের পর দিন তোমার আর সন্তানদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চাহিদা আমি যথাসাধ্য মিটিয়ে এসেছি। অথচ আমি মানুষটা কিভাবে সেই কাজটা করছি, সেটা কোনোদিন খোঁজ নাওনি বা খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করনি। ফলে আমার মেহনতের পয়সা নষ্ট হয়েছে দেখে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি।
খুব মনে পড়ে তখন আমরা খেতে পেতাম না। পাড়ার ধনী লোকেদের বাড়ি থেকে ফ্যান কিংবা পান্তা চেয়ে খেয়ে বড় হয়েছি। কখনো শুধু প্রাকৃতিক শাকশব্জি খেয়ে জীবন ধারন করেছি।তবু কোনদিন বাবা মাকে অবহেলা অবজ্ঞা করিনি বা অবজ্ঞা করতে শিখিনি। তাদের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছি। কখনো তাঁদের মুখের উপর সওয়াল-জবাব করিনি।তাদের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। চোখের উপর চোখ রেখে কথা বলার ভাবনা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু আমাদের সন্তানরা সেই কাজগুলি অনায়াসে করে এবং তুমি তাদের খুব প্রশ্রয় দাও ,কখনো কখনো তাদেরকে ইন্ধন দাও যাতে সন্তানদের দ্বারা আমি লাঞ্চিত হই এবং এতেই তোমার আনন্দ বেশী।
খাদ্য ভগবানের দান। ভগবান চাইলে মানুষ খাদ্য পায়, তিনি না চাইলে খাদ্য থাকলেও খেতে পাবে না। বাল্যে যাদের কাছ থেকে ফেন চেয়ে খেয়েছিলাম, আজ তারা খেতে পায় না।দুটো ভাতের জন্য তাদেরকে এখন অপরের কাছে ভিক্ষে চাইতে হয়। যখন তাদের ভাতের অভাব ছিল না তখন তারা ভাত নিয়ে গরুকে খাইয়েছে, বা পুকুরে ছড়িয়ে মাছকে খাইয়েছে। অথচ আমরা ফেন চেয়ে ফেনই পেয়েছি। দু'মুঠো ভাত পাই নি।কখনো কখনো গরুকে খাওয়ানোর অজুহাতে আমাদের ফেন দিত না। আজ ভগবান তাদেরকে খাদ্য থেকে বঞ্চিত করে তার শাস্তি দিচ্ছেন।তাই আমি তোমাকে বার বার ভাত নষ্ট করতে না বলেছি। কিন্তু তুমি আমার কথা কানেই তোলো না। তুমি এবং আমাদের সন্তানরা যখন ভাত নষ্ট করে আস্তাকুড়ে ফেলে দাও, তখন বুকটা আমার মোচড় দিয়ে ওঠে।অনেক লড়াই করে আজ এই জায়গাতে এসেছি সন্তানদের মানুষ করবো বলে। কিন্তু দেখলাম তারা কোনদিন মানুষ হবে না। তাই একসময় তাদের নিয়ে আশা আকাঙখার জাল বোনা ছেড়ে দিলাম। বাকি ছিলে তুমি। দেখলাম তুমিও সন্তানদের দলে গিয়ে মিশেছো। আমার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে আমাকে তোমার হাতের পুতুল বানাতে চাও। কিন্তু আমি তোমার হাতের পুতুল হতে চাই নি। খুব দুঃখ হয় যে তুমি কোন দিন আমায় ভালোবাসো নি। আমি শুধু তোমার কামনার শয্যা সঙ্গিনী।আমি শুধু তোমার শরীরটাকে পেয়েছি! মন বা হৃদয় পাই নি! যেদিন এটা বুঝলাম সেদিন প্রথমে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম সেটা অজ্ঞানীর মতো কাজ হবে। এতো লড়াই করে আজ যে জায়গায় পৌছেছি সেটা নষ্ট করে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়ার কোন যুক্তি নেই। তাই আমি প্রবজ্যার বৃত্তি গ্রহন করলাম।
এখন চাকুরী থেকে ভলানটারী রিটায়ারমেন্ট নিয়েছি মাস ছয়েক আগে।আমার পি এফ, গ্রেচুইটি, রিটায়ারমেন্ট এর টাকা মিলিয়ে মোট চল্লিশ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। তার সবটাই রামকৃষ্ণ মিশনকে দান করে দিয়েছি। এল আই সি থেকে যে টাকা পাওয়া যাবে তাতে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। এল আই সি অফিসে গিয়ে উকিল দিয়ে সব সার্টিফিকেটগুলো দুই মেয়েদের নামে ট্রান্সফার করে দিয়েছি। আশা করি কোন অসুবিধা হবে না।
দুই ছেলের জন্য কিছুই রাখলাম না। আমাকে আমার বাবা কিছুই দেন নি। তা সত্বেও আমার সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে কষ্ট হয় নি। তাই ওদের কিছু দিলাম না। পারলে নিজের চেষ্টায় মাথা তুলে দাঁড়াক। নইলে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাক।আমাকে কষ্ট করে পড়াশুনা করতে হয়েছিল। কিন্তু ওদেরকে তো আমি গ্র‍্যাজুয়েড করে দিয়েছি। বাকি রইলে তুমি। তোমার প্রতি কোন মায়াস মমতা বা ভালোবাসার টান নেই। কেবল অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করেছি। তাই তোমার ভরণপোষনের দায় আমার উপর বর্তায়। আমি যে পেনশান পাবো তার থেকে মাসে মাসে তোমার জন্য পাঁচহাজার টাকা করে পাঠাবো। ওতেই চালিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া মাঝে মাঝে বাপের বাড়ির সম্পত্তির গর্ব করতে। এখন দেখি তোমার বিপদের দিনে তোমার ভাইয়েরা কিভাবে তোমার পাশে দাঁড়ায়।
আমার মোবাইলটি আলমারিতে আছে। তুমি যাকে খুশি দিতে পারো। আজ রবিবার দক্ষিনেরশ্বর কালীবাড়ির অথিতিশালায় আছি। কাল হাওড়া রামকৃষ্ণ মঠে যোগ দেবো। তারপর দু' একদিন পর সেখান থেকে ভারত ভ্রমনে বের হবো। আমাকে খুঁজবে না বা যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। মনে করবে আমি এখন তোমাদের কাছে মৃত। মনে করলে তুমি আমার অন্তেষ্টিক্রিয়াও করতে পারো।
আর কি? এখানেই শেষ করলাম।
ইতি
এক হতভাগ্য স্বামী ও পিতা।
দাস পরিবারে এরকম ঘটনা যে ঘটিবে তাহা পাড়ার কেহ কল্পনাও করে নাই। সকলে সব কথা শুনিয়া সবাই বংশীগোপাল দাসের পত্নীকে দুষিল। কেহ বা পুলকিত হইয়া কিত্রিম ক্ষোভ প্রকাশ করিয়া বংশীগোপালকে দুষিল। দুই ছেলে অরুন আর বরুন অত্যন্ত মর্মাহত হইয়া বসিয়া কি যেন ভাবিতে লাগিল।
তারাপদ মাঝি,
২৬/০৭/২০১৮
সরবেড়িয়া।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.