নীচডাগলা খসে,উপর ডাগলা হাসে, নীচডাগলা বলে,"তোরও একদিন এইদশা হবে"

নীচডাগলা খসে,উপর ডাগলা হাসে,
নীচডাগলা বলে,"তোরও একদিন এইদশা হবে"



প্রত্যেক বাঙালীর নিকট উদ্ধৃতাংশটি প্রকটভাবে পরিচিত এবং বাঙালী মাত্রেই প্রয়োজন অনুযায়ী উদ্ধৃতাংশটি ব্যবহার করিয়া থাকেন।উদ্ধৃতাংশটির অর্থ প্রায় বাঙালী মাত্রেই অবগত আছেন, তথাপি আমি ইহার অর্থ আপনাদের জানাইতেছি। বাক্যাংশটির অর্থ ভালোভাবে মর্মার্থ গ্রহন করিতে হইলে একখানা তালগাছকে উদাহরন হিসাবে গ্রহন করিলে অতি উত্তম হইবে।যখন উক্তগাছের নীচের ডাগলা প্রকৃতির নিয়মে বয়ো:প্রাপ্ত হইয়া মৃতপ্রায় হয়, তখন সেই গাছ হইতে বিদায় নেয়। কখনো বা গৃহস্থ তার প্রয়োজনে গাছের নীচের ডাগলা কাটিয়া তাহার প্রয়োজন মিটাইয়া থাকে। উপরের ডাগলার উপরে কোনরকম আঘাত আসে না, তাহা সে প্রকৃতির নিকট হইতে হউক কিংবা গৃহস্থ মানুষের নিকট হইতে হউক।
সমাজে বৃদ্ধ মানুষের অবস্থা তালগাছের ওই নীচের ডাগলার মতো।তাহার উপর মানুষের দৈহিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের শেষ থাকে না।বাড়িতে সকালে উঠিয়া মনের সুখে যে বৃদ্ধ মানুষটা দুদন্ড অবসর যাপন করিবেন তাহার উপায় নাই। বাছানা ছাড়িবার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে বাজারের থলে ধরাইয়া দেওয়া হয়।বৃদ্ধ মানুষ।ফলে সি পি ইউ এর মেমোরি একেবারে তলানীতে গিয়া ঠেকিয়াছে। ফলে বাজারের টাকার হিসাবের গরমিলতো হইবেই।তখন নিজের মানুষ সমেত ছেলে, বউমা,নাতি - নাতনী সবাই পিছনে লাগিয়া যায়। অথচ এতদিন যে মানুষটা নিজের জীবনটা মাটি করিয়া সংসারের জন্য প্রানপাত পরিশ্রম করিয়া সংসারতরণীকে পার করিয়া দিল, তাহার হিসাব কেউ করিয়া দেখে না।তাহার অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা ছেলেটা মানুষ হইয়াছে,নিজের জমানো টাকা লইয়া ছেলেটা উৎকোচ প্রদান করিয়া চাকুরি ক্রয় করিয়াছে,কিংবা নাতি-নাতনীর আবদার মিটাইবার জন্য টিফিনের পয়সা বাঁচাইয়া তাহাদেরকে প্রদান করিয়াছে সে হিসাব কেউ করিয়াও দেখে না। আজ মানুষটি বৃদ্ধ হইয়া উৎপাদন ক্ষমতা হারাইয়া ফেলিবার সঙ্গে সঙ্গে সে আজ সংসারের আবর্জনায় পরিনত হইয়াছে। সে কখন মরিবে তাই সংসারের ছেলে বউয়ের কাছে একমাত্র সাধনা হইয়া থাকে।ঝরা ডাগলার মতো তাহাকে উনানে ঢুকাইয়া শেষ শক্তিটুকু নিঙড়াইয়া লইয়া তাহাকে শেষ করিতে পারিলেই শান্তি পাইবে।
ছেলেরা একবারও ভাবিয়া দেখিল না সেই দিনগুলির কথা! তখন ছেলেটির আধো আধো বুলি ফুটিয়াছে। বাবার হাতধরিয়া বিদ্যালয়ে গিয়াছে, রাত্রিতে বাবার কাঁধে চড়িয়া যাত্রা দেখিতে গিয়াছে। কিংবা কাঁধে চড়িয়া রথের মেলা হইতে বাড়ি ফিরিয়াছে।হয়তো বা চিড়িয়াখানা,যাদুঘর,নিকোপার্ক,সায়েন্সসিটি,বটানিক্যাল গার্ডেন,দীঘা, পুরী, বকখালী প্রভৃতি জায়গায় ঘুরিয়াছে। সেই ঘটনা এখন ছেলের কাছে অতীত হইয়া গিয়াছে। কারণ এখন যে তাহার কোন উৎপাদনশীলতা নাই।তাই বুড়ো এখন তালগাছের নীচডাগলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অথচ আমাদের নীতিশাস্ত্রে সন্তানের এইরকম আচরণ কখনো সমর্থন করে নাই। আমরা যদি আমাদের অতীতকে পর্যবেক্ষণ করিয়া থাকি তাহা হইলে বেশ কতকগুলি চরিত্রের সন্ধান পাইব যাহারা পিতামাতার প্রতি অসীম কর্তব্য স্থাপন করিয়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়া গিয়াছেন।যেমন অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্র। ইনি মাতাকে দেওয়া পিতার বাকদান পালনের জন্য দ্বাদশ বৎসর অরণ্যে কাটাইয়াছেন।যেমন রাজা যযাতি। ইনি পিতার অনুরোধে পিতার জরারোগ গ্রহন করেছিলেন।ফলে যযাতি মাত্র বিংশ বছরে শতবছরের বার্ধক্যদশা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।যেমন ভগীরথ।ইনি পিতাসহ অন্যান্যদের উদ্ধারের জন্য প্রানপাত তপস্যাকরে মা গঙ্গাকে তুষ্ট করিয়াছিলেন এবং গঙ্গার প্রবাহ দ্বারা তাহার বংশ উদ্ধার করিয়াছিলেন।যেমন ভীস্মদেব। ইনি পিতার জন্য বৈমাত্রেয় ভাইদের জন্য আমৃত্যু বিবাহ করেননি।যেমন পঞ্চপাণ্ডব।যাহারা মাতার কথা অবহেলা না করিয়া অন্যায় কার্য্য বুঝিয়াও পাঁচ ভাই মিলিয়া পাঞ্চালীকে বিবাহ করিয়াছিলেন।যেমন অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধু। ইনি তাহার চলচ্ছক্তিহীন পিতামাতাকে বাঁকে করিয়া বহন করিতেন এবং তাহাদের সেবাসুশ্রুষা করিতেন। আরও খুঁজিলে অনেক উদাহরণ পাওয়া যাইবে, কিন্তু আধুনিকযুগে অনুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়া দেখিলেও এমন কোন সন্তানের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে না যিনি পিতামাতার কথার প্রতিবাদ না করিয়া তাহা গ্রহন করিয়াছেন।
কথায় বলে নারীচরিত্র দেবতাও বুঝিতে পারেন না।সুতরাং সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে তাহা কিছুতেই বুঝিবার নয়। আমার এই কথা বলিবার যথেষ্ট হেতু রহিয়াছে। পুত্রেরা অনেকক্ষেত্রে পিতামাতার সেবাযত্ন করিতে চাহিলেও স্ত্রীরা অর্থাৎ নারীজাতি তাহাতে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়। আমার এই বক্তব্য শুনিয়া নারীজাতিমাত্রেই কুপিত হইতে পারেন। কিন্তু ইহাই সত্য।আজকাল যেসমস্ত আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মান হইতেছে তাহার অধিকাংশটাই "ঘর ঘর কি কাহানী" ধরনের। বধুরা এইসমস্ত চলচ্চিত্র দেখিয়া নিজ সন্তান দিগকে কর্ণধারণ করিয়া জানাইয়া দিতেছে যে বৃদ্ধকালে তাহারা যেন চলচ্চিত্রের বৃদ্ধবৃদ্ধার মতো অবহেলিত না হন। অথচ নিজেরা যে নিজেদের শ্বশুর শাশুড়ীকে অবহেলা করিতেছে, তাহা একবারও ভাবিয়া দেখে নাই।এইভাবে পরম্পরা চলিতে থাকে।নারীদের দুমুখো নীতি পুরুষদের খুব অবাক করিয়া তোলে।নিজের ছেলে যদি তাহার বউয়ের কোন কাজ করিয়া দেয়,তাহা হইলে মায়ের গাত্রদাহ হইতে থাকে। পাড়ার কাহাকেও কাছে পাইলে মা দু:খ করিয়া বলে, "আমার ছেলেটা হয়েছে বউয়ের ভেড়া। বউয়ের কথায় ওঠে আর বসে"।আবার ওই পড়সির কাছে মা গর্ব করিয়া বলে," আমার জামাইয়ের মতো ছেলে হয় না।জামাই আমার মেয়ের কথার একদম অবাধ্য হয় না। সাত জন্ম গেলে তবে এমন জামাই পাওয়া যায়"। এবার আপনিই বলুন নারীর চরিত্র বোঝা খুব শক্ত কি না। অথচ আদর্শ নারীর উদাহরণ খুব কম নাই।সীতা মাইয়া। রাজৈর্শ্বয্য ত্যাগ করিয়া স্বামীর সঙ্গে বনবাসে গিয়াছিলেন। সতী সাবিত্রী। যিনি স্বামীর প্রানের জন্য যমরাজের সঙ্গে বাগযুদ্ধে অবতীর্ন হইয়াছিলেন।সতী বেহুলা। যিনি স্বামীর প্রানের জন্য স্বর্গে ইন্দ্রের সভায় নৃত্য পরবেশন করিয়াছিলেন। এতো দুরবীন দিয়ে দেখা চরিত্র হলো। খালি ছোখে দেখা যাইবে এমন চরিত্র হইল মাদার টেরেসা,ভগিনী নিবেদিতা, মা সারদা,রানী রাসমনি এবং আরও অনেকে। মহাজ্ঞানী চাণক্য বলিয়াছেন,"বরমেক গুনিপুত্র ন চ মূর্খ শতৈরপি।/একশ্চন্দ্র তমোহন্তি ন চ তারাগনায়পি।।অর্থাৎ যেমন একটিমাত্র চাঁদ আকাশের অন্ধকার দূর করতে পারে।কিন্তু অসংখ্য নক্ষত্র আকাশের অন্ধকার দূর করতে পারে না। সেইরুপে একশত মুর্খপুত্র পিতাকে গৌরবান্বিত করিতে পারে না অথচ একটিমাত্র সুসন্তান পিতাকে গৌরবান্বিত করিতে পারে। কিন্তু আজ অবধি পিতা বা পুত্র কেউই বুঝিতে পারিল না যে চাণক্য কাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া ইহা লিখিয়া গিয়াছেন। নীতিটি পিতার জন্য না পুত্রের জন্য? পিতা ভাবিতেছে- উপদেশটি চানক্য পুত্রের জন্য লিখিয়া গিয়াছেন। পুত্র যাতে সুপুত্রে নিজেকে গঠন করিতে পারে তাহার জন্য চানক্যের এই উপদেশ। আবার পুত্র ভাবিতেছে উপদেশটি পিতার জন্য। পিতা যাহাতে সুপুত্র করিয়া পুত্রকে গড়িয়া তুলিতে পারে তাহার জন্য চানক্য এই উপদেশ সৃষ্টি করিয়াছেন। উপদেশটি পুস্তকে বন্দী রহিল। সুপুত্র আর সৃষ্টি হইল না।
চাকুরীক্ষেত্রেও এই নীচডাগলা আর উপরডাগলা নীতিটি প্রযোজ্য। যখন কেউ অল্প বয়সে চাকুরীতে যোগদান করিয়া থাকেন, তখন তিনি যৌবনমদে মত্ত থাকে।কোন কঠিন কাজকে তিনি দুরুহ বলিয়া মনে করে না।যে কাজ বয়স্ক কর্মচারী করিতে ভয় পায়, সেখানে যুবাকর্মচারী অনায়াসে কাজটি করিয়া আসে। সকলের বাহবা পায়।ফলে তরুন কর্মীর বুকের ছাতি বিস্ফারিত হইয়া বত্রিশ ইঞ্চি হইতে বাড়িয়া আটত্রিশ ইঞ্চিতে রুপান্তরিত হয়। আনন্দে সে তখন ধরাকে সরাজ্ঞান করে। সে তখন আর বয়স্ক কর্মচারীকে বাতিল ঘোড়া বলিয়া মনে করে এবং উঠিতে বসিতে তাহাদের নানারকম গঞ্জনা দিতে থাকে। বয়স্ক কর্মচারীরা শারিরীক কারনে অধিকাংশ দিন অফিসে ঠিকঠাক সময়ে অফিসে আসিতে পারেন না। তাহাতে নতুন কর্মচারীর অভিযোগের সীমা থাকে না। অনোন্যপায় হইয়া বৃদ্ধ কর্মচারীকে তাহা মানিয়া লওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে। তাহারা একবারও ভাবিয়া দেখে নাই যে একদিন নিজেদেরও এইরুপ অবস্তার শিকার হইতে হইবে।সংসারের ক্ষেত্রে যেমন তরুণ পুত্র এবং তরুনী পুত্রবধু কপোত কপোতী হইয়া একান্তে সংসারের উন্নতির পদ্ধতি আলোচনায় মগ্ন হইয়া যায়, তেমনি তরুণ তরুণী কর্মকচারীরা অফিসের কর্মপদ্ধতি লইয়া আলোচনা করিতে ব্যাস্ত হইয়া পড়ে। তথায় বয়স্কদের কোনরকম অংশাধিকার নাই।ইহা যে খারাপ তাহা আমি কখনো বলিতেছি না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যখন "সবুজের অভিযান" মানিয়া লইয়াছেন এবং তাহাকে স্বাগত জানাইয়াছেন, তখন আমি কে হরিদাস পাল,(আমার শ্রদ্ধেয় বি ডি ও স্যার মাননীয় সেবানন্দ পন্ডা মহাশয় একবার তাহার চেম্বারে বসিয়া আমাদের সঙ্গে কোন একটি বিষয় লইয়া আলোচনা করিতে করিতে নিজেকে হরিদাস পাল বলিয়া তাচ্ছিল্য করিতেছিলেন। এমনসময় আমাদের সি ডি পি ও শ্রীহরিদাস দাস মহাশয় চেম্বারে প্রবেশ করেন এবং তিনি স্যারের কথাটি শুনিয়া ফেলেন। হরিদাসবাবু এই বক্তব্যে দু:খ পাইতে পারে ভাবিয়া স্যার হরিদাস বাবুর উদ্দেশ্যে বলিয়াছিলেন-হরিদাসবাবু আমি কেবল তাচ্ছিল্য বিষয়ক প্রবাদটাই ব্যবহার করিয়াছি। আপনাকে উদ্দেশ্য করিয়া কথাটি বলি নাই। হরিদাসবাবু সহাস্যে উত্তর দিয়াছিলেন- আপনি কোন ভুল করেননি। আমি জানি আপনি প্রবাদটাই ব্যবহার করিয়াছেন।তাছাড়া আমার নাম হরিদাস দাস। পাল নহে। সুতরাং আপনার কথাটি আমাকে উদ্দেশ্য করিয়া বোঝায় না। তাই আমিও বলি হরিদাস পাল কথাটি তাচ্ছিল্য অর্থে ব্যবহার করিয়াছি। কাউকে আঘাত করিতে ব্যবহার করিনাই।) যে তাহার বিরুদ্ধাচারণ করিব!
তাহা হইলে এই সমস্যাগুলির সমাধানের উপায় কি? উপায় আমার বলিবার প্রয়োজন নাই। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ অনেক আগেই ইহার সমাধান করিয়া গিয়াছেন। তিনি শ্রীশ্রীগীতার কর্মযোগে পঞ্চম স্লোকে বলিয়াছেন,-" কর্ম্ম না করিয়া কভু তিলেকের তরে।/ তিষ্টিতে না পারে কেহ বিশ্ব চরাচরে।।/ সত্ত্ব- রজ: তম- গুন প্রকৃতিজনিত।/ বাধ্য করি করে সবে কর্ম্মে প্রবর্ত্তিত"।।আমার আর বলিবার কিছুই নাই। শুধু এইটুকু বলিতে পারি পিতাকে পিতার কাজ, স্ত্রীকে স্ত্রীর কাজ, পুত্রকে কাজ,কর্মচারীকে কর্মচারীর কাজ করিতেই হইবে।অর্থাৎ প্রত্যেককে নিজ নিজ কাজে ব্যপৃত থাকিতে হইবে।বিদায় লইতে লইতে বলি কাহাকেও "ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে" জাতীয় বাক্য প্রয়োগ করিবেন না বা ব্যবহার প্রদর্শণ করিবেন না। ইহার মতো হৃদয় বিদারক জগতে আর কিছুই নাই।
তারাপদ মাঝি
দেবনগর
১৬/০৬/২০১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.