ঘুষের টাকা কম বলে নেবেন না!

ঘুষের টাকা কম বলে নেবেন না!

দাদা, আসবো।মহিলাটি জিজ্ঞেস করলেন। আমি ফাইল থেকে মুখ সরিয়ে উনার দিকে তাকালাম। দেখলাম এক দরিদ্র মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং আমার ঘরে প্রবেশ করার অনুমতি চাইছে।আমি হ্যা বলাতে উনি আমার কাছে আসলেন। দেখলাম, মহিলাটি হয় বিধবা বা মুসলমান পরিবারের। তবে অত্যন্ত দরিদ্র।পরনে একটি আটপৌরে শাড়ি, তাও আবার জীর্ন।বয়স আনুমানিক চল্লিশ পয়তাল্লিশ হবে।গায়ের রঙ ময়লা।আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম-কি দরকার বলুন।
উনি তখনই কেঁদে ফেললেন। বললেন- আমার বাড়ি হোগলাগ্রামে।স্বপ্না ঘরামী আমার নাম।বছর পাঁচেক আগে আমার স্বামী মারা গেছে।আমার কোন সন্তান নেই।একা আমার বাড়িতে থাকি। লোকের বাড়িতে কাজ কাম করে নিজের আহার নিজে ব্যবস্থা করি। কিন্তু বছর দুয়েক হলো আমার দেওর আমায় খুব মারধর করছে।আমাকে ঘরে থাকতে দেবে না বলে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি অনেক কষ্টে এখন বাড়িতে আছি। তাই তোমার কাছে এসেছি।কেন ও আমায় মারধর করে বা কেন আমায় বাড়ি থেকে বের করে দিতে চায়, তা তোমার কাছে জানতে চাই।
বুঝতে পারলাম মহিলা আমাকে প্রধান ভেবে নিয়েছে।তাই তার অত্যাচারের কথা আমায় জানাচ্ছে। আমি বললাম- দেখুন, আমি তো প্রধান নই। প্রধান এলে তাঁকে আপনার অভিযোগ জানিও। কিন্তু উনি আবার বললেন- না আমি বাড়ি যাবো না। আমার একটা ব্যবস্থা করলে তবে আমি যাবো। তখন বুঝতে পারলাম যে মহিলা কানে ভালো শুনতে পান না। তাই বেশ চড়া গলায় বললাম- প্রধানকে তোমার কথা জানাও। এবার উনি শুনতে পেলেন। বললেন- তুমি প্রধান নও। বললাম- না, আমি প্রধান নই। আমাদের প্রধান একজন মহিলা।উনি তখন আবার বললেন- কখন আসবে প্রধান। আমি বললাম- তা তো আমি বলতে পারবো না। এখন ভোটের সময়।প্রধান ভোট নিয়ে ব্যস্ত। কখন আসবেন, বা আসবেন কিনা তা বলা সম্ভব নয়। উনি তখন বললেন- আগের বছর ভোটের সময় আমাদের গ্রাম থেকে যে দাঁড়িয়েছিল, তাকে আমার কথা জানিয়েছিলাম। বললো- ভোট হয়ে যাক। তারপর তোমার বিচার করে দেবো। কিন্তু তারপর আর তার দেখা নাই। আমি প্রতিদিন দেওরের হাতে মার খাচ্ছি।এই বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। আমি খুব দু:খ পেলাম। আবার এমন কান্নাকাটি করতে লাগলো যে আমি আর সইতে পারলাম না। বললাম- তুমি থানায় জানাও না কেন? ওখানে জানালে মনে হয় কাজ হবে।
এবার উনি চোখের জল মুছে বললেন- তাহলে তুমি লেখন দাও। আমি থানায় যাই।বললাম- আমার লেখাতে কাজ হবে না। প্রধান দিলে কাজ হবে। একদিন প্রধানের কাছ থেকে লেখন নিয়ে থানায় যেও। কিন্তু উনি কিছুতেই ছাড়লেন না। বললেন- তুমি মিথ্যে বলছো। তুমি এতবড় একজন অফিসার। তোমার লেখনে কাজ হবে না তা হয়। কিন্তু তাকে আমি কি করে বোঝাই যে আমি কত ছোট অফিসার। আমার কলমের কোন ক্ষমতা নাই। কিন্তু কিছুতেই তাকে বোঝানো গেল না।
আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না।আবার মহিলাটিকে না তাড়াতে পারলে আমার কাজের দফারফা হয়ে যাবে। আবার অসহায় মহিলার প্রতি রুঢ় হতে পারছি না। মনে মনে খুব দু:খ পেলাম।নিজেদের সংবিধানের যেখানে সোসাল জাস্টিসের কথা বলা আছে, তা কি মহিলা পাচ্ছে? অসহায়ভাবে বাধ্য হয়ে আমি একখানা অফিস প্যাড বের করলাম। তারপর মহিলাটি যাতে সুবিচার পায় তার অনুরোধ জানিয়ে জয়নগর থানার ওসিকে একখানা চিঠি লিখলাম।চিঠিখানা মহিলামকে দেওয়ার আগে ভয়ে অফিস প্যাডের লেটারহ্যাডটি কেটে দিলাম।
মহিলাকে চিঠিখানা দিতে উনি যে কি আনন্দ পেলেন, তা আমি বোঝাতে পারবো না।কিন্তু আমার অন্তরাত্তা খুবই দু:খ পেলো।মহিলা যে কাগজের টুকরোখানা অমুল্যধন বলে নিলেন, তা যে কোনো কাজের নয়, তা উনি থানায় গেলে বুঝতে পারবেন। উনি কাগজখানা আঁচলের খুঁটে ভালোকরে বাঁধলেন। তারপর ঐ আঁচলের খুঁট থেকে পাঁচটাকার দু' খানা কয়েন নিয়ে আমার টেবিলে দিয়ে বললেন- দাদা, আজ পানিফল তুলে কিছু রোজগার হয়েছে।তোমাকে দশ টাকা দিলাম। আর থানায় কিছু দেবো।আমি তো গরীব মানুষ। এটা নিয়ে সন্তুষ্ট হও।
এবার আমার মটকা গেছে গরম হয়ে। রাগে আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। আমি মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে আমার রাগ পড়ে গেল। ভাবলাম মহিলার দোষ কি? আমাদের মতো কিছু লোক এই চেয়ারটাকে কলঙ্কিত করে গেছেন। আমাদের মতো কিছু লোক রাঘব বোয়াল থেকে চুনোপুঁটি সব খেয়ে একখানা ইমেজ তৈরি করে গেছেন। তার ফলতো আমাদের পেতেই হবে। মহিলাকে দোষ দিয়ে কি হবে।
আমি শান্ত স্বরে বললাম- দেখুন, আমাকে কাজ করার জন্য সরকার মাইনে দিয়ে অফিসে রেখেছে। ঐ বেতন ছাড়া অন্য টাকা নেওয়া অন্যায়। আমরা এসব নিই না। তুমি এটাকা তুলে নাও। কখনো আর এমন করবে না। তখন উনি বললেন- তুমি সত্যি বলছো, না টাকার পরিমানটা কম হয়েছে বলে নিচ্ছ না।আমি তাকে অনুনয় করে বললাম- না, এমনটা ভাবার কোন কারন নেই। আমি যদি তোমার কাছে টাকা নিতাম, তাহলে আগে কথা বলে তবে কাজ করতাম। কিন্তু আমি আগে তোমায় টাকার কথা বলেছি কি?
মহিলাটি বললেন- না, তুমি তা বলনি।আমারও কি জানি মনে হচ্ছে তুমি বোধ হয় সত্যি কথা বলছো। বলে টেবিলে রাখা দশটাকা তুলে নিয়ে আঁচলের খুঁটে বাঁধতে বাঁধতে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আমি চোখ বন্ধ করে খানিকটা সময় কাটালাম। মহিলাটি আমাকে কয়েক মিনিটে বিদ্ধস্ত করে চলে গেলেন। ভাবলাম- আমাদের সমাজে মহিলাদের নিরাপত্তা কি।একজন পুরুষের স্ত্রী মারা গেলে তিনি দু- তিন মাসের মধ্যে আবার দার পরিগ্রহন করেন। বাড়ির সকলের সেই পুরুষের বিপত্নিক হওয়ার জন্য কুম্ভিরাশ্রুর শেষ থাকে না। আর একজন মহিলার যদি স্বামী মারা যায়, তাহলে তাকে সারা জীবন বৈধব্য যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে। তার আর বিয়ে করার অধিকার নেই। আর সেই মহিলার যদি বিয়ে করার ইচ্ছা হয়, তাহলে সমাজে তার বেঁচে থাকাটাই দু:স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াবে। এই মহিলাটি যদি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে পারতো, তাহলে তার এমন অবস্থা নাও হতে পারতো।সাধে কি আর সীতাদেবী বলেছিলেন-" ধরনী দ্বিধা হয়, আমি তোমার কোলে আশ্রয় নেই।"
তারাপদ মাঝি
দেবনগর
২২/০৪/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.