বানিজ্যে বসতি লক্ষ্মী, সর্ব্বসুখ চাষে।

বানিজ্যে বসতি লক্ষ্মী, সর্ব্বসুখ চাষে।
খুব ছোটবেলা হইতে উল্লিখিত বাক্যটি শুনিয়া আসিতেছি। কিন্তু ইহার অর্থ কি বা কি হইতে পারে তাহা বুঝিতাম না। পরে অষ্টম শ্রেনীতে দেবভাষা পাঠ করিতে গিয়া উল্লিখিত বাক্যের মর্ম্মোদ্ধার করিয়াছি এবং এক্ষনে তাহা হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছি।বিশেষত 'সর্ব্বসুখ চাষে' কথাটি কতখানি সত্য তাহা উপলব্ধি করিয়া হতবাক হইয়া গিয়াছি।
বাল্যকালে পিতামহাশয়ের সঙ্গে গ্রামের মুরুব্বিরা বসিয়া গল্পকরিত।আমি প্রায়ই দেখিতাম,কোন বর্ষণক্লান্ত দিনের দ্বিপ্রহরের পর পিতামহাশয়ের সঙ্গে পাড়ার গুরুজনেরা বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া হুকা টানিতে টানিতে গল্প করিতে থাকিত। আমি তখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়িতাম। উনাদের অলোচনার বিন্দুবিসর্গ বুঝিতে পারিতাম না। তথাপি তাহাদের কথার মর্ম্মোদ্ধার করিবার জন্য আমার কর্ণকুহরকে সদাই জাগ্রত রাখিতাম। এক সময় পিতামহাশয় মাইতি পাড়ার বিনয়ের চাকুরি পাওয়ার কথা উত্থাপন করিতে বয়স্কদের মধ্যে চাকুরী আর ব্যবসা লইয়া জোর আলোচনা শুরু হইল এবং উপস্থিত বয়স্করা অষ্পষ্টভাবে দ্বিধাভক্ত হইল। একদল চাকুরী সমর্থনকারী এবং অপর দল হইল ব্যাবসা সমর্থনকারী। যতীনবাবু ব্যবসায়ী লোক বলিয়া ব্যবসার পক্ষে সওয়াল করিত এবং ব্যবসাই যে সেরা তাহা উনি সর্ব্বসমক্ষে প্রমান না করিয়া একবারও হুকায় টান দিতেন না।
পাড়ার ত্রৈলক্যবাবুর ছেলে কোলকাতায় চাকুরী করেন।বেতনও বেশ আহামরি। সুতরাং ত্রৈলক্যবাবু দমিবার পাত্র ছিলেন না এবং চাকুরী যে ব্যবসা হইতে অনেকাংশে সেরা তাহা তিনি প্রমান করিয়া ছাড়িতেন।সভা যখন ষ্পষ্ট দ্বিধাভক্ত হইবার উপক্রম হইত তখন পিতাঠাকুর বলিতেন,'সর্ব্বসুখ চাষে'। বাক্যখানি প্রয়োগ করিয়া সভার দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্যদিকে ঘুরাইয়া দিতেন।আমি মনে মনে হাসিতাম।কারণ বাবা ছিলেন একজন কৃষক। বাষবাসকে সেরা বলিয়া প্রমান করিবার প্রয়াস করিতেন। আর চাষ যে সর্ব্বসুখ দিতে পারে তাহা ওই অর্বাচীন বয়সে বুঝিতাম না।
অনেক বছর পরে আমি যখন তিন সন্তানের জনক হইলাম, তখন জেলা পুস্তকমেলা হইতে" চাষবাস বারোমাস" নামক একখানি পুস্তক ক্রয় করিয়া পাঠ করিতে গিয়া দেখি, পুস্তকের মুখবন্ধ শুরু হইয়াছে' যেমন তেমন চাষ, খা না বারো মাস' নামক একটি প্রায় বিস্মৃত প্রবাদবাক্য দ্বারা। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে পুস্তকখানি পাঠ করিতে আমার বধোদয় হইল।সেইদিন হইতে আজ পর্যন্ত কৃষিকে মহৎ কর্ম জ্ঞান করিয়াছি এবং নিজেকে কৃষিকাজে ব্যাপৃত করিয়াছি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করি কোনদিন যেন কৃষিকাজ হইতে বিমুখ না হই।
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এমন একটা পর্যায়ে পৌছাইয়া গিয়াছে যে আপনি কৃষিকাজ করিয়া নিজ নিজ চাহিদা পুরন করিলে খাদ্য দুষণ আর মৃত্তিকা দুষণ হইতে অব্যাহতি পাইবেন। মানুষ সব সময় লাভের আশাই করে। সেই লাভের জন্য তীব্র রাসায়নিক সার আর দীর্ঘ অন্তর্বাহী কীটনাশক প্রয়োগ করিয়া যে কৃষিউৎপাদন বাজারজাত করেন, তাহা শরীরের উপর মারাত্বক ক্ষতিকর।ব্যবসায়ী কৃষকের কোন দোষ আমি ইহাতে দেখিতে পাই না। কারন কীটনাশক দ্রব্য প্রয়োগ দ্বারা কৃষিকাজ না করিলে তাহার যে আর্থিক ক্ষতিসাধন হইবে তাহা কখনো পূরণ হইবার নয়।কিন্তু আমরা যদি নিজের প্রয়োজন মতো নিজদের পতিত জমিতে কৃষিকাজে অগ্রসর হই, তাহা হইলে বাজারের মৃত্যুতুল্য কৃষিদ্রব্য হইতে খানিকটা হলেও মুক্তি পাইতে পারি।
কৃষক অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত হইবার জন্য কৃষিক্ষেত্রে এমন অনাচার শুরু হইয়াছে।আমরা আমাদের সন্তানদের সর্ব্বদা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিষ্টার, উকিল, কালেকটার বানাইতে লাগিলাম। কিন্তু একবারও কোনো সন্তানকে শিক্ষিত কৃষক বানাইতে গেলাম না।একশো কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদনের জন্য অশিক্ষিত মানুষের উপর ছাড়িয়া দিলাম।ফলে অমৃত পানের পরিবর্তে বিষপান করিতে হইতেছে।আজ কাল সরকার কৃষির দিকে দৃষ্টি প্রদান করিয়াছেন কিন্তু তাহাতে বিশেষ উপকার হইতেছে বলিয়া মনে করিতেছি না।সরকার প্রায় পঞ্চায়েতগুলিতে কৃষিপ্রযুক্তি সহায়ক নামক একজনকে নিয়োগ করিয়াছেন, কিন্তু তাহার দক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন থাকিয়া যায়। তিনি কৃষির পদ্ধতি কাগজে কলমে ভালোই জানেন, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ কৌশল কোদাচিৎ জানেন কিনা বলিতে পারা যায় না।
আমরা বাড়িতে সৌন্দর্য্যায়নের জন্য টবে ফুলচারা চাষকরিয়া থাকি, কিন্তু নিজেদের শরীরের প্রয়োজনে টবে দুটো সবজি চাষ করিতে পারি না।অথচ টবের সবজি সৌন্দর্য্যায়ন করিবে আবার নিজের শরীরের জন্য নির্ভেজাল খাদ্য সরবরাহ করিবে।আজকাল বাজারে জৈব সারের অভাব নেই। রাসায়নিক সার ব্যবহার না করিয়া টবে লংকা, বেগুন, আদা, টমেটো, বরবটি, কুমড়ো, বিভিন্ন শাক, মুলো,গাজর ইত্যাদি অনায়াসে চাষ করা যায়। আর গ্রামের দিকে একটু জায়গা আর সামান্য জল পাইলে কোন অসুবিধা হইবে না চাষের।
এবার চাষের পরোক্ষ উপকারগুলি অনুধাবন করিলে আপনি ভ্রু কুঞ্চিত করিবেন। কারন আমি যে কথাগুলি উত্থাপন করিতে যাইতেছি, তাহা আপনি পুস্তকে পড়িতে অভ্যস্ত, বাস্তবে প্রয়োগ করিতে অভ্যস্ত নন। যেমন স্বামীজী বলেছেন- স্বাস্থ্যই সম্পদ। কথাটি চরমতম সত্যের চরমতম সত্য। স্বাস্থ্য মানে রোগমুক্ত সবল সুঠাম তনু। স্বাস্থ্য যদি আপনার ভালো না হয়, তাহা হইলে কোন কাজেই আপনি মনোনিবেশ করিতে পারিবেন না।আপনি কোটি টাকা খরচ করিয়াও নিজেকে স্বাস্থ্যবান মানুষে পরিবর্তন করিতে পারিবেন না, যদি না আপনি নিজে যত্নবান হন।কবিগুরু বলিয়াছেন- যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে,সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে।" নদী স্রোত হারাইয়া ফেলিলে, তখন আস্তে আস্তে তাহার শরীরে আগাছা জমিতে থাকে, তারপর সেই নদী মজিয়া গিয়া, তাহার কৌলিন্য হারাইয়া ফেলে। মানব শরীরের ক্ষেত্রেও ইহা প্রযোজ্য।মানুষের শোনিত স্রোত যদি আবদ্ধ হইতে থাকে, তাহা হইলে শরীরে গ্যাস, অম্বল,বুকজ্বালা আর যন্ত্রনাদায়ক কোষ্ঠকাঠিন্ন রোগের শিকার হয়।আর শোনিত স্রোত যাহাতে আবদ্ধ না হয়, তাহার উপযুক্ত ব্যবস্থা পত্র হইল ব্যায়ামাদির দ্বারা শরীরকে তাজা রাখা অর্থাৎ শরীরের শোনিতস্রোতকে সঠিকভাবে সচল রাখা।কৃষিকাজ করিলে আপনার শরীরকে ব্যায়ামতুল্য উপকার প্রদান করিবে এবং উপরি পাওয়না হিসাবে নির্ভেজাল টাটকা সবজি পাইবেন।
আমার নিবেদন আপনাদের মনোগ্রাহী হইলো কিনা জানিনা, কিন্তু এটুকু হলপ করিয়া বলিতে পারি, আমার দেখানো পথে আপনি যদি বিচরন করেন তাহা হইলে আপনি ঠকিবেন না।প্রবন্ধ শেষ করিব কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইন দিয়া। কবি বলিয়াছেন- এ দেশ আমার গর্ব, এ দেশের মাটি আমার কাছে মুকুলিত সোনা।আমিও উনার সঙ্গে সহমত যে এ দেশের মাটি সত্যই মুকুলিত সোনা।
তারাপদ মাঝি
বহরু
১৪/০৫/১৮

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.