জবা

অমলেন্দু জানালার পাশে বসে বসে প্রাতরাশের পর ফল খাচ্ছিল আর খোলা জানালা দিয়ে পাশের ফুলগাছগুলো দেখছিল। অন্য কোন ফুলগাছ নয়, শুধু জবা আর টগর গাছ রয়েছে বাগানে। জানালা থেকে মাত্র ফুট সাতেক দূরে গাছগুলো রয়েছে। অমলেন্দু ইচ্ছে করে বাগান করে নি। বাড়ির জমিকে ছাগল গরুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন জবা গাছের ডাল পুঁতে বেড়া দিয়েছিল। সেগুলি এখন রীতিমতো বাগানে পরিনত হয়েছে আর ফুলে ফুলে ভরে গেছে।
অমলেন্দুর বয়স এখন চুয়ান্ন পঞ্চান্ন। সুঠাম শরীর কি এক অজানা রোগে জরাজীর্ন। ডাক্তারবাবুরা জবাব দিয়েছেন। সে কথা বাড়ির কেউ অমলেন্দুকে না জানালেও অমলেন্দু সবই জানে এবং পরম অপেক্ষায় তার আসার দিন গুনছেন। যতদিন না তিনি আসেন ততদিন কোন মতে বেঁচে থাকা আর কি?
জবা গাছগুলিতে কি সুন্দর ফুল ফুটেছে। হলুদ, সাদা আর লাল রক্ত জবার মেলা বসেছে যেন। মাঝে মাঝে টগর ফুলের উঁকি দিয়ে দেখা কি সুন্দর না লাগছে। কত রকমের যে পাখি গাছে গাছে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার হিসেব করে পারা যাবে না। অমলেন্দু দেখলো হঠাৎ উল্টোদিক থেকে অর্থাৎ রাস্তা থেকে একটি হাত এসে টুক টুক করে কয়েকটি রক্ত জবা তুলে নিলো। মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে না, শুধু হাত খানা দেখা যাচ্ছে। বাকি শরীরটা গাছের আড়ালে ঢাকা। হাতটি যে মহিলার সেটা বোঝা যায়। কারণ অমলেন্দু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে ফুল তোলা হাতে নোয়া পলা আর শঙখবলয়। হাতের রঙ দেখে পরিস্কার বুঝতে পারছে হাতের অধিকারিনী শ্যামলা আর নিটোল শরীরের অধিকারিনী।
অমলেমদু গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে সে ভেবে দেখলো যে এমন হাতের অধিকারিনী তার পাড়ার কোন মহিলার হাতের সঙ্গে মেলে না। তাছাড়া তার পাড়ার কোন মহিলার না বলে ফুল তোলার এই দুঃসাহস দেখাবে না। তা হলে কে এই মহিলা? এমনিতে কথা বলতে কষ্ট হয় অমলেন্দুর। তবুও অনেক কষ্টে জিজ্ঞাসা করলো- কে ফুল তুলছো না বলে?
ফুল গাছের একটি ডাল সরিয়ে মহিলা দেখা দিয়ে বললে- আমাকেও অনুমতি নিয়ে ফুল তুলতে হবে অমলদা? চমকে ওঠে অমলেন্দু। এ যে জবা! কৈশরের প্রত্যাখাত প্রেমিকা। অমলেন্দু হঠাৎই খুব অতীতে চলে যায়। সে তখন ক্লাস এইটে পড়তো। পাড়ায় সবাই মিলে খেলছিল সীতাহরণ খেলা। অমলেন্দু হয়েছিল রাবণ আর রোগা শ্যামলা জবা হয়েছিল সীতা। সীতা অর্থাৎ জবাকে যখন চুরি করে রাবন অর্থাৎ অমলেন্দু ঘরে আনলো, তখন জবা অমলেন্দুর কানে কানে ফিস ফিস করে বলেছিল-” তুই আমায় চুরি করবি কেন? এমনি ডাকলেই আমি তোর কাছে চলে আসবো। তুই আমার রাবণ নয়, তুই আমার রাম।”
অমলেন্দু ব্যাপারটা খেলাচ্ছলে নিয়েছিল। কিন্তু জবা ভেবেছিল হৃদয় দিয়ে। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর যখন অমলেন্দু কলকাতায় পড়তে গেল তখন জবা একদিন অমলেন্দুকে বললো- “তুমি তো কলকাতায় পড়তে চললে। কিন্তু আমার বাবা তো আর পড়াবে না। আমার একটা কিছু ব্যবস্থা করে যাও। না হলে বাবা অন্য কারও সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।”
-এবার অমলেন্দু বিপদে পড়লো। এতদিন সে জবার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করে এসেছে। তাকে কোন দিন মন থেকে ভালো বাসে নি। সুতরাং বিয়ে করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এই কথাগুলি সে জবার মুখের উপর বলে দিয়েছিল।
তার পর থেকে আর জবার সঙ্গে অমলেন্দুর দেখা হয় নি। জবার বিয়ে হয়ে যাবার পর আর দেখা হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। তারপর অমলেন্দুর চাকুরী হলো, বিয়ে হলো।ছেলেপুলে হলো। কিন্তু জবার সঙ্গে আর দেখা হলো না। কিন্তু সময়ে সময়ে যে জবা তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে নি তা কিন্তু নয়। আর যখন মনে ভেসে ওঠে, তখন অনুশোচনার শেষ থাকে না অমলেন্দুর। জবাকে ভালো বাসলেই পারতো। বিয়ে হলে মন্দ হতো না মনে হয়। কারণ অমলেন্দু আর তার স্ত্রী দুজনেই চাকুরী করে। অমলেন্দুর বদলির চাকরি। আর তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা। ফলে স্ত্রীর সঙ্গ সেভাবে পান নি অমলেন্দু। জবাকে বিয়ে করলে কিছু না হোক তার সান্নিধ্য পেতে অসুবিধা হতো না।
-কি গো অমলেন্দুদা, কথা বলবে না বুঝি?
- জবার কথায় অমলেন্দুর হুঁস এলো?
-না কথা বলবো না কেন? কেমন আছিস জবা?
- আমি তো বেশ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?
- আমি ভালো নেই রে। ডাক্তাররা জবাব দিয়েছেন। এখন শুধু যাবার অপেক্ষা।
এমন সময় পাশের বাড়ির রবি রাস্তা থেকে জিজ্ঞাসা করলে- কার সঙ্গে কথা বলছো অমলেন্দুদা?
-কেন ওই তো ঝাড়েশ্বর কাকার মেয়ে জবার সঙ্গে?
- তুমি কি পাগল হলে?
-কেন!
-ঝাড়েশ্বর কাকার মেয়ে বাইক অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে গত বছর। তুমি ভালো করে বিশ্রাম নাও দাদা। এই বলে রবি কি বিড় বিড় করে বলতে বলতে চলে গেল।
কিন্তু অমলেন্দু দেখছে জবার মুখখানা এক রহস্যময় হাসিতে ভরে যাচ্ছে আর আর আস্তে আস্তে তার শরীরটা বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় অমলেন্দুকে সে যেন বলে গেল- “এসো অমলেন্দুদা, আমি তোমার প্রতীক্ষায় আছি। জীবদ্দশায় যা পাই নি, মরণের পরে তা আদায় করে নেব।”
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর
৭ই আগষ্ট,২০২১ খ্রীষ্টাব্দ।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.