#জীবনে_প্রথম_উৎকোচ_নেওয়ার_শেষ_পরিনতি

আমার নাম সম্ভাবনা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাড়ি স্বনামধন্য বসর গ্রাম। একেবারে “ছায়া সুনিবিড়” এবং “শান্তির নীড়ে” ভরা আমাদের গ্রামখানি। আমার গ্রামকে আমি এতটা ভালোবাসি যে ব্যাঙ্কে ভালো কাজ করা সত্যেও গ্রাম ছাড়ি নি। আমার মিসেস এর জন্য যে কত গঞ্জনা দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আমি কিছুতেই শিকড়ের টানকে ছাড়তে পারি নি। যখন শহর থেকে কাজ সেরে সন্ধ্যায় নিজের গ্রামে প্রবেশ করি তখন গাছেরা আমায় পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে শরীর শীতল করে আর খেতে দেয় অফুরন্ত অক্সিজেন। আহা! সে কি যে আনন্দ পাই সে কথা বলে বোঝাবার নয়। যাক ধান ভাঙতে গিয়ে আর শিবের গান গেয়ে কাজ নেই। কারণ মানব প্রেম ছাড়া আজ কাল আর কেউ প্রকৃতি প্রেম পছন্দ করেন না। তাই তো প্রকৃতিকে ধ্বংস করার উৎসব শুরু করেছি আমরা। সরি দাদা, আর শিবের গান গাইব না।
আগেই বলেছি যে আমি ব্যাঙ্কে চাকুরি করি। জয়নগরে সরবেড়িয়ায় আমার অফিস।এখন আমি ফিল্ড ম্যানেজারের পদে আছি। যেহেতু লোন ডিপার্টমেন্টটা আমার বিভাগে আছে, তাই লোকে মনে করে আমি একেবারে আকন্ঠ উৎকোচে ডুবে আছি। কেউ কেউ আবার মুখের উপর সে কথা জানাতে পিছপা হন না। তখন আমার মটকা এমন গরম হয়ে যায় যে মনে হয় বক্তার স্বাদেন্দ্রিয়কে ছুরি দিয়ে কেটে বাদ দেই। কিন্তু বাস্তবে তা করতে পারি না। বাধ্য হয়ে চুপ করে থেকে শুনে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমি ব্রাম্ভণ মানুষ। গলায় পৈতে আছে এবং রীতিমতো ত্রি-সন্ধ্যা গায়ত্রী জপ করি। যেহেতু এখনো মাংস ভক্ষণ করি তাই নিজেকে সাত্যিক এবং গোঁড়া ব্রাম্ভণ বলে দাবি করার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু উৎকোচের ব্যপারে আমি একেবারে সচেতন। আমি কখনো এক পয়সা উৎকোচ নেই নি এবং যে উৎকোচ দেওয়ার চেষ্টা করে তাকেও উচিত শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করি।
সেদিন একটি লোনের জন্য আমাকে ফিল্ড এনকোয়ারীতে যেতে হলো।গেলাম হোগলার সাইফুদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি। ভদ্রলোক বাড়ি বন্ধক রেখে লাখ পাঁচেক টাকা চান যাতে তিনি একটি রেডিমেড পোষাক তৈরীর ব্যবসা করতে পারেন। আমাকে দেখতে হবে বাড়ির বর্তমান ভ্যালু কত হতে পারে এবং তার সাপেক্ষে লোন দেওয়া যাবে কিনা।
ভদ্রলোকের বাড়িটি মন্দ নয়। দু’তলা বাড়ি। রঙ দিয়ে একেবারে ঝক্ ঝকে করেছেন। বাড়ির একপাশ দিয়ে চলে গেছে ব্যস্ত ব্ল্যাকটপ রাস্তা আর তার বিপরীত পাশ দিয়ে অজগরের মতো নামখানা শিয়ালদহ ট্রেন রাস্তা শুয়ে আছে। কাছেই হোগলা স্টেশন। সব কিছু বিবেচনা করলে ভদ্রলোককে লোন দেওয়া যেতে পারে। যদি ভদ্রলোক ঋন পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে বাড়ি ক্রোক করে ব্যাঙ্কের আমানত আদায়ের কোন অসুবিধা হবে না। আমি সব দেখেশুনে লোনের পারমিট করে দিলাম।
আমি আর আমার একজন সহকর্মী এনকোয়ারীতে গিয়েছিলাম। চৌধুরীবাবু আমাদের চা খাওয়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তা খাই নি। পাছে লোকে উৎকোচের খোঁটা দেয় সেই ভয়ে। ভদ্রলোকও আর পীড়াপিড়ি করেন নি। জাতপাতের ভেদাভেদের ভয়ে। যাইহোক বাড়ি ফেরার জন্য আমি ধরবো নামখানা শিয়ালদহ ডাউন লোকাল আর আমার সহকর্মী ধরবেন লক্ষ্মীকান্তপুর শিয়ালদহ আপ লোকাল। দু’জনের ট্রেন আসতে এখনও চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। ততক্ষন আমরা স্টশনে চা পান খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে হোগলা স্টেশনে এলাম।
আমরা স্টেশনে বসে চা খাচ্ছি। প্রায় মিনিট দশেক পর চৌধুরীবাবু আমাদের কাছে হাজির। ভদ্রলোকের হাতে একখানা ব্যাগ। ব্যাগে কিচ্ছু যেন নড়াচড়া করছে মনে হল। এমন সময় চৌধুরী সাহেব বললেন- স্যার আমি ইসলাম ধর্মের মানুষ। একমাত্র আল্লাহ্(রঃ)র কাছে ছাড়া আমাদের কারও কাছে হাত জোড় করতে নেই। তাই আমি আপনার কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করতে পারছি না। আমার সর্বোচ্চ সত্বা দিয়ে আপনার নিকট আমার অনুরোধ আপনি আমার এই উপহারটি গ্রহন করুন। আল্লার কসম, আমার যদি লোন না হয় আমি কিচ্ছু মনে করব না। কিন্তু আমার উপহারটি নিয়ে আমায় মেহমানের সেবা থেকে বঞ্চিত করবেন না।
-বললাম - কি আছে এতে?
- আজ্ঞে দু’টো পাতি হাঁস। এখন শীতের সময়। হাঁসের মাংস খেতে দারুন লাগবে।
-কিন্ত……..আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু চৌধুরীসাহেব আমাকে থামিয়ে কাচুমাচু মুখে বললে-’না’করবেন না স্যার। না নিলে আমি খুব ব্যাথা পাব স্যার।
আমি আমার সহকর্মীটির দিকে তাকালাম। তার দেখি চোখ চক্ চক্ করছে। তার যে হাঁসের প্রতি কি মাত্রায় লোভ রয়েছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না। অগত্যা হাঁস দু’টি নিতে বাধ্য হলাম। চৌধুরীবাবু দেখি দু’টো হাঁস দু’টো বেশ সুদৃশ্য ব্যাগে এনেছেন। আমার ট্রেন আগে আসায় আমি আগেই ট্রেনে উঠলাম।
ট্রেনে আসতে আসতে ভাবলাম উপহার বলো বা উৎকোচ বলো, জীবনে এই প্রথম নেওয়া। তবে শীতের সময় হাঁসের মাংস সত্যি খেতে খুব ভালো লাগে। আমার তো খুব পছন্দের মাংস। তার উপর হাঁসের ওজনটাও বেশ বেশী। কিলো তিনেক ভারী হবে বোধ হয়। নিজেকে নানাভাবে প্রবোধ দিয়ে বললাম- আমি তো আর তাকে হাঁস চাই নি। সে যদি জোর করে দেয়, তাহলে আমার আর কি করার থাকে। মনে মনে ভাবলাম- যা হবার তা হয়েছে। এখন আর কোন কিছু করার নেই। তার চাইতে রবিবারে জমিয়ে হাঁসের মাংস খাওয়া যাক। তার পর যা হয় ভাবা যাবে।
বাড়িতে গিন্নিকে হাঁস দিয়ে হাঁসের সব গল্প বললাম। গিন্নি আনন্দে গদ গদ হয়ে আমার হাত থেকে হাঁসের ব্যাগ নিয়ে বাইরে রান্না ঘরের এক পিরেকে ঝুলিয়ে রাখলো। ব্যাগটি মাটি থেকে মাত্র হাত খানিক উপরে ঝুলতে লাগলো। উদ্দেশ্য খাওয়া শেষ হলে, রান্নাঘরের এক কোনে ঝুড়ি চাপা দিয়ে হাঁসটিকে রাতের জন্য রেখে দেবে। তারপর দুপুর বেলায় হাঁসটাকে খাওয়া হবে।
গিন্নি রান্না করছে। বাবার কাছে আমার ছেলে গীতার পাঠ নিচ্ছে। আর মেয়েটা মোবাইলে মনযোগ দিয়ে কি করছে কি জানি? আমি বাধ্য হয়ে “পুরোহিত দর্পন” নিয়ে পড়তে বসেছি। এ বছর কয়েকটা সরস্বতী পূজা হয়তো করতে হতে পারে। আমি যজমানি করতে চাই না। কিন্তু লোকে ছাড়ে না। বাধ্য হয়ে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাচ্ছি বলতে পারেন।
রাতের খাবার খেয়ে আমরা সবাই শুয়ে পড়লাম। শীতের রাত। পাড়া গাঁয়ে রাত আটটাতে নিশুতি রাত নেমে আসে। আমরা প্রায় রাত দশটার দিকে ঘুমিয়েছি। হঠাৎ বিকট শব্দের কারণে ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারি নি। খানিক পরে বুঝলাম শব্দ আসছে বাইরের রান্না ঘর থেকে। তখনই বুঝলাম রান্না ঘরে রাখা হাঁসটিকে ঝুড়ি চাপা দেওয়া হয় নি। সে সেরকম ব্যাগেই আছে। আমি গিন্নিকে বললাম- তুমি হাঁসকে ঝুড়ি চাপা দিয়েছো?
আমার প্রশ্ন শুনেই গিন্নি ছুটলেন রান্না ঘরের দিকে। কিন্তু সব দিকে চাবি দেওয়া। চাবি খুঁজে তালা খুলে বের হবার আগেই হাঁসের আর্তনাদের শব্দ। হঠাৎ সে শব্দ থেমে গেল। বুঝলাম কটাশ ভায়া হাঁসের নলি কেটে দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও টর্চ নিয়ে রান্না ঘরে এলাম। দেখলাম ব্যাগ পড়ে আছে। কিন্তু হাঁস বেপাত্তা। বুঝলাম হাঁসটি কটাশের ভোগে গেছে। চারি দিকে জজ্ঞল। তাই খুঁজে লাভও নেই। সুতরাং ঘুমিয়ে পড়াই শ্রেয় মনে করলাম।
এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে চৌধুরীবাবু লোন তুলে নিলেন এবং আমাকে তিনি ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না। তবে তার পরের কথাগুলো ছিল বিষফলার মতো যন্ত্রনা দায়ক। কারণ তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন- স্যার হাঁস কেমন খেলেন? মাংস টেষ্টি ছিল কি?
কিছুদিন পর চা দোকানে বসে চা খাচ্ছি। খুব ভীড় দোকানে। আমি এক কোনে নিরিবিলিতে চা খাচ্ছি। বলতে গেলে আমাদের ব্যাঙ্কের অফিসারদের জন্য দোকানদার এই ব্যবস্থা রেখেছেন। এমন সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলছে-অ্যাই,জয়নাল। তুই ব্যঙ্কের বামনে ফিল্ড অফিসারকে দেখেছিস?
-কেন?
-শালা, ছাইফুদ্দিনের কাছ থেকে হাঁস খেয়ে ওকে ওকে পাঁচ লাখ টাকার লোন পাইয়ে দিল। দেখি আমি ছাগল খাইয়ে দশ লাখ টাকার একটি লোন পাই কি না।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
৩১শে জানুয়ারী, ২০২১
দেবনগর

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.