#বার্ধক্যের_দ্বারে_প্রথম_প্রেম

#গল্প

#বার্ধক্যের_দ্বারে_প্রথম_প্রেম

#তারাপদ_মাঝি




পলাশ মন্ডল একজন ফরেষ্ট অফিসার। বাড়ি জয়নগর ব্লকের সরবেড়িয়া গ্রামে।ফর্সা রঙ,বেশ বলিষ্ট গড়ন। মাঝারি উচ্চতার

সুপুরুষ পলাশবাবু অমায়িক শান্ত স্বভাবের মানুষ। তার এই স্বভাবের জন্য তার কলিগরা প্রায় বলেন- “পলাশবাবু, আপনি পুলিশ

লাইনে না এসে শিক্ষকতার লাইনে গেলে আপনার কেরিয়ারের অনেক উন্নতি হতো।” কিন্তু এসব কথা পলাশবাবু গায়ে মাখেন না।

তিনি নিজেকে বেশ ভালোই চেনেন। তিনি জানতেন যে তার সৎ ভাবে জীবন যাপন করা অনেকের সহ্য হয় না। তাই এরকম কথা

বলছেন।


সত্যি কথা বলতে কি, পলাশবাবু অত্যন্ত সৎ অফিসার। তিনি কোনো ভাবে দূর্নীতিগ্রস্থ নন এবং দূর্নীতিকে কোন ভাবেই প্রশ্রয় দেন

না।আর সবচেয়ে তার বড় গুন হলো তিনি প্রত্যেকটি উদ্ভিদকে মানুষের প্রানের মতো ভালো বাসেন। তাই বৃক্ষছেদন তিনি কোন

মতেই বরদাস্ত করেন না এবং বৃক্ষছেদনের যে কোন রকম দূর্নীতির তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং প্রতিকার করার চেষ্টা করেন। তাই

কোন অফিসেই তার দেড় দু ‘বছরের বেশী থাকা হয় না। কিন্তু তিনি অফিস পাল্টাতে রাজি, কিন্তু নিজের চরিত্র পাল্টাতে রাজি

নয়।


পলাশবাবুর সততায়  বিরক্ত হয়ে হাই অথরিটি তাকে সুন্দরবন ফরেষ্ট রেঞ্জে ট্রান্সফার করলো। তাই পলাশবাবু এখন নামখানার

ফরেষ্ট অফিসে কর্মরত। অফিসে জয়েন্ট করেই সুন্দরবন অরণ্য পরিদর্শণে বের হলেন। প্রথমেই তিনি লথিয়ান এবং জম্বুদ্বীপ

পরিদর্শণ করলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে এই অফিসে তিনি প্রথম জয়েন্ট করার সময় এ-ই জঙ্গল যেভাবে ঘন

ছিল,  এখন তা একেবারে গড়ের মাঠ! অফিসের লোকগুলো করেছে কি! তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। এই দ্বীপগুলোর বৃক্ষহীন

হওয়ার জন্য দ্বীপগুলোর ক্ষয়কার্য্য বেড়ে গিয়েছে। এই দ্বীপগুলির যত বেশী ক্ষয়ীভূত হবে ততবেশী পাথর প্রতিমা, নামখানা

এবং সাগরের বিপদ বাড়বে।


সেদিন অফিসে ফিরেই উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে দ্বীপগুলির প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে রিপোর্ট করলেন এবং দ্বীপগুলিতে পুনরায় বৃক্ষ

রোপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ চেয়ে পাঠালেন। তারপর এলাকায় প্রচার করে দিলেন যে কেউ যেন দ্বীপগুলিতে না যায়। দ্বীপে

কোন ব্যক্তিকে দেখলে তাকে গ্রেফতার করা হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরপর তিনি দিনে রাতে নজরদারি অত্যন্ত

বাড়িয়ে দিলেন।যে করেই হোক ভবিষ্যতের বিপর্যয় থেকে এই এলাকাকে বাঁচাতে হবে।


একদিন সকালে লথিয়ান দ্বীপের হাড়িভাঙ্গা খালে ঢুকে জঙ্গলের অনেকটা ভিতরে চলে গেলেন। আর তখনই একটি ছোট্ট নৌকা

চোখে এলো। নিশ্চয়ই এরা কাঠ কাটতে এসেছে। নইলে এতো ভিতরে আসবে কেন? পলাশবাবু নৌকার কাছে গেলেন। দেখলেন

ছ’জন নৌকায় বসে আছেন। তারা বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি নিয়ে কোথাও যাবার উদ্যোগ করছে। পলাশবাবু শান্ত গলায়

বললেন- তোমরা এখানে কেন? জানো না এই দ্বীপে আসা বারন?

-আজ্ঞে জানি স্যার। পেটের দায় বড় দায় স্যার। সারা বছর এই জঙ্গলে আমরা মধু সংগ্রহ করি স্যার। এ ছাড়া আমাদের জীবিকা

নির্বাহের অন্য কোন রাস্তা নেই। শ্যামলা রঙের একজন কুড়ি পঁচিশ বয়সের যুবকটি উত্তর দিলেন।

-বটে, দেশে এতো কাজ থাকতে জঙ্গলে মধু সংগ্রহ ছাড়া আর কাজ পেলে না! ভালোই করেছ। এখন মামার বাড়ি চলো। কিছুদিন

ডাল ভাতের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বলেই তিনি নৌকাটিকে নিজেদের লঞ্চের সাথে বাঁধতে হুকুম দিলেন।ছয় জন মৌলি সহ লঞ্চ

নৌকাটিকে টেনে নিয়ে চললো নামখানা।


নামখানায় ফরেষ্ট লক আপে ছয়জন মৌলিকে রাখলেন। তাদের স্নান আহারাদির ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপর লঞ্চের মাঝিকে

ডাকলেন। মাঝি গোরাচাঁদ বাবু আসতেই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি এদের কাছ থেকে কত টাকা খেয়েছেন।?

-কেন স্যার আমি টাকা খাবো কেন? এ রকম কাজ আমি করিই না? আপনি শুধু শুধু আমাকে সন্দেহ করছেন।

-সন্দেহ নয় মাঝিবাবু। আমি নিশ্চিত আপনি এদের কাছ থেকে টাকা খেয়েছেন। তা না হলে আমি হাঁড়িভাঙ্গা খালে ঢুকতে চাইলেও

আপনি আমাকে অনেক ভাবেই নিরস্ত করতে চাইছিলেন। তখনি বুঝতে পেরেছিলাম ওখানে “ডাল মে কুচ কালা হ্যায়”।এটা

আপনার লাষ্ট ওয়ার্নিং। এরপরে এ রকম দেখলে আপনার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।

এরপর তিনি মৌলিদের ডাকলেন। তাদের ডেকে বললেন- আপনাদের কাছ থেকে কোন জঙ্গলের কাঠের নমুনা পাওয়া যায় নি।

তাই শুধু মাত্র সাধারণভাবে জঙ্গলে বিনা অনুমতিতে ঢোকার জন্য ডায়ারি করা হয়েছে। অপনাদের মুক্তি পেতে হলে ফরেষ্ট আইন

অনুযায়ী প্রত্যেককে দুই শত পঞ্চাশ টাকা করে জরিমানা দিতে হবে আর এক হাজার টাকা দিয়ে নৌকা ছাড়াতে হবে। যার নৌকা,

তাকে ছেড়ে দিচ্ছি। সবার বাড়িতে খবর দিয়ে টাকা আনুক। এখন বলো তোমাদের মধ্যে নৌকার মালিক কে?


দেখা গেল যে যুবকটি জঙ্গলে কথা বলেছিল, সেই হলো নৌকার মালিক। তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো সবার বাড়িতে খবর

দেওয়ার জন্য। সেইদিন বিকালে সবার বাড়ির লোক এসে জরিমানা দিয়ে নিজ্রদের লোকদের ছাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু নৌকার

মালিক যুবকটি এলো না।সন্ধ্যের একটু আগে যুবকটি এক মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে অফিসে এলো। মহিলাকে দেখেই পলাশ চমকে

উঠলেন। এ যে মল্লিকা!  যৌবনের মোহময়ী রূপ হয়তো নেই, তবুও তার শরীরের আকর্ষণ একটুও কমে নি!


মনে মনে পলাশবাবু যেন হারিয়ে গেলেন আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের জীবনে। তিনি তখন মাধ্যমিকে পড়তেন টি এস

সনাতন হাইস্কুলে আর মল্লিকা পড়তো পাশের শতদল গার্লস স্কুলে। পাশাপাশি দুটি স্কুল হওয়ায় দুজনের মধ্যে সখ্যতা, বন্ধুত্ব এবং

শেষে প্রেমের আবেশ গড়ে ওঠে। দুজনে কতদিন যে ব্যাজড়া কালী মন্দিরের চত্বরে গল্প করে কাটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।কিন্তু সেই

প্রেম বেশীদিন টেকে নি। মাধ্যমিক পাশ করার পর মল্লিকার বিয়ের তোড়জোর করে তার বাবা। সে কথা পলাশকে বলেছিল মল্লিকা।

কিন্তু তখন কিছুতেই বিয়ে করা সম্ভব ছিল না পলাশবাবুর। তাই অনেক কষ্টে মল্লিকাকে হারানোর ব্যথা ভুলেছিল পলাশবাবু।

তারপর আর খোঁজ রাখে নি মল্লিকার। আজ এতোদিন পর সেই মল্লিকার সাক্ষাৎ পেলেন পলাশবাবু। তাই কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন

বৈকি?


মল্লিকা পলাশবাবুর ঘরে ঢুকেই একেবারে অবাক হলেন। এ যে পলাশ! তার জীবনের প্রথম প্রেমিক! মল্লিকা বিচলিত হলেন।কি বলবে

এখন পলাশকে! সে যে এখন অভাগিনী। ভিখারিনী। ভাগ্যের পরিহাসে সে যে এখন দরিদ্র গৃহিনী! দারিদ্র যে এখন তার নিত্য সঙ্গী!

মনে মনে তিনি অত্যন্ত ভেঙে পড়লেন। এ জগতে নারী এক বিষম প্রানী। তার অন্তর প্রেমে পরিপূর্ন হউক, হিংসায় পরিপূর্ন হউক,

বিশেষ উন্মাদনায় পরিপূর্ন হউক অথবা গভীর শোকে পরিপূর্ন হউক কিছুতেই তার বহিঃপ্রকাশ হয় না। তাই বাহির থেকে বোঝা

যায় না প্রানীটির মধ্যে কি রকম আন্দোলন হচ্ছে।


এক্ষেত্রে পলাশবাবু মল্লিকার অন্তর পড়তে পারলেন না। কিন্তু মল্লিকা সহজেই পলাশবাবুর অন্তরটা পরিষ্কার দেখতে পেলেন।

পলাশবাবু

ইঙ্গিতে মল্লিকাকে বসতে বললেন। বেয়ারাকে চা আনতে বললেন। তারপর বললেন- বলো মল্লিকা, তোমার খবর কি?

-খবর আর কি? কিছুই না। আমার ছেলেকে ধরে এনেছো তাই তোমার কাছে আসা? এছাড়া আর কি খবর থাকবে বলো?

-মধু সংগ্রহ ছাড়া তোমার ছেলে আর কোন কাজ করতে পারে না?

-না।তার বাবা এই কাজ করতো। তার কাছ থেকে এই কাজ শেখা। এখন উনি অসুস্থ। তাই সংসারের হাল ছেলেকে ধরতে হয়েছে।

ছেলে ঐ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে আর পড়ে নি।বরং বলা ভালো আর পড়াতে পারি নি। তাই বাধ্য হয়ে বাবার পেশায় হাত লাগিয়েছে।

-এটা কোন কথা হলো! এ কাজের ভবিষ্যৎ আছে কি? এতে কিছুই হবে না। তুমি ওকে হাতের কাজ শেখাতে পারতে।তাতে  একটা

ভবিষ্যৎ ও গড়তে পারতো।

-কিন্তু ততদিন হেঁসেল চলবে কিভাবে?ওই জন্য ও কিছু করতে পারলো না।

-তোমার বাবা তোমায় এ রকম ঘরে বিয়ে দিলেন!

-বাবার কোন দোষ নেই। এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথম যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তিনি বাসর ঘরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

আমি হলাম অপয়া। অপয়া মেয়েকে কে আর বিয়ে করবে বলো। বাধ্য হয়ে এই সুন্দরবনে চলে এলাম দ্বিতীয় বিয়ে করে।আমি

দারিদ্রকে মাথা পেতে নিয়েছি।

-ছেলের নাম কি?

-তা তুমি ওকেই জিজ্ঞাসা করো? এতক্ষণ আটক রাখছিলে, ওর নাম এখনো জানা হয় নি!

-নামগুলো ছোটবাবু লিখেছে। আমার এখনো জানা হয় নি। এবার তিনি যুবকটির দিকে তাকিয়ে বললেন-তোমার নাম কি বাবু?

-আজ্ঞে আমার নাম পলাশ মন্ডল।

অবাক হলেন পলাশবাবু। তিনি বুঝতে পারলেন তাকে ভোলে নি মল্লিকা। তাদের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে ছেলের নাম রেখেছে

পলাশ! এই অবস্থায় মল্লিকার পাশে দাঁড়াতে হবে তাকে।তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হলেন।

এবার তিনি মল্লিকাকে বললেন-শোনো, তোমার ছেলে লথিয়ান দ্বীপে বিনা অনুমতিতে উঠেছিল। তাই তাদের অ্যারেষ্ট করা হয়েছে।

এখন নির্দিষ্ট পরিমান টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে।

-কত টাকা জরিমানা দিতে হবে?

-তুমি ছোটবাবুর কাছে যাও। উনি সব কিছু বলে দেবেন। এই কথা বলে তিনি মল্লিকাকে ছোটবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। 


মল্লিকা ছোটবাবুর চেম্বারে চলে যাওয়ার পর পলাশবাবু নিজের মানিব্যাগ থেকে মল্লিকাদের সমুহ জরিমানার টাকা বেয়ারার হাত

দিয়ে ছোটবাবুর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।তারপর সমস্ত কাগজপত্রে সই স্বাক্ষর করেমায়ে পোয়ে ঘর থেকে বের হলেন। এবার

পলাশবাবুর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। এবার মল্লিকাকে বিচলিত দেখালো যেন। পলাশবাবু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে

বললেন-মল্লিকা, ছেলের মাধ্যমিকের কাগজপত্র নিয়ে একদিন এসো তো আমার কাছে। সঙ্গে ছেলেকেও এনো। দেখি ওর জন্য কিছু

করতে পারি কিনা।


এবার পলাশবাবু তার চেম্বারে ঢুকে গেলেন। তিনি বড্ড ভালোবাসতেন মল্লিকাকে। আজ এই প্রায় বার্ধক্যের দ্বার প্রান্তে এসে

মল্লিকার এমন দারিদ্রে জীর্ণ অবয়বকে অবলোকন করতে হবে সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। তাই চেম্বারের জানালা দিয়ে মল্লিকার

গমন পথের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে পলাশবাবু। অতীত বর্তমান ভাবতে ভাবতে কখন যে তার চোখ থেকে দু’ফোটা

জল গড়িয়ে পড়েছে তিনি খেয়ালই করেন নি। খেয়াল হতেই তিনি নিজেকে গালি দিয়ে বললেন- শালা, পুলিশের চোখে আবার জল! 


( এই গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক।বাস্তবের সঙ্গে কোন কোন চরিত্র মিলে গেলে তা কাকতালীয় এবং অনিচ্ছাকৃত)

 

কপিরাইট@তারাপদ মাঝি

দেবনগর

০১/০৫/২০২০




কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.