মিথ্যে স্বপ্ন

আমার হাসপাতালে থাকার তিন দিনের পর আমার ঠিক পাশের বেডে এলো একটি কুড়ি বাইশ বছরের ছেলে। তার নাম আবুল হোসেন প্রামানিক। বাড়ি মগরাহাট।আবুল হোসেনের সঙ্গে এসেছে তার দাদা মানোয়ার হোসেন প্রামানিক। আমি ছেলেটিকে দেখছি। ভারি সুন্দর দেখতে। তবে শরীরের গড়ন মোটেই ভালো নয়। একেবারে রোগা পাতলা চেহারা। তবে মুখশ্রী খুবই ভালো। তার মুলত পেটের গন্ডগোলের সমস্যা। ছেলেটি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে আর তার শরীরে চলছে সেলাইন। তার দাদা তার সেবা যত্নের জন্য আছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে মানোয়ার আমাকে দেখেই আমার দিকে অবাক বিশ্ময়ে আকিয়ে রইল। আমি তার দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আমি তখন ভগবানকে তিরস্কার করতে লাগলাম। বললাম- ভগবান, আমার শরীরের এমন রঙ দিলে কেন? এ রকম কালো রঙ দেওয়ার জন্য মানুষের কাছে আমি হাসি ঠাট্টার পাত্র হচ্ছি। আমি মানোয়ারের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ রাখলাম।
আবুল হোসেন এসেছে সকালে। বিকালে এলো তার মা- যৌবন্নেসা বিবি। যৌবন্নেসা এসেই আমাকে দেখেই একেবারে যেন নিশ্চল হয়ে গেলেন। আমি মনে মনে খুব রাগ করলাম। না হয় উনাদের ভগবান একটু ফর্সা করে পাঠিয়েছে। তাই বলে এত দেমাক! আমি উনার দিকে আর তাকালাম না। যেমন মা তেমনি তার ছেলে।আমি ওদের এড়িয়ে যাবার জন্য ওদের বিছানার দিকে মাথা করে শুলাম যাতে ওদের দিকে আমার নজর না পড়ে। তারপর নিজের মতো করে কাজে অর্থাৎ মোবাইলের কারিগুরিতে মনোনিবেশ করলাম।
এমন সময় আবুল হোসেন ডেকে বললে- কাকু, আমাদের দিকে মাথা করে শুলেন কেন? আপনি উলটো দিকে মাথা করে শুলে আমাদের সুবিধে হয়। আপনার সঙ্গে কথা বলে একটু সময় কাটাতে পারি। কিছু না হোক আপনার কথা শুনলে সকলের মধ্যে বিশেষ এক শক্তির সঞ্চার হয়। তাই দয়া করে আগের মতোই আপনি থাকলে আমরা আপনার সান্নিধ্য পাবো এবং আপনার সঙ্গে গল্প করতে পারবো।
আমি আবার পূর্বের অবস্থানের মত শুলাম। অমনি আবুল হোসেন বললে- কাকু, এই ওষুধ কি রকম খেতে হবে একটু বলে দিলে ভালো হয়। আমি বললাম- ওটা নার্স দিদিদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। কারণ ওষুধের প্রেসক্রিপশান নার্সদের কাছে আছে। ফলে খাবার নিয়ম কানুন ডাক্তার ভিজিট বুকে লিখেছ। নার্সদের বললে তারা ওষুধ খাওয়ার সব নিয়ম কানুন জানিয়ে দেবেন। খানিকক্ষণ পর নার্স দিদি এলে তার কাছ থেকে ওষুধ খাওয়ার নিয়ম জেনে নেওয়া হয়। অবশ্য নার্স যখন আসেন তখন আবুল ঘুমাচ্ছিল। আমি তার মাকে জানাতেই তার মা আমার হাতে ওষুধগুলো দিয়ে বললে-আপনি একটু জেনে নেন কিভাবে ওষুধগুলো খাবে। আমাকে বললে আমি মনে রাখতে পারব না। অগত্যা নার্সের কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমি সেই নিয়ম আবুলের মাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম।
সেই দিন রাতে আবুলের মা কিছুতেই ঘুমাতে পারলো না। কারণ বিছানা ছোট হওয়ায় যেমন শোয়ার জায়গার অভাব, তেমনি আবুলের সেলাইন এর দিকে খেয়াল রাখার দায়িত্বও রয়েছে। আমি অনেক রাত অবধি ঘুমাতে পারছিলাম না। কারণ বুকের বাঁ দিকে মৃদু যন্ত্রনা হচ্ছিল। ফলে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। আমি বাধ্য হয়ে মোবাইল নিয়ে কারিগুরি করছিলাম। এমন সময় আবুলের মা বললেন-অনেক রাত হয়েছে। আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন?
-কি করবো? ঘুম তো কিছুতেই আসছে না।
-কেন? কোন সমস্যা হচ্ছে?
-না, তেমন কোন সমস্যা নয়। বুকের বাঁদিকে একটু মৃদু যন্ত্রনা হচ্ছে। তাই বোধ হয় ঘুম আসছে না।
-তাহলে নার্স দিদিকে বলুন। কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন।
-এখন রাত প্রায় ১.০০ টা। এখন নার্সকে জ্বালিয়ে লাভ নেই। সারাদিন কাজ করে তারা ক্লান্ত। এখন হয়তো তারা ঘুমোচ্ছেন। এখন তাদের বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না।
-আপনি তো এমনি এমনি বিরক্ত করবেন না!আপনার সমস্যা হচ্ছে বলেই না বিরক্ত করবেন। আচ্ছা দাঁড়ান, আমি দেখছি।
আমি আবুলের মা'কে অনেকভাবে বারণ করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনি শুনলেন না। উনি নার্সের কাছে গেলেন। আমার কাছে আমার ভাইপো ছিল। তার ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে বলে এবং আমি বেশ খানিকটা সুস্থ্য আছি মনে করে তাকে হাসপাতালের কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি রাতটুকু কাটানোর জন্য। তাছাড়া অসুস্থ্য মানুষ না হয় বেডে সারাদিন শুয়ে বসে থাকতে পারে। কিন্তু সুস্থ্য মানুষের পক্ষে কখনো এক জায়গায় বসে থাকা সম্ভব নয়। এই ভেবেই আমি তাকে স্বাধীনতা দিয়েছি যাতে সে তার ইচ্ছাখুশি মতো এদিক ওদিক ঘুরতে পারে। আমার প্রয়োজন হলে তাকে ফোন করে ডেকে নেই। কিন্তু এত রাতে তাকে ফোন করলেও সে আসতে পারবে ন। তাই যন্ত্রনা সহ্য করে চুপচাপ আছি। কিন্তু আবুলের মা কিছুতেই এটা মানলেন না এবং তিনি নার্সকে ডেকে এনে আমার সমস্যার সব কিছু বলিয়ে ছাড়লেন।
নার্স সবকিছু শুনে চেম্বারের গেলেন এবং মিনিট দশেক পর ফিরে এলেন। তিনি আমাকে একটি ট্যাবলেট খাওয়ালেন আর একটি ট্যাবলেট জিহ্বার তলায় রাখতে বললেন। তারপর বললেন- মোবাইল বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন। আপনি সবসময় রাত ১০.০০ টার সময় ঘুমাতে যাবেন। কিছুতেই রাত করবেন না।
নার্স চলে যেতে আবুলের মা আমাকে ঘুমাতে বললেন। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। এবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। এবং কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা বুঝতে পারলাম না। ঘুম যখন ভাঙলো তখন সকাল ৮.০০ টা। গভীর ঘুমে শরীর বেশ তরতাজা হয়েছে এবং বুকের সেই মৃদু যন্ত্রনা আর নেই। প্রথমেই চোখ পড়লো আবুলের দিকে। দেখি সে উঠে বালিসে হেলান দিয়ে বসে আছে। এবার তার মায়ের দিকে চোখ পড়তেই আমি মৃদু হেসে বললাম- রাতে মনে হয় ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল। তাই ভালো ঘুম হয়েছে।
- আবুলের মা বললেন- সে ঘুম না হয় ভালো হয়েছে। কিন্তু বুকের যন্ত্রনা কি আর হচ্ছে?
- না, যন্ত্রনা আর হচ্ছে না। তবে আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করি। দেখি যন্ত্রনা আর ফেরে কি না।
এবার আবুলের মা বললেন- আপনার ভাইপো এখনো আসে নি। অথচ হাসপাতালের টিফিন দিতে এসেছিল। আমি আপনার টিফিন ধরে আপনার থালায় রেখেছি। তাছাড়া নার্স এসেছিল ওষুধ নিয়ে। দুটো ট্যাবলেট দিয়েছিল। সেটা আপনার বালিশের তলায় রেখেছি। ইঞ্জেকশান ছিল। নার্স দিদি আপনাকে না জাগিয়ে দিয়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ওষুধ খেয়ে নিন।
আমি ভদ্রমহিলার ব্যবহারে খুব মুগ্ধ হলাম। মনে মনে ভাবলাম- যে মেয়ে আমাকে কালো বলে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, সেই মেয়ে আবার আমার সেবা করে! সত্যি নারী চরিত্র কিছুতেই বোধগম্য নয়।
আমি তাড়াতাড়ি দাঁত মেজে টিফিন খেতে গিয়ে দেখি আমাকে টিফিনের জন্য একটি ডিম সেদ্ধ, দুটি কলা আর চারটে বিস্কুট দিয়েছে। আমি শুধুমাত্র ডিমের সাদা অংশটাই খাই। তাই ডিমটা নষ্ট না করে আবুলের মাকে বললাম-ভাবী, আমার তো ডিম খাওয়া বারণ। ডিমটা আবুলকে খাইয়ে দিন। ওর পায়খানা হয়ে হয়ে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে।
-আবুলের মা ডিম নিলো। তারপর আমাকে আবুলের দুটো কলা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন- আবুল আমার ছোট বেলা থেকে কলা খায় না। কিন্তু ডিম খুব পছন্দ করে ও। আপনি যখন ওকে আপনার ডিম দিলেন তখন ওর কলা দুটো আপনি খাবেন কি?
বললাম- আবুল না খেলে আপনি খেয়ে নিন। আমি একা চারটে কলা খেতে পারব না।
-জানি আপনি একথা বলবেন। তবু একবার বলে দেখলাম।
-কি করে বুঝলেন? আমি জিজ্ঞাসা করতেই আবুলের মা স্মিত হেসে বললেন- যতই আমাদের মধ্য বন্ধুত্ব হোক না কেন, আসলে আমরা পরষ্পর ভিন্ন জাত। পরষ্পরের ছোঁয়ার উপরে বাধা তো থাকবেই।
-আমি মর্মাহত হলাম এবং আবুলের মাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উনার হাত থেকে কলা কেড়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। তারপর বললাম- এমন করে বলবেন না ভাবী। মানুষকে ঘৃনা করা মহাপাপ।
-তাহলে আপনি মুসলমানকে ঘৃনা করেন না বলছেন?
-একেবারেই না। মানুষকে মানুষ কোন দিন ঘৃনা করে?এই আধুনিক সভ্যতার যুগে আমরা কি এই শিক্ষা পেয়েছি!
এবার আবুল বললো- না কাকু, আপনি সে রকম না। আজ তিন দিন ধরে আপনাকে দেখছি। আপনি একেবারে অন্যরকম। আসলে কলা দুটো আপনাকে খাওয়ানোর জন্য মা আপনাকে এসব কথা ইচ্ছা করে বলেছে। আপনি সে রকম হলে মা আপনার সঙ্গে কথাই বলতেন না।
এবার আবুলের মা এক হৃদয় জুড়ানো হাসি দিয়ে বললেন-আজ আমাদের বাড়িতে কাতলা মাছ রান্না হচ্ছে। আপনি তো হোটেল থেকে খাবার এনে খান। আজ আমাদের আনা ভাত খাবেন কি? তাহলে একজনের জন্য বেশী করে আনতে বলবো।
আমি কিছু বলার আগে আবুল তার মায়ের উপর রেগে বললে- তুমি ওরকম বলছো কেন? ভাত আনলে কাকু ঠিক খাবে। আমি বাইরে কাজ করতে যাই মা। মানুষ দেখলে চিনতে পারি। উনি একেবারে অন্য রকম মানুষ।
এবার আমি বললাম- আপনি এত ভালোবেসে আমাকে খাওয়াবেন আর আমি না বলবো তা কি হয়? আমি কখনো জাত পাতে বিশ্বাস করি না। আপনি আনুন। আমি হৃদয় দিয়ে খাবো।
সেদিন ছিল বৃহষ্পতিবার। আবুলের মা আমাকে কাতলা মাছের ঝাল আর শোল মাছের কালিয়া খাওয়ালেন। কিন্তু আশ্চর্য এই যে প্রত্যেকটা মেনুতে তেলের পরিমান আশ্চর্য রকম ভাবে কম। সাধারণত মুসলিম পরিবারে রান্না হয় মাত্রাতিরিক্ত তেল মশলা দিয়ে। আমার বিভিন্ন রকম রান্নার প্রতি ভীষণ লোভ। সেই হিসাবে মুসলমানের বাড়িতে আমি প্রচুর খেয়েছি। তাতে দেখেছি খুব কম মুসলিম পরিবার কম তেলের সাহায্যে রান্না করেন।
আমি খাওয়া শেষ করে বললাম- ভাবী, খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম। খাওয়াটা বেশ তৃপ্তিদায়ক হয়েছে এই জন্য যে আপনারা বেশ কম তেল দিয়ে রান্না করেছেন।
-তখন আবুলের মা বললেন-আবুল যখন আমার পেটে ছিল, তখন ওর বাবা আপনার মতো হার্টের ব্যামোতে মারা গেছেন। উনিও আপনার মতো বেশ কয়েক বছর হার্টের ব্যামোতে ভুগছিলেন। তখন ডাক্তারের নির্দেশে আমাদের বাড়িতে তেল খাওয়া কমিয়ে দেওয়া হয়। উনি মরে যাওয়ার পরও সেই অভ্যাস আমরা চালিয়ে আসছি।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবছিলাম প্রায় তিন দিন হয়ে গেল। আবুলের দাদা ছাড়া পরিবারের আর কেউ আসছে না কেন? তাহলে কি আবুলের মাকে ওর বাবা তালাক দিয়েছেন?আমি ভেবেই কিছু বুঝতে পারি নি এবং এ বিষয়ে আবুলকে বা তার মাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহস পাইনি। ফলে এ বিষয়ে আর মাথা ঘামাইনি। কিন্তু আজ যখন শুনলাম উনি স্বামী হারা আর আবুল পিতৃ হারা, তখন আমার খুব খারাপ লাগলো। আবুলের মায়ের বয়স কতই আর হবে? খুব বেশী হলে পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। দেখতে একেবারে করিণা কাপুরের মতো। অর্থাৎ আজ কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে বৈধব্য যন্ত্রনা ভোগ করছেন উনি। আমি অত্যন্ত দুঃখ পেলাম। কিন্তু কিছু তো করার নেই। ভগবান যার ভাগ্যে যা লিখেছেন, তাই তাকে ভোগ করতে হবেই হবে।
পরের দিন শুক্রবার। আবুলের মা বাড়ি থেকে আনালেন বোয়াল মাছের ঝাল আর পাবদা মাছের টক। আমি কথায় কথায় মাছের টকের কথা বলেছিলাম বলে উনি পাবদা মাছের টক আনিয়েছিলেন। সেই দিন সকালে ডাক্তারবাবু জানিয়েছিলেন যে আজ বিকালে আমাদের ছুটি হয়ে যাবে। ফলে বেশ জমিয়ে খাওয়ার পর বেশ একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ঘুম ভাঙলো আমার ভাইয়ের ডাকে।ইতি মধ্যে আমার ভাই পো বাড়ি গেছে। তার পরিবর্তে এসেছে আমার ভাই। আমার ভাই জানালো যে আমার ছুটি হয়ে গেছে এবং সে ইতিমধ্যে বাড়ি থেকে গাড়ি পাঠাতে বলেছে যাতে গাড়ি বিকাল ৫.০০ টার মধ্যে পৌছে যায়। আমরা ঘন্টা খানেক পর অর্থাৎ পাঁচটার দিকে সব কিছু গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমার ভাই হাসপাতালের খাতায় সই করতে গেল। আমি পাশাপাশি রোগীদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। হাজার হোক বেশ কয়েকদিনে সকলেরব সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল। সব শেষে আবুলকে বললাম- শরীরের দিকে খেয়াল রাখবে আবুল। আশাকরি তাড়াতাড়ি তুমি সুস্থ্য হয়ে উঠবে। আবুল বললে- কাকু আমার তো রোগ। একদিন না একদিন আমি সেরে উঠবই। কিন্তু আপনার তো ব্যাধি। ও তো সারে না। কেবলমাত্র ওষুধ খেয়ে দমিয়ে রাখতে হয়। সুতরাং আপনি নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন। আর ভালো ডাক্তার দেখাবেন।
এবার আমি বললাম- তোমার মা কোথায় গেলেন আবুল? আমি তো বাড়ি যাবো। তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা না করে গেলে হবে?
-আপনি বাড়ি চলে যান কাকু। মায়ের সঙ্গে আপনার দেখা হবে না। আবুল কিছুটা শুকনো হাসি হেসে বললে।
-কেন দেখা হবে না? উনি কি বাড়ি গেছেন? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
-না, উনি বাড়ি যান নি। আপনি বাড়ি যাবেন শুনে বাইরে কোথাও ঘুরতে গেছে। উনি চান না আপনি চলে গেলে চোখের জল ফেলতে।
- আমই অপ্রস্তুত হলাম। বললাম- কেন উনি চোখের জল ফেলবেন?
তখন আবুল যা বললো তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। আবুল বললো- আপনি একেবারে আমার মৃত আব্বার মতো নাকি দেখতে! আমার যখন জন্ম হয় নি তখন আব্বা মারা গেছেন। ফলে আমি জানি না আব্বাকে কেমন দেখতে। তবে দাদা আর মা বলছিল যে আপনি নাকি হুবহু আব্বার মতো দেখতে। সেই জন্য দাদা আর মা আপনাকে দেখেই অবাক হয়ে গেছিলেন আর আপনার দিকে তাকিয়ে আব্বার সঙ্গে মিলাচ্ছিলেন। এবার বুঝলেন তো কেন মা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান না।
আমি আগেই বলেছি যে এই ঘটনার জন্য একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। এই কথা শোনার পর আমার কি করা উচিত তা আমি ঠিক করতে পারলাম না। তাছাড়া আবুলের কথাগুলো পাশের বেডের লোকেরা শুনছিল। আমিও অপ্রস্তুত হচ্ছিলাম। বাধ্য হয়ে আবুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম- আমি চললাম। ভালো থেকো। অজান্তে তোমাদের যদি দুঃখ দিয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা করো।
আমি আর আমার ভাই হাসপাতাল থেকে বের হলাম। আমার মন কাউকে যেন খুজছিল। তাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। এমন সময় দেখলাম একটি ছোট্ট দোকানের পাশে আবুলের মা দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানা অবগুন্ঠনে ঢাকা। না জানি ওই রমনীর হৃদয়ে কত দুঃখের বেদনা আজ প্রষ্ফুটিত হচ্ছে! কিন্তু আমারও বা কি করার আছে? আমি যদি আগে জানতাম এমন ইতিহাস, তাহলে কি উনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইতাম! শুধু কাতর হৃদয়ে সেই শর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে আমার এই অভিপ্রায় জানালাম যে- হে আল্লা, এই পিড়িত মনের রমনীকে শান্তি দিন যাতে তিনি তার বাকি জীবন সুখে আর শান্তিতে অতিবাহিত করতে পারেন।
আমার গাড়ি যাত্রা শুরু করলো। আমি ক্রমশ ম্রিয়মান আবুলের মায়ের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালাম যে তিনি যেন এভাবে আমাকে বিড়ম্বনায় না ফেলেন।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
২৫ শে এপ্রিল,২০২১
দেবনগর।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.