#ভালোবাসা_ছাড়া আর_আছে_কি?

চারিদিকে রোগীর আর রোগীর আত্মীয়ের আর্তনাদ। কখনো শুনতে পাই স্বজন হারানো মানুষের ক্রন্দনরোল। আবার মাঝে মাঝে নতুন রোগীর আগমনে বেড়ে যায় জনকোলাহল। পশ্চিমে মস্তক রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি আর এই সব শব্দব্রম্ভের উত্তাপ অনুভব করছি। নিজের হৃদয়ের বিদ্রোহ সত্বেও এই সব হৃদয় বিকল করা এবং হৃদয় উদ্বেলিত শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করাতে বাধ্য হচ্ছি।
এমন সময় আমার বিছার পাশে খালি বিছানায় এলেন প্রায় আঠান্ন ষাট বছরের এক ভদ্রলোক। গায়ে সাদা পাঞ্জাবী, পরণে বাঙালি ধূতি। মাথার আধ পাকা কেশদাম রোগ যন্ত্রনায় অবিন্যস্ত। গায়ের রঙ একেবারে ফর্সা। তবে অবয়ব দেখে মনে হলো যে ভদ্রলোক একেবারে সাদা সিধে কৃষকই হবেন এবং পরবর্তীকালে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে আমার অনুমান একেবারে সত্য।
যাইহোক ভদ্রলোক শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এবং অনেক কষ্টে তিনি শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছেন। এই কাজটি করতে গিয়ে তাকে অনেক কষ্টে হাপরের মতো বুকের পাঁজর দুটিকে ওঠাতে নামাতে হচ্ছে। তাঁর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল যে এখুনি যদি উনাকে অক্সিজেন না দেওয়া হয়, তাহলে উনার শ্বাস কষ্টে পঞ্চত্ব প্রপ্তি ঘটবে।
উনার সঙ্গে এসেছেন উনার স্ত্রী এবং দুই ছেলে। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী পুরুষদের কাছে কেবলমাত্র পুরুষই থাকতে পারেন। কিন্তু রোগীদের পরিবারের কথা ভেবেই এই ডায়মন্ডহারবার হাসপাতালে পুরুষদের কাছে নারী থাকতে পারেন যদি তাদের পরিবারে হাসপাতালের নিয়ম মানার মতো প্রয়োজনীয় পুরুষ না পাওয়া যায়। সেই হিসাবে পাশের ভদ্রলোকের কাছে তার ছেলেরা থাকতে চাইলেও ভদ্রলোক কান্নাকাটি করতে লাগলেন যাতে তার কাছে তার স্ত্রী থাকেন। ছেলেরা আলোচনা করে তাদের বাপের কাছে তাদের মাকে রেখে যেতে চাইলেন। ভদ্রমহিলা বিনা প্রতিবাদে স্বামীর কাছে স্বামীর সেবায় থাকলেন।
ভদ্রমহিলার বয়স খুব বেশী হলে পঞ্চাশ বা একান্ন বছরের হতে পারে। ফর্সা এবং বেশ সুশ্রী। উনার কথা বার্তায় বেশ মাধুর্য্যভাব আছে এবং কথা বলার গুনে সবাইকে আকৃষ্ট করার মতো একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতাও আছে। কারণ উনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি কেমন যেন উনার প্রতি বেশ সহানুভুতিশীল হয়ে পড়েছি। উনার সঙ্গে আলাপ করে জানলাম উনার নাম পার্বতী এবং উনার স্বামীর নাম বিশ্বনাথ হালদার। ইতি মধ্যে আমি উনাকে বৌদি বলে এবং ভদ্রলোককে দাদা বলে ডাকতে শুরু করেছি।
আমি মাঝে মাঝে মোবাইল নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাটি করি। তারপর বিরক্ত হয়ে মোবাইল ফেলে পাশের বেডের রোগীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে থাকি। একরাত অক্সিজেন খাওয়ার পর, বিশ্বনাথবাবু অনেকটা সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। তাই আলাপ জমাতে অসুবিধা হল না।
বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- দাদা, আপনার বাড়ি কোথায়?
-সাধুরহাটে। ভদ্রলোক উত্তর দিলেন।
-ছেলে মেয়ে ক’জন?
-দুই ছেলে আর এক মেয়ে।
-ছেলে মেয়েরা কে কি করে?
- বড় ছেলেটি একটি লেদ কারনায় এবং ছোট ছেলেটি একটি গ্রীল কারখানায় কাজ করে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।
-জমি জমা কি বিশেষ কিছু নেই?
- না,আছে তো! আমার পরিবারে বিঘে দশেক জলজমি অর্থাৎ চাষ জমি আছে আর বাস্তু ভিটে বিঘে পাঁচেক হবে।
বুঝলাম অবস্থা খুব একটা খারাপ নয়। কিন্তু অবস্থা যাইহোক না কেন, এসব নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজন আমার নেই। আমার শুধু ভালোভাবে সময় কাটানোর জন্য সাহচর্যযোগ্য মানুষের প্রয়োজন।
এবার বিশ্বনাথবাবুর স্ত্রীকে বললাম-বৌদি, দাদাকে তো বেশ ভালবাসেন দেখছি?
-কি যে বল না ভাই। আমরা বুড়ো হয়েছি। এখন নিজদের ভালো মন্দ আমাদের নিজেদেরকে দেখতে হবে।
-বললাম- সে হয়তো ঠিক। কিন্তু ক’ জন স্ত্রী এভাবে স্বামীর সেবায় থাকেন বলুন। আপনি এই বয়সে যেভাবে স্বামীর যত্ন আত্তি করছেন, তা দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি।
-পার্বতী দেবী বললেন- স্বামীর সেবা আমাকে করতেই হবে। আমাকে ছাড়া উনি একবিন্দু থাকতে পারেন না। সে আজ বলে নয়, চিরদিনই মানুষটা এই রকম। আমাকে ছাড়া কোন দিন আত্মীয়ের বাড়িতে উনি যান না। মাঝে মাঝে বিরক্তি হলেও কিছু বলতে পারি না।
-এবার বিশ্বনাথবাবু বললেন- কি করি বল দেখি ভাই। বিয়ের পর থেকে আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারি না। ও যে রকম বলে, আমি সে রকম চলি। ও ভুল বললে দু’জনে আলোচনা করে তবে সিদ্ধান্ত নেই। আসলে ওর মতো স্ত্রী পাওয়া ভাগ্যের। ও সংসারে আসতেই আমার সংসারে উন্নতি হয়েছে। তাছাড়া আমৃত্যু আমার বাবা- মাকে যেভাবে ও সেবা যত্ন করেছে, তাতে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি।
-এবার পার্বতী দেবী বললেন-তুমি মোটেই বোকার মতো কথা বল না। শ্বশুর শাশুড়ীকে যদি আমি না দেখি, তবে দেখবে কে? তোমার তো আর ভাই নেই। তাছাড়া ভাই যদি থাকেই, তাহলেও আমার কাজ আমাকে করতে হবে।
-তুমি ভালো মেয়ে বলে এ সব কথা বলছো। আজ কাল দেখতে পাওনি ছেলে বউরা কি রকম আচরণ করছে?
এমন সময় বিশ্বনাথবাবুর বড় ছেলে এলেন। হাতে খাবারের কন্টেনার। বিশ্বনাথবাবু আর পার্বতী দেবীর জন্য বাড়ি থেকে খাবার এনেছেন ছেলে। এবার পার্বতী দেবী ছেলেকে বললেন-তুই আমার জন্য খাবার আনতে গেলি কেন? আমি ভাবছিলাম-তুই বাপের কাছে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত থাকলে, আমি বাড়িতে গিয়ে একটু স্নান সেরে ঘুমিয়ে নিতাম। তারপর সাতটার দিকে আমি এখানে চলে আসতাম।আমি এলে তুই বাড়ি চলে যেতিস।
ছেলে বললে- তুমি চলে গেলে আমি বাবাকে রাখতে পারবো? উনি তো তখন কান্না জুড়ে দেবে? তুমি বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, উনি থাকতে পারবেন কি না?
-এবার পার্বতী দেবী বিশ্বনাথবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন-কি গো এটুকু সময় তুমি থাকতে পারবে না?
দেখলাম- বিশ্বনাথবাবু অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। চোখে তার অশ্রুর আগমন বার্তা।
-এবার পার্বতী দেবী বললে-থাক, আমি আর যাবো না। তুমি এ রকম ছেলে মানুষের মতো কাজ করলে চলবে? আজ আমি বেঁচে আছি। কাল যদি মরে যাই তখন তুমি কি করবে?
-এবার বিশ্বনাথবাবু হেসে বললে-তার আগে আমার মৃত্যু হবে। কিংবা তোমার মৃত্যুর সঙ্গে আমারও মৃত্যু হবে।
এবার চেলে বললে-ওসব মরার চিন্তা ছাড়ো। তোমরা স্নান সেরে খেয়ে নিলে আমি বাড়ি চলে যাই। এখানে তো আমাকে বেশীক্ষন থাকতে দেবে না।
বেশ দিন তিনেক হয়ে গেল। বিশ্বনাথবাবু আর পার্বতী দেবীর সঙ্গে আমার বেশ আলাপ জমে গেছে। যেহেতু আমি উনাকে বৌদি বলি, উনি আমাকে ঠাকুরপো বলেন। উনাদের সঙ্গে এত খাতির জমে গেছে যে আমাকে আর দু,বেলা হোটেল থেকে খাবার এনে খেতে দেয় না। বলেন-হোটেলের খাবার খেয়ো না ভাই। তোমার এমনিতেই হার্টের ব্যামো। আমরা তোমার জন্য আমার বাড়ি থেকে খাবার এনে দিচ্ছি। তুমি তাই খেয়ো। এটা তুমি আমাদের দয়া বলে মনে করো না। মনে রেখো তুমি পূর্ব জন্মে কোন না কোন ভালো কাজ করেছো। তাই আমাকে দিয়ে ঈশ্বর তোমার জন্য খাবার পাঠাচ্ছেন। উনার ছেলেও উনাকে সমর্থন করলে। বললে-কাকু, চিন্তা করবেন না। আমি দু’জনের খাবার আনছি। ঐ সঙ্গে আর একজনের আনতে কোন অসুবিধা হবে না। মঙ্গলময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আমার বিপদের দিনে ঈশ্বর আমার জন্য খাবার এনে দিচ্ছেন। আমি মনে মনে তাঁকে প্রণাম জানালাম।
চতুর্থদিনে বিশ্বনাথদা বাড়ি চললেন। সকালে সবকিছু গোজ গাজ করে নিলেন। সকাল আটটার দিকে ডাক্তার এলেন এবং কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বিশ্বনাথদাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেন। বিশ্বনাথদার ছেলে দোকান থেকে ওষুধ কিনে আনলেন। আমি সেগুলিকে পড়ে কাগজে সুন্দর করে লিখে দিলাম যাতে কোনভাবে পড়তে অসুবিধা না হয়। সঙ্গে শ্বাস কষ্টের জন্য কিভাবে ইনহেলার নিতে হয় তা আমি দেখিয়ে দিলাম। আমার মেয়ের যখন কফ কাশি হতো, তখন তাকে ইনহেলার দিতে হতো। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লাগালাম। চলে যাওয়ার সময় দেখলাম দাদা বৌদির চোখ জলে ভরে গেছে। দাদা বললে- কি জানি ভাই, আগের জন্মে তুমি আমার মায়ের পেটের ভাই ছিলে কিনা। মনে হয় আমি তোমার সঙ্গে কোন রুঢ় ব্যবহার করেছিলাম। তাই আজ দু’জনকে দুই মায়ের পেটে জন্ম নিতে হয়েছে।
আমি গম্ভীর পরিবেশকে হাল্কা করার জন্য এবং নিজেকে আবেগের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য রসিকতা করে বললাম- না দাদা, আমরা এক মায়ের পেটে দুই ভাই ছিলাম না। আমরা দুই ভাই হলে আমাদের গায়ের রঙ একই হতো। হয় দুজনেই ফর্সা, নয় তো কালো হতাম। কিন্তু তুমি ফর্সা আর আমি কালো। তাই….
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় বৌদি বললে- আর দুষ্টুমি করতে হবে না ভাই। আমাদের বিদায় দিও। আমাদের নম্বর তো তোমার কাছে রইল। অসুবিধা হলে ফোন করবে। আমার ছেলেরা এসে তোমায় সাহায্য করার চেষ্টা করবে।
আমি অনেক কষ্টে চোখের জল সামলে তাদের বিদায় জানালাম। যাবার সময় পার্বতীদি পাশের বেডের যৌবন্নেসা বৌদিকে বললে- অসীম তোমারও তো ঠাকুরপো হয়। এতদিন আমি দেখেছিলাম। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি একটু দেখো ভাই।
এমন সময় যৌবন্নেসা বৌদির ছেলে শেখ হাসান বললে-আপনি চিন্তা করবেন না মাসি। আসীম কাকু বেশ ভালো মানুষ। উনি আমাদেরকেও খুব ভালোবাসেন। আমরা উনার ভালো মন্দ না দেখলে হবে?
পৃথিবীতে বর্নভেদ, জাতিভেদ,ঐশ্বর্য্যভেদ তখনই সৃষ্টি হয়, যখন মানুষের সঙ্গে স্বার্থ সংঘাতে ভালোবাসা হারিয়ে যায়। একমাত্র ভালোবাসার দ্বারা পৃথিবীতে সবকিছু করা সম্ভব।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি,
দেবনগর
১৬ই এপ্রিল,২০২১ খ্রীষ্টাব্দ।

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.