#ভূতের_সঙ্গে_মাছ_ধরা

#ভূতের_গল্প

#ভূতের_সঙ্গে_মাছ_ধরা

#কৃষ্ণদ্বৈপায়ন





সময়টা শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি হবে। একেবারে ভরা শ্রাবণ। সারাদিন ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। কেউ বাড়ির বাইরে বেরতে

পারছিলাম না। তখন খুব ধনী লোকেরা ছাড়া  কেউ ছাতা ব্যবহার করতো না। সমাজের বেশীরভাগ মানুষ তখন সস্তায় তালপাতা

র তৈরী পেখে( কেউ কেউ বলতো পাখিয়া) ব্যবহার করতো। আমিও একখানা পেখে মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের পথে। 


ছেলেবেলা থেকে মাছ খাওয়ার থেকে মাছ ধরার নেশা আমার সবচেয়ে বেশী। তাই বর্ষার সময় বেরিয়েছি কোথায় কোথায় মাছ

ধরার উৎস পাওয়া যায়। এমনিতে কলেজে পড়ার জন্য এখন কোলকাতাতে থাকতে হয়। তাই মাছ ধরার সুযোগ খুব একটা

পাচ্ছিলাম না। কিন্তু এই শ্রাবণ মাসে বাড়িতে এসে বর্ষায় বন্দী হয়ে যাওয়াতে মাছ ধরার নেশাটা আবার বেশ চাগাড় দিয়ে উঠল।

বর্ষায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম গ্রামের শেষপ্রান্তে অনেক দূরে বর্ষার জল ভোল দিয়ে বেরিয়ে ক্যানেলে গিয়ে পড়ছে।তারপর ক্যানেলের

জল সুইলিশ গেট দিয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে। যেখানে জলাজমি বা ধান জমির জল ভোল দিয়ে ক্যানেলে গিয়ে পড়ছে, সেই ক্যানেলে

যদি ঝাঁকি জাল( খেপলা জাল) দেওয়া যায়, তাহলে ভালো মাছ পড়তে পারে। এই ভেবে আমি তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসে ঝাঁকি জাল

নিয়ে চললাম।


ক্যানেলের জায়গাটি অনেক দূরে। আমি প্রায় চারটের দিকে ক্যানেলে ঝাঁকি জাল নিয়ে পৌঁছলাম। আমি পরেছি একখানা শর্ট প্যান্ট,

গায়ে একখানা স্যান্ডো গেঞ্জি, মাথায় গামছা জড়ানো, কমরে মাছ রাখার জন্য একখানা লাইলনের ব্যাগ ঝুলানো, মাথায় বৃষ্টি থেকে

বাঁচার জন্য পেখে চাপানো আর হাতে ঝাঁকি জাল। এই বিভৎস সজ্জায় দেখলে যে কেউ হেসে গড়াগড়ি যাবে। যাই হোক আমি

ক্যানেলে জাল ফেলতে শুরু করলাম।


জাল টেনেই আমি একেবারে অবাক! একি! এত চিংড়ি মাছ এসেছে! সবগুলো কড়ে চিংড়ি( কেউ কেউ হরিণে চিংড়িও বলে)! প্রথম

বারেই প্রায় পাঁচশো গ্রাম মতো।বার তিনেক জাল দেওয়ার পর আমার ছোট্ট লাইলনের ব্যাগটি ভর্তি হয়ে গেল। আমি মাছ রাখতে

বাড়িতে এলাম। বাড়িতে মাছ রেখে বড় লাইলনের ব্যাগ নিলাম।দ্রুত বেগে আবার ক্যানেলের কাছে চললাম।


কিন্তু আমার কপাল খারাপ। আমাকে ভাগ ভর্তি মাছ নিয়ে ফিরতে দেখে বাগদি পাড়ার লোকেরা সবাই ঝাঁকি জাল নিয়ে আমার

আগেই ক্যানেলে পৌছে গেছে! প্রায় জনা দশেক লোক! আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। কি আর করি? বাধ্য হয়ে বাড়ি

ফিরলাম।বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে ভাজা একেবারে মুচমচে কড়ে চিংড়ি খেতে লাগলাম।


 আমি সিদ্ধান্ত নিলাম রাতে ওখানে জাল ফেলতে যাবো। তখন কেউ থাকবে না। সবাই ভূতের ভয়ে রাতে ওখানে কেউ যায় না।

ওখানে নাকি রাতে ভূতেদের আড্ডা হয়। আমি এই সুযোগটাই নিতে চাই। আমি ওসব ভূত টুতে বিশ্বাস করি না। তারপর ঠিক

সন্ধ্যে সাতটার দিকে আবার সেজেগুজে বের হয়ে পড়লাম। আমাকে বেরুতে দেখে মা বললে-কোথায় চললি খোকা?

-কোথায় আবার!  মাছ ধরতে।

-এই রাতে কোথায় জাল ফেলবি?

-কেন, সেই ক্যানেলে। রাতে ভূতের ভয়ে কেউ থাকবে না। একা জমিয়ে মাছ ধরা যাবে।

-তুই ক্ষেপেছিস খোকা? ওখানে রাতে কেউ যায়! যত অশরিরী আত্মারা ঘোরা ফেরা করে। ওখানে লোকে দিনের বেলা যেতে ভয়

পায়! আর তুই কিনা রাতের বেলা যাবি! 

-বললাম-দেখি তো কেমন দেখতে ভূতেদের। ভূতেদের সঙ্গে আজ মাছ ধরবো। ভূত আমার কি ক্ষতি করে দেখবো।


বাবা মা আমাকে অনেক বাধা দিলেন। কিন্তু আমি কারও বাধা শুনলাম না। ওনারা যত বাধা দিতে লাগলেন, আমার তত জেদ

চেপে বসলো। ভূতের ভয় পাওয়া মানে আমার শিক্ষা দীক্ষা আর সংস্কারে কুঠারাঘাত করা। সবাইকে অগ্রাহ্য করে মাছ ধরতে

বেরিয়ে পড়লাম।


কৃষ্ণ পক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ আকাশে দেখা যায়। তার কলঙ্কিত মুখ ঢেকেছে মেঘের পাতলা চাদরে। সে পাতলা চাদর ভেদ করে ঝরে

পড়ছে ঝির ঝিরে বৃষ্টি আর চাঁদের শীতল আলো যার পরশে হৃদয় উদ্বেলিত হয়। আদিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত।  বাতাসের উদ্দাম

নৃত্যে সবুজ সমুদ্রে সৃষ্টি হয়েছে সবুজ লহরী। আমি এই সব রুপ দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম ক্যানেলে।ওমা পৌছে দেখি সেখানে

বসে আছেন একজন বুড়োলোক! ভোলের কাছে ক্যানেলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে লোকটি! বুকের ভিতর কেমন ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে

উঠলো। লোকটাকে আমি চিনিই না। কিন্তু আমাকে লোকটা ঠিক চিনে ফেললো। বললো- কি ভাইপো? রাতে মাছ ধরবে বুঝি?

-কে আপনি? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না! আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললাম।

-সে কি ভাইপো! আমায় চিনতে পারলে না! আরে তুমি রমেশের ছেলে তো?তোমার না বোধ হয় বিকাশ। কি ঠিক বললাম তো?

- হ্যা।

-তাহলে আমি ঠিক চিনেছি কি না বলো।

-সে তো ঠিক চিনেছেন দেখছি। কিন্তু আপনি কিভাবে আমার  জ্যেঠু হবেন সেটা তো বোঝান।

-হ্যা, আমি তোমাকে ওসব বোঝাই। আর মাছগুলো সব পালিয়ে যাক আর কি! চলো তোমার সঙ্গে মাছ ধরবো। দু’জনে মিলে

ক্যানেলে নেমে ঝাঁকি জাল টানা দেব। মনে হয় বেশ মাছ পড়বে। এই বলে ঝপাস করে জলে নেমে গেল!


অগত্যা বুড়ো লোককে হতাশ না করে আমিও জাল নিয়ে ক্যানেলের জলে নেমে পড়লাম। প্রথম টানা দিতেই দেখি চিংড়ি পুঁটি

পাঁকাল ইত্যাদি অনেক মাছ এসেছে। তাতে আমার ব্যাগের অর্ধেক ভর্তি হয়ে গেল। ক্যানেলটি প্রায় দু’শ মিটার লম্বা। ক্যানেলটি

বড়তলা নদীতে গিয়ে পড়েছে।নদীতে পড়ার আগে একখানা বেশ বড় সুইলিশ গেট আছে। এবার খুড়ো বললেন- এবার আর জাল

তোলা হবে না। আমি না বলা পর্যন্ত জাল তুলবে না।


আমরা জাল টানতে লাগলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য আমার মতো একজন জোয়ান ছেলে এক-বুক জল ঠেলে এগোতে যেখানে কষ্ট হচ্ছে,

সেখানে বুড়ো জ্যেঠু কিভাবে দ্রুত এগিয়ে চলেছে!  বেশ খানিকটা যাওয়ার পর বললাম- জ্যেঠু এবার জাল তোলা যাক। জ্যেঠু ধমক

দিয়ে বললেন- না, টানতে থাক। তারপর সেই মৃদু চন্দ্রালোকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম খুড়ো প্যাকাটির মতো ডান হাতে জালের একটি

প্রান্ত ধরেছেন, আর বাঁ হাতটি ইচ্ছে মতো বৃদ্ধি করে জাল থেকে মাছ বের করে খাচ্ছেন!


এমন সময় দেখতে পেলাম প্রায় আট দশটি মিসমিসে কালো কুকুর আমাদের পাশে এসে পৌছেছে! খানিকক্ষণ পরে তারাও মানুষের

আকৃতি হলো!তাদেরও আকৃতি হাড় জিরজিরে প্যাকাঠির মতো মানুষ! তারা খুড়োকে মাছ চাইছে! একজনতো বলেই ফেললো-অ্যাই

পাগলা, তুই ছোড়াটাকে উপরে ছুঁড়ে দে। আমরা ওর রক্ত চুষে খাই।


ওদের কথা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমন সময় ভূত খুড়ো বললে-চুপ কর তোরা।

তোদের আগেই আমি ছোঁড়ার রক্ত খেয়ে নিতাম। কিন্তু ও যে জালের কাঠি ধরে আছে! তাই কিছু করতে পারছি না। তখন আমি

দেখলাম যে আমি মুঠোকরে জালকাঠি মুঠোকরে জাল ধরে আছি। কাঠিগুলো লোহার তৈরী। আমি শুনেছিলাম লোহাকে ভূত খুব

ভয় করে। তাই যে ব্যাক্তি লোহা ধরে থাকে, তাকে ভূত কিছুতেই ধরতে পারে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশী সংখ্যায় জালের

কাঠি ধরতে থাকলাম। কিছুতেই কাঠি যাতে হাত থেকে বেরিয়ে না যায় সেটা সুনিশ্চিত করলাম। এসব দেখে আমার মাথা ঘরতে

লাগলো। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামাল দিলাম। মনে মনে ঠিক করলাম-আমাকে খুড়োর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। তা

নইলে বিপদ হবে। করলামও তাই।কতক্ষন ধরে যে জাল টানছি তার খেয়াল নেই। ওদিকে ক্যানেলের পাড়ে এখন অনেক অশরী

আত্মার ভীড় বেড়েছে।


পর শরীর অবশ হয়ে আসছে।মাথা আর কাজ করছে না। ক্যানেলের কাছাকাছি কোন বাড়ি নেই যে গিয়ে আশ্রয় নেব। ওদিকে

ভূত খুড়ো দ্রুত চলার জন্য তাড়া দিচ্ছে। পাড়ের ভূতেরা মাছ খেতে চাইছে। আমি এক হাতে জাল ধরে অন্য হাতে আমার থলির

মাছ তাদেরকে ছুঁড়ে দিলাম। ভূত খুড়োর তাড়ায় বাধ্য হয়ে আমি আবার দ্রুত জাল টানতে শুরু করলাম।


ওদিকে আমি বাড়ি গেলে বাবা মা রাতের ভাত খাবে বলে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাড়ির অন্যান্যরা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। বাবা

মা আমার জন্য জেগে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন তার খেয়াল নেই। ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন রাত সাড়ে তিনটে। আমি

তখনো বাড়ি ফিরিনি দেখে বাবা টর্চ নিয়ে ছুটলেন ক্যানেলের দিকে। ক্যানেলে পৌছে আমার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। আমি হাক

দিয়ে বললাম- বাবা এদিকে এসো। আমি এখানে খুড়োর সঙ্গে জাল টানছি। বাবা আমার থেকে প্রায় দূ’শ ফুট দূরে ছিলেন। তিনি

আমার দিকে আসতেই মূহুর্তে ভূত খুড়ো অদৃশ্য হলেন। আর আমি গভীর ক্লান্তিতে জলেই ঢলে পড়লাম। তারপর আমার আর কিচ্ছু

মনে নেই।আমার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন আমি বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছি।


কপিরাইট @কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।

দেবনগর

২৯/০৪/২০২০



কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.