জীবন যুদ্ধ

দিনটা ২৬ শে মে, ২০২১ খ্রীষ্টাব্দ। বাংলার ইতিহাসে এই দিনটা বিশেষভাবে লেখা থকবে।
ওই দিন সকাল ঠিক সাতটা সাড়ে সাতটার দিকে বাংলা আর উড়িষ্যার উপর আছড়ে পড়লো “যশ” নামে একটি সুপার সাইক্লোন। ঝড়কে আমি খুব ভয় পাই। আমার বাড়িটা পাকার হলেও ছাদটা অ্যাসবেস্টাসের। ছাদটা কংক্রীটের করা উচিত ছিল। কিন্তু তখন কি যে দুর্বুদ্ধি হলো কে জানে। আজ তার মাসুল গুনতে হচ্ছে। ঝড়ের আভাস পেলেই পড়শীর পাকা বাড়িতে আশ্রয় নেই। এখনো ছাদ দেওয়া যায়। কিন্তু মাথার উপর যে তিন কন্যার স্বয়ম্বরের দায়! কাকে বেশী প্রাধান্য দেওয়া যায়। ভেবে চিন্তে কন্যাদের পক্ষই নিলাম।
তা যাই হোক, প্রযুক্তির যুগে মোবাইল খুলে ঝড়ের অভিমুখ এবং তার গতিবেগ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। যখন নিশ্চিত হলাম যে ঝড় দীঘা এবং বালাশোরের মাঝখান দিয়ে অতিক্রম করবে, তখন বুঝে গেলাম যে আমরা সেফ জোনে চলে এসেছি। এখানে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ হবে ৯০-১১০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। এটা কোন ব্যাপার নয়। কারন আমফান ছিল ১৮০-১৯৩ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। তাকে যখন সামলানো গেছে, তখন যশ নিয়ে আর চিন্তা নেই।
আটটা ন’টার দিকে রাস্তায় ঘুরতে বের হলাম। তখন হাওয়ার গতি বড় জোর মেরে কেটে ৬০-৭০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা হবে। মনটা বেশ খুশিতে ভরে উঠেছে। এবারে অন্তত পড়শীর পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয় নি। এমন সময় শুনতে পেলাম মানুষ জনের চিৎকার, চেচামেচি, দৌড়াদৌড়ি আর কান্নার কলরোল। ভাবলাম হলো টা কি? এ কিসের চিৎকার! কিছুক্ষন পর বুঝতে পারলাম বিষয়টি। দেখলাম গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত থেকে ধেয়ে আসছে গভীর সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস।
জলোচ্ছ্বাসের নাম বইতে পড়েছি আর পড়েছি সংবাদ পত্রে। কিন্তু তা যে আমাদের জীবনে অংশ নিতে পারে, তা কখনো ভাবি নি।সেই জলোচ্ছ্বাসের কি তার গতিবেগ! যেন মহা প্রলয় আসন্ন। ধরিত্রীকে এখুনি যেন গ্রাস করবে। তার সম্মুখে যে পড়েছে তার হয়েছে করুনতম দশা।মানুষ একেবারে কিংকর্তব্যমিমুঢ়। সন্তান বাঁচাবে, না খাদ্যসামগ্রী কাগজপত্র গোবাদি পশু ইত্যাদি সামলাবে! সে এক চরম বিশৃঙখলা অবস্থা। মানুষ তাদের ক্ষমতা মতো যা সামলাতে পারলো তাই কিছুটা বাঁচলো। বাকীটা গ্রাস করলো সমুদ্রের বন্যা।
ঘন্টা খানিক পর দেখলাম সারা গ্রাম যেন মহা সমুদ্র। তার উপর ভেসে চলেছে খড়ের গাদা, বাড়ির ভাঙা চাল, হাজার হাজার প্লাসটিকের বোতল, শুকনো কাঠ আর তাতে আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন বিষধর সাপ, মরা মুরগী, আর লোনা জলের বিষে মৃত স্বাদু জলের রুই কাতলা মৃগেল শোল, বোয়াল, রূপচাঁদা পাঙ্গাস মাগুর আরও কত রমমের মাছ।
আমার বাড়ির সামনে ছিল একটি উঁচু বাঁধ। ফলে বেঁচে গেলাম বাড়ি খানা জলে ডোবার হাত থেকে। কিন্তু আমি কখনোই ভাবতে পারি নি চার কিলোমিটার দূরে নদীবাঁধ ভেঙে আমার বাড়ি পর্যন্ত জল আসবে কি করে! কারন অনুসন্ধ্যান করা দরকার।
যেহেতু আমি সামান্য একটি চাকুরী করি, তাই অনেক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে এবং তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম নদীবাঁধ ভাঙন রোধের কি কোন সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই! যাতে এই বিপর্জয় থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়। তাতে আমি যে সিদ্ধান্তে এলাম তা হলো-
যেদিকে নদীপাড় ভাঙে সে দিকে নদীর জলস্রোত বেশী। ফলে ওই দিকে পাড় ভাঙে বেশী। ফলে নদী বাঁধ ভাঙবেই। একে রোধ করতে গেলে ভাঙনের ধারে ধারে ইট আর বাঁশ দিয়ে তারের সাহায্যে একরকম খাঁচা ফেলতে হয়। এতে ভুমিক্ষয় রোধ তো হবেই, এবং নতুন পলি জমাতে সাহায্য করে। যদি দেখা যায় পলি জমে অনেকটা চর হয়েছে, তখন চরের শেষ প্রান্তে আবার খাঁচা ফেলে পলি জমাতে হবে। ফলে ভাঙন যেমন রোধ হবে, নদীচর বাড়বে, নদীবাঁধও আর ভাঙবে না। কিন্তু এখানে অনেক সমস্যা আছে। আমার দেশের জনসাধারণ খুব সচেতন। তারা নদীতে নেমে গিয়ে খাঁচার ভিতর মাছ খোঁজে। ফলে পলি জমার আর সুযোগ পায় না। আস্তে আস্তে তারের বাঁধন আলগা হয়ে গেলে বাঁশ আর ইট বাড়ি নিয়ে এসে বাড়িতে ব্যবহার করে। যারা এই কাজ করে তারাও জানে খাঁচার এই পরিনতি হবে। তাই কাজের গুনমান ঠিক থাকে না। ফলে নেপো অনেকটা দই খেয়ে নেয় বলে বেশ বদনাম রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই নেপোকে আজও কেউ খুঁজে পেল না।
আমাদের নদী বাঁধের পাশে অনেক ফিশারী আছে। সেগুলির একদিকের বাঁধ হলো নদীবাঁধ। উচ্চতা নদী থেকে আড়াই মিটার। ফলে বাঁধে যেমন মাটি দেওয়া যায় নি, তেমনি মাটি দেওয়ার জন্য মাটি পাওয়া যায় নি। ফলে আড়াই মিটার উঁচু নদীবাঁধ দশ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস সামলাবে কি করে!
আজকের দিনে মানুষের জীবন যাত্রা এত যন্ত্রনাদায়ক যে সে বলে বোঝাবার নয়। পানীয় জলের অভাব, খাদ্যের অভাব, মৃত বস্তুর দুর্গন্ধ প্রভৃতি মানুষকে অতীষ্ট করে তুলেছে।
তবে আশার কথা এই যে রাস্তার উপর ত্রিপল খাটিয়ে কুড়ে ঘরে থাকলেও টিভির সিরিয়াল কিন্তু চলছে। একেই বলে বোধ হয় বেঁচে থাকার লড়াই, বেঁচে থাকার আনন্দ।
কপিরাইট@তারাপদ মাঝি
দেবনগর
০৪/০৬/২০২১

কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.