#হঠাৎ_বিয়ে

#গল্প

#হঠাৎ_বিয়ে

#তারাপদ_মাঝি


রাত তখন ২টো। সুন্দর সাজানো বাসর ঘরে অবগুণ্ঠনে ঢাকা সঞ্চিতা বিছানায় বসে আছে। নানা রঙের ফুলে পরম যত্নে রত্না
দিদির সাজানো বিছানা। রত্নাদি তার গাল দু’টি টিপে দিয়ে বলেছে-”নিজের পরম রত্নকে আজ আপন করে নিবি। নিজেকে ওর কাছে
সঁপে দিবি। যে রকম কলতলায় পাখনা মেলে তুই স্নান করিস, ঠিক তেমনি আজ তোর এই প্রানের প্রিয় মানুষের ভালোবাসায় স্নান
করিস মুখপুড়ি। একদম লজ্জা করিস না।”


এই কথা শুনে খুব লজ্জা পেয়েছিল সঞ্চিতা। আর পাবে নাই বা কেন? বাড়ির আশে পাশে পাড়াতুতো ভাইদের সঙ্গে মেলামেশা ছাড়া

কোন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে মেলামেশা করে নি সঞ্চিতা। তাছাড়া সঞ্চিতা একটু স্থুলকায়া বলে কোন ছেলে বন্ধু তার প্রতি আগ্রহ দেখাত

না। ফলে মনে সুপ্ত ইচ্ছা থাকলেও কারও সঙ্গে কোন ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে নি। ঘনিষ্ঠতা না হওয়ার আরও একটি বড় কারণ হলো

মায়ের কঠোর শাসন এবং নজরদারী। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় উচ্চমাধ্যমিকেই পড়াশুনায় ইতি টানতে হলো।


মনে মনে অনেক কিছু আবোলতাবোল ভাবছিল সঞ্চিতা। এমন সময় সখীদের কোলাহলে সঞ্চিতা সম্বিত ফিরে পেল। বুঝতে পারলো

এবার তার জীবন সাথী আসছে। কি এক অজানা ভয়ে বুকটা ধুক্ পুক্ করতে লাগলো। সঞ্চিতা কি করবে বুঝতে পারছিল না।

এমন সময় রত্নাদি সঞ্চয়নকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে আমার পাড়ার সব সহচরী।


সঞ্চয়নকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললে- সঞ্চয়বাবু, এই তোমার সঞ্চিতা। তোমার জিনিষ তুমি বুঝে নাও। আমরা কিন্তু বাইরে আছি

পাহারায়। কোন দুষ্টুমি করবে না কেমন?

-আজ্ঞে না, কোন দুষ্টুমি করবো না। 

সবাই খিল খিল করে হেসে উঠল।

-রত্নাদি ছোখ পাকিয়ে বললে- ন্যাকামো হচ্ছে? দুষ্টুমি করবে না তো বিয়ে করলে কেন?

- আপনি তো বললেন যেন কোন দুষ্টুমি না করি!

-ও, আমি কিছু না বললে তুমি দুষ্টুমি করতে!

- না, মানে দুষ্টুমি আবার কি করবো?

-তা হলে কি করতে বলো।

এমন সময় সঞ্চিতার মা গীতা দেবী এসে সঞ্চয়নকে বাঁচালো। বললে- রত্না, আমার সাতটা নয়,  পাঁচটা নয়, একটি মাত্র জামাই।

তাকে ভালো মানুষ পেয়ে এ রকম জ্বালাবি? চল আমার সঙ্গে একটু হাত লাগাবি। অনেক কাজ বাকি। ছেলেটাকে একটু ঘুমোতে দে।

যা ধকল গেছে বাছার উপর। বলে রত্নাদিকে এবং অন্যান্যদের টেনে নিয়ে গেলেন উনি। সঞ্চিতা বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে দরজা

ভিজিয়ে দিলে।


গীতা দেবী নিজ হাতে সংসার সামলাতেন। স্বামীর থেকে নিজেই কতৃত্ব করতেন বেশী। স্বামীকে তিনি দেবতার মতো দেখতেন। তার

সুখের দিকে খুব খেয়াল রাখতেন। নিজে ঝ্যাটাকাঠি তুলে, ঠোঙা তৈরী করে রোজগার করার চেষ্টা করতেন। নিজে ভালো রান্না

করতে পারতেন। তাকেই অবলম্বন করে বাড়ির পাশে রাস্তার উপর চপ মুড়ি, ঘুগনি মুড়ি, মশলামুড়ি ইত্যাদির দোকান দিয়ে

রোজগার করে সংসার চালাতেন। স্বামী যা রোজগার করতেন, তার বেশীর ভাগ সঞ্চয় করতেন। স্বামীর শরীর বাঁচিয়ে তবেই কাজ

করতে দিতেন। সব দিকেই গীতা দেবীর কড়া নজর রাখতেন। গীতা দেবীর সবচেয়ে ভালো গুন হলো তিনি প্রতি দিনই সন্ধ্যে বেলা

তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে যেমন দেবতাকে প্রনাম করতেন, ঠিক তখনই গলায় আঁচল দিয়ে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রনাম

করতেন।


আজ এই বাসর রাতে সঞ্চিতা তার মায়ের অস্ত্রেই সঞ্চয়নকে বধ করলে।  লাল বেনারসী শাড়ির আঁচল গলায় দিয়ে তার স্বামী

দেবতাকে আজ প্রনাম করলে। তার পর ক্ষীন অথচ ষ্পষ্ট স্বরে সঞ্চিতা বললে- আমায় তুমি আশীর্বাদ করো যেন সারা জীবন

তোমার সেবা করে শাখা সিঁদুর নিয়ে মরতে পারি।


-এমন করে বলছো কেন সঞ্চিতা? আজকের দিনে এমন কথা বলতে নেই। তাছাড়া আজকালকার দিনে কেউ স্বামীকে প্রনাম করে

না। স্বামীকে কেউ দেবতা বলে ভাবে না। এখন স্বামী মানে বন্ধু, বেড পার্টনার। সমাজ তত্ত্ববিদদের মতে “ বিয়ে একটি সামাজিক

চুক্তি”। এর দ্বারা সমাজ নারী পুরুষকে একত্র থাকার বা সহবাস করার সামাজিক অধিকার দেয়। এখানে “স্বামী” দেবতা টেবতা

কিছুই নয়।


-সে সব তুমি ভাবতে পারো, আমি কিন্তু ভাবতে পারি না। আমার মা আমাকে যা শিখিয়েছেন, মায়ের কাছ থেকে যা পেয়েছি,

আমি তাই নিয়ে এই নতুন জীবনটাকে কাটাতে চাই। 


সঞ্চয়ন আর কিছু বলতে পারলো না। সে বললো- তোমায় একটু জড়িয়ে ধরবো সঞ্চিতা?

-সে আমি কি বলবো? তোমার জিনিষ তুমি যা খুশি তাই করতে পারো।

এম. এ পাশ করা সঞ্চয়ন কিছুই বুঝতে পারে না। এ কি নারী,  নাকি নারী রুপি কোন দেবী! তাকে প্রনয় পাশে আবদ্ধ করে তার

সব কিছু কি লুঠ করে নেবে? তা নিক। এমন স্ত্রীর কাছে জীবন সঁপে দেওয়া ভালো। তাতে ভালো বই খারাপ কিছু হবে না।


এবার সঞ্চয়ন বললো- আচ্ছা, সত্যি করে বলবে একটি কথা?

-কি কথা?

- আমাকে কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

- তোমাকে পছন্দ না হওয়ার কি আছে? তুমি এম. এ পাশ। চাকুরি না করলেও প্রাইভেট পড়িয়ে ভালোই রোজগার করো। তার উপর

তোমাদের পেয়ারা আর লিছু বাগান আছে। তাহলে পছন্দ না হওয়ার তো কিছু নেই।

- মানুষের পছন্দ অপছন্দ শুধু তার মজবুত আর্থিক ভিতের উপর নির্ভর করে না। মানুষের রূপও পছন্দ অপছন্দের ফ্যাক্টার হয়

জানো?

- আমার নিজের রূপের ঠিক নেই তো আমি রূপ বাছতে যাবো কেন? 

এবার সঞ্চিতা প্রশ্ন করে। বলে- আমার তো সব নেগেটিভ পয়েন্ট। রঙে ফর্সা হলেও বেশ স্থুলকায়া, আমরা দরীদ্র,। মা অনেক কষ্টে

আমার বিয়ে দিয়েছেন। তুমি বিপদে না পড়লে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া অসম্ভব ছিল। এবার তুমি বলতো, আমাকে তোমার

পছন্দ হয়েছে কি না?


সঞ্চয়ন বলল-” সত্যি বলতে কি, মেয়েটা এভাবে আমায় ঠকাবে, তা আমি ভাবতেই পারি নি। ওর যদি অন্য কোথাও সম্পর্ক থাকে

তাহলে আমায় জানাতে পারতো। তা না করে বিয়ের দিনে আমাকে লগ্ন ভ্রষ্ট করে অন্য ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল! আমার কপাল

ভালো যে তোমার মা আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচালেন। আর আমি মানুষের রূপ নিয়ে ভাবি

না। ভাবি মানুষের সুন্দর মন নিয়ে। মানুষের রূপ,যৌবন, অর্থ সব কিছুই নস্বর। কিন্তু মনই হলো মানুষের আসল রূপ। আর সে

দিক থেকে আমি খুব ভাগ্যবান। কারণ তোমার মতো একটি সুন্দর মনের মানুষকে স্ত্রী হিসাবে পেয়েছি। আমি জানি না তুমি বিশ্বাস

করবে কি না। তবে স্থুলকায়া হলেও তোমার রূপের আলাদা একটা ঐশ্বর্য্য আছে।”


কথায় কথায় রাত শেষ হয়। পাখীরা কলকাকলিতে সকালকে ভরিয়ে তোলে। ভোরের আলো সঞ্চিতার রুগ্ন বাড়ির ভাঙা চালের

ফাঁক দিয়ে বিছানায় এসে পড়ে। দু’জনে হাত ধরে ঘরের বাইরে আসে। নতুন দিনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো তাদের নতুন করে পথ

চলা।


কপিরাইট@তারাপদ মাঝি

২০ই ফেব্রুয়ারী ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ।

৭ ই ফাল্গুন ১৪২৭ বঙ্গাব্দ

দেবনগর। 



কোন মন্তব্য নেই

গল্প বা কবিতা কেমন লাগলো তা জানাতে ভুলবেন না

Blogger দ্বারা পরিচালিত.